বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন জিঞ্জিরায় তৈরি মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভর করছে
গত বছর গুরুত্বপূর্ণ মেশিনারিজ, সরঞ্জাম ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করতে গিয়ে ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। অনাকাঙ্ক্ষিত এই বাধায় তাদের পক্ষে উৎপাদন কাজ অব্যাহত রাখাই দায় হয়ে পড়ে।
শিল্প কারখানায় বিকল যন্ত্রপাতি সারাইয়েও লাগে যন্ত্রাংশ, অনেক সময় মেশিন একেবারে নষ্ট হয়। এমন দরকারি অনেক মেশিন, খুচরা যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু, তা না করতে পারায় কীভাবে উৎপাদন কাজ সচল রাখা যায়, সেই ভাবনা থেকেই অনেক শিল্পোৎদ্যোক্তা ঝোঁকেন জিঞ্জিরার দিকে। এখান থেকে তারা বিভিন্ন বিদেশি মেশিনের 'হুবহু মেশিন' তৈরি করে নিচ্ছেন। এ ধরনের পণ্যের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই জিঞ্জিরা একটি নির্ভরযোগ্য উৎস।
প্রায় শূন্য থেকে জটিল মেশিনারিজ ও স্পেয়ার পার্টসের অনুকরণে রেপ্লিকা তৈরিতে রাজধানীর উপকন্ঠে কেরানীগঞ্জের পার্শ্ববর্তী এই এলাকার খ্যাতি আছে। বর্তমান সময়ের মতো সংকট কালে– এই দক্ষতাই শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগছে।
কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হলে, জিঞ্জিরায় আসল মেশিনের কোনো নমুনা বা ডিজিটাল ব্লুপ্রিন্ট নিয়ে যেতে হয়। তারপর সেই অনুসারে, গ্রাহকের কাঙ্ক্ষিত পণ্য তৈরির জন্য এখানে আছে হাজারো কারখানা। তবে মানে কিছু কমতি হবে এটাও স্বাভাবিক।
জিঞ্জিরার ব্যবসায়ীরা জানান, শিল্পোৎপাদকদের জিঞ্জিরার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকায়– গত বছরের আগস্ট থেকে প্রতি মাসে তাদের ব্যবসা দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে জিঞ্জিরা ও পাশের কেরানীগঞ্জে ৬ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় গড়ে ওঠা হালকা প্রকৌশলের এ শিল্প আরো শক্তিশালী হয়েছে।
বর্তমানে জিঞ্জিরার তাওয়াপট্টি, টিনপট্টি, আগানগর, বাঁশপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট ও ফেরিঘাট এলাকায় প্রায় ২,৫০০ ক্ষুদ্র ও হালকা প্রকৌশল কারখানা রয়েছে।
জিঞ্জিরায় বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। তবে গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে এখানে।
দেশে ডলার সংকটে শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণপত্র খোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় তৈরি পোশাক, বস্ত্র, ওষুধ খাতের মতো প্রধান শিল্পগুলোর জিঞ্জিরার পণ্যে নির্ভরশীলতা বেড়েছে প্রধানত দুই কারণে – এগুলো সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায়।
একটি ওষুধ কোম্পানির উদাহরণই দেওয়া যাক, তবে সূত্রের অনুরোধের কারণে এর নাম গোপন রাখা হচ্ছে।
এর সংশ্লিষ্টরা জানান, তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন ট্যাবলেট মোড়কজাত করতে ব্যবহার হতো ১৮টি অটোমেটিক পাউচ প্যাকিং মেশিন। গত বছরের জুনে এরমধ্যে ৬টিই বিকল হয়ে পড়ে। এই মেশিনগুলো সাধারণত চীন থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু, এলসি জটিলতার কারণে জুলাই মাস থেকে তারা একটি মেশিনও আমদানি করতে পারেনি। ফলে উৎপাদন কাজে ব্যাঘাত হচ্ছিল। এসময় বাধ্য হয়েই সাহায্যের সন্ধানে জিঞ্জিরায় যান কোম্পানির কর্মকর্তারা।
নাম না প্রকাশের শর্তে ফার্মা কোম্পানিটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন,'নষ্ট হওয়া একটি মেশিন জিঞ্জিরার একটি কারখানার কারিগরদের দেখিয়ে বলা হয় এই মেশিন তৈরির জন্য। তারা সম্মত হয় এবং এজন্য ৮ দিন সময় নেয়'।
