রপ্তানি, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে স্বস্তি
অস্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুটি উৎস প্রবৃদ্ধি দেখেছে। এই প্রবৃদ্ধি এমন সময় এল যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে এবং টাকা দরপতনের চাপে রয়েছে।
রোববার প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়কালে দেশের পণ্য রপ্তানি ৮.০৭ শতাংশ বেড়ে ৪১.৭২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও, একই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪.৮৩ শতাংশ বেড়েছে। এ নয় মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬.০৩ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রবৃদ্ধি মুদ্রাকে স্থিতিশীল এবং আগামী মাসগুলোতে ব্যালান্স অভ পেমেন্টের অবস্থা ভালো করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এমরানুল হক বলেন, অর্থবছরের শেষ নাগাদ ব্যালান্স অভ পেমেট ও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে উন্নতি দেখবেন বলে আশা করছেন তিনি।
এমরানুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত কয়েক মাস ধরে আমরা দেখছি আমদানি ও রপ্তানি কমে গেছে। পেমেন্টের চাপও ছিল বেশি।'
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো আগের তুলনায় এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে আগামী মাসগুলোতে ব্যাংকিং খাতে 'ক্যাশ পজিশন'-এরও উন্নতি হবে বলে আশা করছেন তারা।
'কয়েক মাস পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যালান্স অভ পেমেন্ট, বা বাণিজ্য ভারসাম্য ভালো অবস্থায় আসতে পারে,' বলেন তিনি।
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও চড়া মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও বেড়েছে রপ্তানি
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেলেও সার্বিক চিত্র বলছে, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৮.০৭ শতাংশ।
এই প্রবৃদ্ধি এসেছে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের ওপর ভর করে। ইপিবির তথ্যানুসারে, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আরএমজি খাতের রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২.১৭ শতাংশ বেড়ে ৩৮.২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে মার্চে রপ্তানি ২.৪১ শতাংশ কমে ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অবশ্য এবারও এই ঘাটতি পূরণে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির নির্ভরযোগ্য পুরনো ত্রাতা পোশাক খাত।
গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে, কোভিড মহামারির মধ্যে, মোট রপ্তানি ছিল ৩৮.৬১ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৩.৪১ শতাংশ।
এদিকে আরএমজি খাত ছাড়া অন্যান্য প্রায় সব প্রধান খাতেই চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি ২৫.৭৩ শতাংশ কমে ৮৫৯.৯৪ মিলিয়ন ডলার, পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানি ২১.২৩ শতাংশ কমে ৬৯৮.৭ মিলিয়ন ডলার, কৃষিপণ্যের রপ্তানি ২৮.৩১ শতাংশ কমে ৬৮৭.০৯ মিলিয়ন ডলার এবং প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি ৩৩.৬৫ শতাংশ কমে ৪০০.২৮ মিলিয়ন ডলার হয়েছে।
তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ২.৫৬ শতাংশ বেড়েছে।
এই কঠিন অর্থনৈতিক সময়ে পোশাক খাত সাফল্যের গল্প লিখতে পেরেছে দূরদর্শিতার জন্য।
কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করলে গার্মেন্টস মালিকরা তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন। অর্থনীতির অবস্থা যখন ভালো ছিল, তখন গার্মেন্টস মালিকরা তাদের সক্ষমতা প্রায় ২০ শতাংশ বাড়িয়েছেন বলে জানান শিল্পসংশ্লিষ্টরা।
ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের সিইও এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, 'আমাদের সামর্থ্যের তুলনায় অর্ডার পেয়েছি কম। কিন্তু ক্রমবর্ধমান সক্ষমতা আমাদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। নিটওয়্যার খাত এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।'
নিটওয়্যারের ভালো পারফর্ম্যান্স
