আগামী বাজেটে সম্পদ কর, আর্থিক খাত সংস্কারের সুপারিশ অর্থনীতিবিদদের
সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে কোভিডকালীন নেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আগামী বাজেটে নতুন উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া, বৈষম্য কমাতে সম্পদ কর আরোপ করা এবং পাবলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গুণগত মান নিশ্চিত করতে 'ম্যাসিভ ইন্টারভেনশনে'র প্রস্তাব করেছেন তারা।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন নিয়ে রবিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে অনলাইন সভায় দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা এসব পরামর্শ দিয়ে বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে আর্থিকখাতে স্থিতিশীলতা রক্ষা জরুরি। এজন্য ফাইন্যান্স কমিশন বা ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম এবং তা এখন ৮% এর নিচে। আইএমএফ-এর ঋণশর্তে আগামী অর্থবছর এটি জিডিপির ০.৫% বাড়ানোর বিষয়ে সরকার সম্মতি দিয়েছে। রাজস্বখাতের সংস্কার ও ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়াতে আগামী বাজেটে ট্যাক্স কমিশন গঠন করা এবং খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সকল ভোগ্যপণ্যের জন্য প্রাইসিং পলিসি প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ শুনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, 'আমাদের অনেক সমস্যা। কিন্তু সমস্যাগুলো কিভাবে চিহ্নিত করবো, সেগুলো নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দারিদ্র হ্রাস ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা থাকলেও বৈষম্য বাড়ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগামী বাজেটে ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, সরকারের অনেক নীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈষম্য বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। প্রত্যক্ষ করের বদলে পরোক্ষ কর আহরণে গুরুত্ব দেওয়াও এমন একটি কারণ।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে রেহমান সোবহান বলেন, 'এটা ম্যাক্রো-ইকোনমির ক্রেডিবিলিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইমেজ ও ইনভেস্টমেন্ট পলিসির সঙ্গে সম্পৃক্ত। খেলাপি ঋণের সঙ্গে বাজারের কিছু বড় প্লেয়ার সম্পৃক্ত। পুনঃতফসিল ও রাইট-অফ সুবিধা দিয়ে রিসোর্সগুলোকে খেলাপিদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ব্যাংকের অর্থ আমানতকারীদের মধ্যে অনেকেই দরিদ্র। ঋণ খেলাপির সুবিধা দেওয়াও সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে।'
'সব অর্থমন্ত্রীরা বলে থাকেন যে, ঋণ খেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু সব অর্থমন্ত্রীই নির্বাচনের আগে ২%-৫% ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হতে সহায়তা করে', বলেন তিনি।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য অনেক বেশি উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, সম্ভ্রান্তরাই শুধু কোয়ালিটি শিক্ষা পাচ্ছে। একই অবস্থা স্বাস্থ্যখাতেও। তাই পাবলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ উল্লেখ করে তিনি তা কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেন।
বড় ঋণ খেলাপি কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণকে আগামী অর্থবছর ইক্যুইটিতে রূপান্তর করে সরকারকে মালিকানা নিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, অন্তত বড় বড় এন্টারপ্রাইজের ক্ষেত্রে এটি করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, আর্থিকখাতের সমস্যা চিহ্নিত করতে ১৯৮১-৮২ সালে যেভাবে মানি এন্ড ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়েছিল, এখনও তেমন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এতে অন্তত সমস্যাগুলো চিহ্নিত হবে। পরে সরকার সমস্যা সমাধান করবে কি-না, সেটি বিবেচনা করতে পারে।
ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে আগামী বাজেটে সীমিত পরিমাণে হলেও সম্পদ কর চালুর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অন্তত মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এটি চালু করা যেতে পারে।
গ্রামে মানবসম্পদ ও পুষ্টিসূচকের উন্নতি ঘটলেও নগরের দরিদ্র ২০% জনগোষ্ঠীর কোন উন্নতি হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, নগর দরিদ্রের দিকে বাজেটে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোকে ঋণসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে গড়ে তুলতে সহায়তা দিতে হবে।
কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ভূমিহীন বর্গাচাষীদের জন্য বাজেটে বাড়তি সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