'প্রথমদিকে আমাদের একটু সংশয় কাজ করছিল, কিন্তু তারা সফলভাবে একটি মেশিন তৈরি করে। সেটি আমরা ফ্যাক্টরিতে সংযোজন করার পর ভালো ফল পাই। এরপর আরো পাঁচটি মেশিন তৈরির অর্ডার করা হয়। চীন থেকে এসব মেশিন আমদানির খরচ পড়তো প্রতিটিতে ১৭ লাখ টাকা করে, জিঞ্জিরায় মাত্র চার লাখ টাকায় বানিয়েছে' বলছিলেন ওই কর্মকর্তা।
'মানের দিক থেকে শতভাগ বিদেশি মেশিনের সমান না হলেও এই সংকটের সময় উৎপাদনকাজ চালিয়ে যাওয়া যাচ্ছে' যোগ করেন তিনি।
শুধু ওষুধ খাতের প্যাকেজিং মেশিন নয়, আরো বহু ধরনের মেশিনারিজ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ (বেশিরভাগই রেপ্লিকা) তৈরি হচ্ছে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, কৃষি, রাসায়নিক, প্রসাধনী, পিভিসি পাইপ, প্যাকেজিং, হোম এপ্লায়েন্স, সিরামিক ও অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য।
গত বুধবার জিঞ্জিরার তাওয়াপট্টিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজশাহীর একটি ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানির জন্য 'লিকুইড সিরাপ মেকিং মেশিন' বানাচ্ছে রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং নামক একটি প্রতিষ্ঠান।
রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্বত্বাধিকারী ইস্রাফিল হোসেন বলেন, 'সাধারণত এই মেশিনটি আনা হয় তাইওয়ান, চীন অথবা কোরিয়া থেকে। কিন্তু আমদানি করতে না পারায়, রাজশাহীর ওই ওষুধ কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। মেশিনটি তৈরির জন্য চুক্তি হয়েছে ১১ লাখ টাকায়। ২২ ফেব্রুয়ারি ডেলিভারি দেওয়া হবে'।
'গত আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির জন্য প্রায় ৩০টি বিভিন্ন রকম মেশিন তৈরি করেছি '। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের মেশিনের অর্ডার অনেক বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'ওষুধ কারখানার জন্য একেবারে বেসিক এবং ডিজিটাইজড মেশিন ছাড়া প্রায় সব রকমের মেশিন আমরা তৈরি করতে পারি'।
প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় 'ব্লো মোল্ডিং মেশিন'। জিঞ্জিরার আরেক কারখানায় এটাও তৈরি হতে দেখা গেল।
নাম না প্রকাশের শর্তে, প্রসাধনী উৎপাদনকারী একটি কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, মানভেদে এই মেশিনটি আমদানি করতে খরচ হয় ৮০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত। 'মাত্র ২০ লাখ টাকা খরচ করে জিঞ্জিরায় এই মেশিন বানানো হয়। এছাড়া, ইন্ডাস্ট্রিয়াল র্যাক, প্লাস্টিক প্যালেট ও প্যাকেজিংসহ সব রকম মেশিন এখানে তৈরি করা হয়।
তাওয়াপট্টি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আকতার জিলানী খোকন জানালেন, জিঞ্জিরায় কারখানাগুলোতে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। গত আগস্ট থেকে জানুযারি পর্যন্ত প্রতিমাসে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রাংশ তৈরির পর সরবরাহ হয়েছে এই এলাকা থেকে। যেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ বিদেশি মেশিনের 'হুবহু' (রেপ্লিকা) মেশিন।
রুনা স্টিল হাউজের ম্যানেজার আনিসুর রহমান বলেন, জিঞ্জিরায় অনেক ভারি মেশিনও তৈরি হয়। 'ওষুধ কোম্পানি বা গার্মেন্টসের জন্য ব্যবহুত একটা প্রেসার মেশিন চীন থেকে কিনতে ৭-৮ টাকা লাগলেও, এখানে মাত্র তিন লাখ টাকায় বানিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু, ৭ লাখ টাকার মেশিন অরজিনাল। আর এখানে তৈরিটা আসলের মতো বেশিদিন টেকে না'।
গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল মেশিনারিজের চাহিদাই সর্বোচ্চ
গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় গত বছরের মার্চে 'জিএম টেক্সটাইল লিমিটেড' নামের একটি ট্রেক্সটাইল কারখানা চালু করা হয়। জুন মাসে কোম্পানি তাদের কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম আরো বাড়ানো সিদ্ধান্ত নিলেও, দরকারি বিভিন্ন মেশিন আমদানি করতে না পারায় সেটি সম্ভব হচ্ছিল না।