পণ্যভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নিটওয়্যার গত তিন প্রান্তিকে ভালো পারফর্ম করেছে। পাশাপাশি গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে এ খাতের রপ্তানি ১.৩২ শতাংশ বেড়ে ২.০৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
অন্যদিকে ওভেন পণ্য রপ্তানিতে এ সময় ৩.৬১ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময় ১.৮১ বিলিয়ন ডলারের ওভেন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। মার্চ মাসে সামগ্রিক পোশাক রপ্তানিতে এটি নেতিবাচক ১.০৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিকেএমইএ সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। তবে নিটওয়্যার খাতের পারফরম্যান্সের কারণে বাংলাদেশ ভালো করতে পেরেছে।'
নিটওয়্যার কেন এত ভালো পারফর্ম করেছে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেক ক্রেতা বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক চীন থেকে সরে বাংলাদেশে চলে এসেছে।
'একইসঙ্গে বাংলাদেশও নিটওয়্যারে পণ্যে বৈচিত্র্য আনার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। এখন ৩ থেকে ৫ শতাংশ নিটওয়্যারে ম্যানমেড ফাইবার (কৃত্রিম তন্তু) ব্যবহৃত হয়। এতে তুলার ওপর নির্ভরতা কমছে। আমাদের কারখানাগুলোতে আমরা ৩০ শতাংশ ম্যানমেড ফাইবার ব্যবহার করছি,' ফজলে এলাহী এহসান বলেন।
এহসান জানান, তাদের কাছে অনেক ক্রেতা তথ্য জানতে চাইছে, ভবিষ্যতে এসব তথ্যানুসন্ধান (ইনকোয়্যারি) থেকেও কার্যাদেশ আসবে বলে তিনি আশা করছেন। 'গত কয়েক মাস ইনকোয়্যারি একেবারেই কম ছিল,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'যেহেতু ইনকোয়্যারি কম ছিল, তাই বেশিরভাগ কারখানাই ৫০-৬০ শতাংশ সক্ষমতায় চলেছে। তবে এখন ইনকোয়্যারি বাড়াটা ভালো লক্ষণ। এসব ইনকোয়্যারির সুফল পেতে আমাদের তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করতে হবে।'
তিনি বলেন, বেশিরভাগ কারখানাই কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে। এছাড়া মার্চের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির প্রভাব আরও দুই মাস থাকতে পারে।
'আমরা আশঙ্কা করছি, বেশ কয়েকটি কারখানা আর্থিক সমস্যায় পড়বে। শ্রমিকদের বোনাসসহ তাদের মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে ঋণের জন্য আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যেতে হতে পারে। আর্থিক সমস্যার কারণে কারখানায় কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে তা নজরদারি করার জন্য আমরা ছয়টি মনিটরিং টিম গঠন করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা এমন কোনো পরিস্থিতির খবর পাইনি।'
৬ মাস পর ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠালেন প্রবাসীরা
ব্যাংকগুলো ডলারের দাম বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দেওয়ায় ছয় মাস পর মার্চে ২ বিলিয়ন রেমিট্যান্স আয় এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, মার্চে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ আগের মাসের চেয়ে ২৯.২৯ শতাংশ বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসী আয় এসেছিল ১.৫ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাফেদা ডলারের দর ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও, ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা দর দেওয়ার ফলেই ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১০৮ টাকা থেকে কমিয়ে ১০৭ টাকা করার পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টায় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
রোববার ব্যাংকারদের বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর চাহিদা কমাতে আমরা কাজ করছি। এই চাহিদা সাধারণত তৈরি হয় আন্ডার-ইনভয়েসিং থেকে। আমরা যদি আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার-ইনভয়েসিং কমাতে পারি, তাহলে হুন্ডিও বন্ধ করতে পারব।'
'আমরা ব্যাংগুলোকে বাফেদা-নির্ধারিত রেটে ডলার কেনার পরামর্শ দিয়েছি। আমরা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চাই। কাউকে যদি বেশি রেট দিতে দেখা যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে,' বলেন তিনি।