আগামী বাজেটে রেগুলেটরি ডিউটি তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, আগামী বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একই সঙ্গে রাজস্ব এবং বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, এক্সচেঞ্জ রেট ডিপ্রিসিয়েশনের কারণে পণ্য আমদানির ট্যারিফও বেড়ে গেছে। বিশ্বে গড় ট্যারিফ ৬%, এলডিসিগুলোর ১১%। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যারিফ ২৭%, যা টাকা দুর্বল হওয়ার পর আরও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় বাজেটে পণ্য আমদানি শুল্ক কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান বলেন, 'একটি সমস্যার সমাধান হলেই অর্থনীতির সব সমস্যা দূর হয়ে যায়, তা হলো- কর-জিডিপি বাড়ানো। তাই বাজেটে এদিকে মনোযোগ দিতে হবে সবচেয়ে বেশি।'
ব্যাংক কমিশন গঠনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর ঠিক করতে না পারলে সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যবসা ও বিনিয়োগ-সবই নষ্ট হবে। আর্থিকখাতের পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তখন তা ঠিক করা আরও কষ্টকর হবে।'
ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানোর পাশাপাশি সারাদেশের ভোক্তাদের স্থিতিশীল মূল্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে 'প্রাইসিং পলিসি ফর অল দ্য এডিবল গুডস' প্রণয়নের সুপারিশ করেন তিনি।
'আমি পারসোনালি মনে করি, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ঠিক না। সরকার অনেক জায়গায় ব্যয় কমাতে পারে। এডিপিতে এতো প্রকল্প কেন? ১৫০০ প্রকল্প কেন? মোটা চাল সরুকরণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এগুলো তো বেসরকারিখাতের কাজ। হাস্যকর প্রজেক্ট বন্ধ করুন, প্রজেক্ট কমান', যোগ করেন সালেহউদ্দিন।
পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে, ডলার সংকট দূর করার উদ্যোগ থাকতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ডলার সংকট সমাধানের উপায় হতে পারে না।'
তিনি বলেন, 'অর্থনীতিতে মন্দাভাব আছে। ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের মুনাফা কমছে। কিন্তু আইএমএফ এর শর্ত হলো কর-জিডিপি অনুপাত ০.৫% বাড়াতে হবে। কিন্তু কিভাবে?'
বিআইডিএস এর সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী সাহাবুদ্দিনও আগামী বাজেটে কর কমিশন এবং ফাইন্যান্স কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন। এছাড়া, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরকার যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তার বর্ণনাসহ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাজেটে কী পদক্ষেপ থাকছে, তার একটি বিবরণ বাজেট বক্তব্যে রাখার প্রস্তাব করেন তিনি।
কোভিডকালীন প্রণোদনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় আগামী বাজেটে নতুন উদ্যোগ রাখার সুপারিশ করেন বিআইডিএস এর সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, 'ম্যাক্রো ইকোনমি স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কোভিডকালীন সময় থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, যা দূর করতে আগামী বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে।'
যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডে ব্যাংক ধস নতুন করে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সংকেত দিচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে সতর্ক থেকে বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আগামী বাজেটে শিক্ষাখাতে বাড়তি নজর দেওয়ার সুপারিশ করেন সাবেক অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক। তিনি বলেন, নতুন সিলেবাস শিক্ষার্থীদের অংক ও বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেন তিনি।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, এবারও বাজেটের আকার জিডিপির ১৫% হচ্ছে। অথচ বাজেটের আকার বাড়ানো দরকার। কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে। ট্যাক্স, নন-ট্যাক্স রেভিনিউ এবং বৈদেশিক ঋণ- এই তিনটি উৎস থেকেই বাড়তি অর্থায়ন সম্ভব।
'এলডিসি গ্রাজুয়েশন সামনে রেখে আমদানি শুল্ক থেকে আয় কমবে। এ অবস্থায় প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। সরকার প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করলেও এক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। উৎসে কর হিসেবে যেসব টাকা ব্যাংক কেটে রাখে, তা ঠিকমতো সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে দেখতে হবে', জানান তিনি।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত বৈষম্য কমাতে ধনীদের উপর বাড়তি করচাপ প্রয়োগের পরামর্শ দেন।