নাম না প্রকাশের শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ' কারখানার জন্য ফেব্রিক মেজারিং মেশিন, ফেব্রিক চেকিং মেশিন, ফেব্রিক ইন্সপেকশন অ্যান্ড রোলিং মেশিন, নিটেড ফেব্রিক ইন্সপেকশন মেশিন, ফেব্রিক ইন্সপেকশন টেবল ফর নিটসহ প্রায় ২৫টি মেশিনের প্রয়োজন ছিল। এগুলো সাধারণত জাপান, কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান ও জার্মানি থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিতে ন্যূনতম খরচ পড়তো ৫ কোটি টাকা'।
কিন্তু, এলসি জটিলতার কারণে আমদানি সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে কারখানার অবকাঠামো সব প্রস্তুত। ২৫টি মেশিনের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ১৯টি মেশিন জিঞ্জিরা থেকে বানিয়ে নেওয়া হয় গত ডিসেম্বর মাসে। এতে খরচ পড়েছে প্রায় ৮০ লাখ টাকা, যোগ করেন তিনি।
জিঞ্জিরার আগানগর এলাকার 'ফকির এন্টারপ্রাইজ' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বেশ সুনাম রয়েছে টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট এর বিভিন্ন মেশিন তৈরির জন্য।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন,বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন, তার বেশিরভাগ স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করেন জিঞ্জিরার ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, 'তারা যে মেশিনগুলো তৈরি করেন সেগুলোর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় স্ক্র্যাপ স্টিল, রড, এবং বিভিন্ন পরিত্যক্ত মেশিনের যন্ত্রাংশ। এর একটা বড় অংশ সংগ্রহ করা হয় পরিত্যক্ত জাহাজের স্টিল, পাত ও ইঞ্জিন থেকে'। তাই জিঞ্জিরায় কাঁচামালের কোনো সংকট নেই বলেও উল্লেখ করেন রাজ্জাক।
বাংলাদেশ ইনডেন্টিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এর সভাপতি রফিকুল ইসলাম মাসুম বলেন, ফার্মা, ফুড, সিমেন্ট, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কারখানায় বিদেশি মেশিন আমদানি করার জন্য তাদের সংগঠনের ৩৫০টি সদস্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু, গত আগস্ট মাস থেকে কোনো ধরনের মেশিন আমদানি করতে পারছে না তারা।
আইনগত বাধা
জিঞ্জিরা এলাকার আড়াই হাজার কারখানা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে হালকা প্রকৌশল ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত। তবে তাদের কোনো কারখানা বা বৃহৎ শিল্পে ব্যবহৃত মেশিন উৎপাদনের অনুমোদন নেই।
বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. মোহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, 'এধরনের মেশিন তৈরির জন্য পেটেন্ট-ডিজাইনের স্বত্ব থাকার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও সেই ডিজাইন অনুযায়ী, মেশিন বা টেকনোলজি তৈরির জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন। একাডেমিক স্বীকৃতি ছাড়া এসব অনুমোদন সম্ভব নয়'।
'জিঞ্জিরার বিষয়টি হলো, কারিগররা অভিজ্ঞতা থেকে নকল মেশিন তৈরি করে। ফলে এসব মেশিন আমদানি থেকে সরকার যে রাজস্ব পাওয়ার কথা ছিল তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি মানও অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের উচিত দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে মেশিন আমদানির পথ সহজ করা' যোগ করেন তিনি।
তবে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, 'সরকারের অনুমোদিত দেশে উৎপাদনযোগ্য ছোটখাটো কিছু মেশিন সংযোজন এবং সকল রকম মেশিনারিজ ও মটরের যন্ত্রাংশ তৈরির অনুমোদন আছে জিঞ্জিরার এসব কারখানার। তাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এলসির সাময়িক সমস্যার কারণে, এই এলাকায় বিভিন্ন বিদেশি মেশিন তৈরির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের জানা নেই'।