দলগতভাবে নিরাপদ সবজি চাষে লাভবান হচ্ছে কৃষক
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কৃষক কুদ্দুস মোল্লা ১১০ শতক জমিতে ক্লাস্টার-ভিত্তিক বা গুচ্ছ চাষ পদ্ধতিতে বেগুন, টমেটো, করল্লাসহ শীতকালীন সবজি চাষ করেছেন।
"এতে বিঘা প্রতি ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ক্ষতিকর পোকা দমনে ক্ষেতে এবার ব্যবহার করা হয়েছে ফেরোমন ফাঁদ। এর আগে, পোক দমনের জন্য মাসে ৪ বার ওষুধ মেশানো পানি স্প্রে করতে হতো। এখন ফেরোমন পদ্ধতি ব্যবহার করায় মাসে একবার স্প্রে করলেই হয়ে চলে। পরিবেশবান্ধব নতুন এই পোকামাকড় দমন পদ্ধতিতে আমাদের খরচও কম হচ্ছে," বলেন কুদ্দুস।
কুদ্দুস মোল্লা একা নন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর চালু করা ক্লাস্টার-ভিত্তিক নিরাপদ চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছেন আরও অনেক কৃষক।
দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের হাজার হাজার কৃষক গত এক দশকে পিকেএসএফ-এর সহায়তায় দলবদ্ধ সবজি চাষে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন।
সংস্থাটি আরও ৩৬টি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে মিলে কৃষকদের ঋণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে। এই সহায়তা কাজে লাগিয়ে কৃষকরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় ছোট ছোট দল গঠন করে, প্রধানত জৈব সার এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষ করছেন বিভিন্ন ধরনের সবজি।
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা স্থাপনের একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম হল পিকেএসএফ। সংগঠনটির জেনারেল ম্যানেজার (প্রোগ্রাম) ড. শরীফ আহমেদ চৌধুরী জানান, প্রায় এক দশক আগে সমন্বিত কৃষি ইউনিটের অধীনে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় নিরাপদ সবজি উৎপাদন কর্মসূচি প্রথম চালু হয়।
তখন থেকেই এই পদ্ধতি কৃষকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে, ৩৪টি জেলার প্রায় ১৪ হাজার ৬৩০ জন কৃষক এই সমবায় চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে অধিক মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি উৎপাদন খরচও কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানান তিনি।
এই কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো, যৌক্তিক পরিমাণে সার এবং বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদন ব্যয়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং উৎপাদনকারীদের সঙ্গে সরাসরি বাজার সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি করা।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় নিরাপদ সবজি উৎপাদন ঘুরে দেখেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদক।
জাজিরার মিরাশা, লাউখোলা এলাকায় দেখা যায়, ১০ জন কৃষক একসঙ্গে ৩১৯ শতক জমিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, পালং শাক ইত্যাদি চাষ করেছেন। দৃষ্টি যতদূর যায় সবুজের সমারোহ। আর ২০ ফিট দুরত্বে দুরত্বে পাতা হয়েছে পরিবেশবান্ধব পোকা দমন পদ্ধতি ফেরোমন ফাঁদ।
পিকেএসএফের অর্থায়নে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় কিছু সবজি চাষের ক্লাস্টার বাস্তবায়ন করছে পিকেএসএফেরই সহোযোগী সংস্থা নাড়িয়া উন্নয়ন সমিতি (নুসা)।
ক্ষেতের পাশেই কথা হয় নিরাপদ সবজি চাষী মতিউর রহমানের সঙ্গে । তিনি ৮৪ শতক জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করেছেন।
মতিউর রহমান বলেন, "নিরাপদ সবজির দাম কিছুটা বেশি পাওয়া যায়। বাজারে নিলে দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। তবে আরও প্রচারণা হলে, দাম আরও বেশি পাওয়া যাবে।"
তিনি বলেন, "জমিতে গরুর গোবর দিয়ে বানানো জৈব সারসহ কম্পোস্ট সার দেই। রাসায়নিক সার সামান্য দেওয়া হয়, এর ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ চারভাগের একভাগ কমেছে।"
"ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ফুলকপি বিক্রি শুরু করেছি। প্রথম দিকে পাইকারি ৩২ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। ইতোমধ্যেই ২৫ শতক জমির ফুলকপি বিক্রি করেছি। ফসল চাষ করতে মোট উৎপাদন খরচ হয়েছে ৫০ হাজার ৯০০ টাকা; আশা করছি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবো," যোগ করেন মতিউর।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নমিতা হালদার এনডিসি বলেন, "আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য উদ্বুদ্ধ করি। জমিতে ভার্মিকম্পোস্ট, গোবর সার, ট্রাইকো কম্পোস্ট দেওয়া হয়। আমরা জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করছি। মাত্র ১০ শতাংশ কেমিক্যাল সার ব্যবহার করা হয় এই পদ্ধতিতে, যে কারণে আমরা এটিকে নিরাপদ বলছি।"
নাড়িয়া উন্নয়ন সমিতি (নুসা)-এর তথ্য মতে, নিরাপদ সবজি চাষে বাস্তুসংস্থান নিরাপদ থাকে। স্প্রে দিয়ে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না, ফলে কৃষকের শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ হয় না। দূষণজনিত সমস্যায় চোখ ও চামড়া আক্রান্ত হয় না, ফলে জন্য মেডিকেল খরচও সাশ্রয়ী হয়। এছাড়া, নিরাপদ সবজি গ্রহণের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
৯২টি উপজেলার কৃষকরা এ পর্যন্ত এই কর্মসূচির আওতায় ২ হাজার ৪১৫টি ক্লাস্টারে সবজি চাষ করেছেন। এই ফসল বিক্রির জন্য পিকেএসএফ ২৭টি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেছে।
ড. শরীফ আহমেদ চৌধুরী জানান, "কৃষকরা নিজেরাই তাদের সবজি বিক্রির জন্য ঘর নেয়। আবার কোনো কোনো জায়গায় আমরাও বিক্রয়কেন্দ্র তৈরি করে দেই। সেখান থেকে সরাসরি পাইকারদের ট্রাক এসে পণ্য নিয়ে যায়।"
তিনি বলেন, "আমরা খামারিদের আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও লিগাল সাপোর্ট দেই। সরাদেশে প্রায় ১ হাজার ১৪৭ জন কৃষককে আমরা ট্রেনিং দিয়েছি। নিরাপদ সবজি চাষে বাস্তুসংস্থান নিরাপদ থাকে। গড়ে ১০ শতাংশ খরচ কমে এই পদ্ধতিতে চাষ করলে।"
"কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা সহায়হতা করেন আমাদের। তারা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে উৎপাদন পদ্ধতিটি সার্টিফাই করে দেন। কতটুকু সার ব্যবহার করতে হবে, এরমধ্যে অর্গানিক পরিমাণ কতটুকু থাকবে, পেস্টিসাইড ব্যবহার করলে কোন পর্যায়ে এবং কখন তা ব্যবহার করতে হবে- এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দেন তারা। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ নিরাপদ, তাই আমরা একে নিরাপদ সবজি বলি," যোগ করেন তিনি।
জাজিরা উপজেলায় পিকেএসএফের অর্থায়নে শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এসডিএস) চাষীদের নিরাপদ সবজি চাষে উৎসাহিত করছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জাজিরার মূলনা ইউনিয়নের মিরাশা গ্রামে ৩ জন সবজি চাষীকে নিয়ে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে এসডিএসের তত্ত্বাবধানে ৮৫ জন কৃষকের মাধ্যমে প্রায় ৩০ একর জমিতে নিরপদ পদ্ধতিতে করলা, লাউ, বেগুন, ধুন্দুল ও চিচিঙ্গা চাষ হচ্ছে।