করোনা, যুদ্ধ, ঋণ ফাঁদে বাড়ছে কোম্পানির মালিকানা বদল
তিন বন্ধু আকমল হোসেন, আহসান হাবীব ও ইমরান আহমেদ ২০১১ সালে 'গ্রিন সাপ্লায়ার লিমিটেড' নামে একটি কোম্পানি খুলে করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় খাদ্য উৎপাদনের বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করে সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। কোম্পানিটির প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা। ৫ বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে গ্রিন সাপ্লায়ারের বার্ষিক টার্নওভার দাঁড়ায় প্রায় ২০০ কোটি টাকায়। সবকিছু ভালোই চলছিল।
কিন্তু ব্যাংঋণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে তিন বন্ধুর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় ২০১৬ সালে। তাদের দুজন কোম্পানির সব শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ চেয়ে মামলা করেন। কিন্তু রায় তাদের বিরুদ্ধে যায়। মামলায় জেতেন ইমরান আহমেদ। কোম্পানির সব শেয়ার চলে যায় তার হাতে। পরে ইমরান কোম্পানি পুনর্গঠন করেন।
কিন্তু এর পরই ইমরানের শেষের শুরু হয়ে গেল। তিনি একা একা ব্যবসা ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারছিলেন না। এর মাঝে ২০২০ সালে কোভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তার ব্যবসার পরিসর আরও ছোট হয়ে আসে। এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে কাঁচামাল আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
৫০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধের জন্য আরেক কোম্পানি 'লিংকভিউ লিমিটেড'-এর কাছে নিজের ব্যবসা বিক্রি করে দিতে হয় ইমরানকে। গত নভেম্বরে প্রায় ১০৬ কোটি টাকা মূলধনের কোম্পানিটির হস্তান্তর সম্পন্ন হয়।
অর্থনৈতিক সংকটের শিকার
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এরকম মালিকানা বদলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অনেক ছোট ও মাঝারি কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনায় জটিলতায় পড়ায় নিজেদের ব্যবসা বিক্রি করে দিচ্ছে অথবা বড় কোম্পানি সেগুলো অধিগ্রহণ করছে।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) বলছে, গত বছর যেসব কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে, তার মধ্যে আমদানিনির্ভর কোম্পানির পরিমাণ বেশ উল্লেযোগ্য।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে তাদের পণ্যের চাহিদাও অনেকটা কমে এসেছে।
এছাড়াও চলমান সংকটে ব্যাংকের থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে ছোট ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হচ্ছে বলে জানান তারা।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেসব কারণে কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন বেড়েছে, এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো ছোট ব্যবসয়ায়ীদের ঋণের ফাঁদে পড়া। একটি কোম্পানির মালিকানা যখন পরিবর্তন হয়, তখন যে ব্যক্তি বা কোম্পানি ওই কোম্পানিকে টেক-ওভার করে তাদের ঋণের দায়ও তারা নেয়।
আরজেএসসির তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে ১৩ হাজার ৪৫২টি কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মার্চ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৭১ টি কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে।
মালিকানা পরিবর্তন হওয়া এই কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ছিল প্রায় ২৩ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা।
মালিকানা বদলে নতুনভাবে যাত্রা করেও ভালো ফল পাওয়া যায়
আরজেএসসির রেজিস্ট্রার শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সম্ভবত ছোট কোম্পানিগুলো ব্যবসা করতে না পারায় অবসায়ন ও মালিকানা পরিবর্তনের পরিমাণ বেড়েছে।
তবে তিনি মালিকানা পরিবর্তনের ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন না। শোয়েবুল বলেন, কোম্পানিগুলো নতুন মালিকানায় চলে যাওয়ার পরেও তারা নতুনভাবে ব্যবসা চাঙা করবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব ফেলবে।
তবে ঢাকা চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সমীর সাত্তার বলেন, ছোট কোম্পানিগুলো বড় কোম্পানির হাতে যাওয়ায় তারা ভালো ব্যবসা করতে পারবে সত্য। কিন্তু মালিকানা পরিবর্তন হওয়া কোম্পানিগুলোর পুরোনো মালিক, পরিচালক বা অংশদারীরা ব্যবসা করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, 'এই মানুষগুলোও দেশের অর্থনীতির অংশ। ছোট কোম্পানিগুলো যাতে তাদের ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে, সেজন্য সরকার ও বিভিন্ন বাণিজ্যভিত্তিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।'
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কোম্পানি ও ব্যবসায়ীর সংখ্যার পাশাপাশি ব্যবসার পরিধি বাড়ছে, তাই অনেক পুরোনো কোম্পানি মালিকানা হস্তান্তর করছে।
তিনি অবশ্য বলেন, ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলো যাতে ভালোভাবে চলতে পারে সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মালিকানা বদলের অপেক্ষায় আরও কোম্পানি
আরজেএসসি সূত্রে জানা গেছে, আরও প্রায় ৩০৮টি কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এসব কোম্পানির মোট মূলধন প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
মালিকানা হস্তান্তর করতে চাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে—অ্যামেজিং ফ্যাশন লিমিটেড, স্টার অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, সেফকো লজিস্টিক অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, ওশেন রিচ গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ কোম্পানি লিমিটেড, কে হামিদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, গ্লোবাল কমার্শিয়াল কোম্পানি লিমিটেড, রিলায়েবল পাওয়ার সোর্স কোম্পানি লিমিটেড এবং গাসকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল সার্ভিস কোম্পানি লিমিটেড।
অ্যামেজিং ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুর রশিদ দুলাল টিবিএসকে বলেন, তারা শার্ট ও প্যান্ট তৈরি করে সারা দেশে বিক্রি করতেন। কিন্তু ব্যবসায় দীর্ঘদিন মন্দা থাকায় তিনি প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
কোম্পানি অধিগ্রহণে আগ্রহ বেশি কেন
রপ্তানিমুখী পোশাক কোম্পানি মিলেনিয়াম ফ্যাশন লিমিটেড ৫৫ কোটি টাকায় অ্যামেজিং ফ্যাশনকে অধিগ্রহণের জন্য চুক্তিতে পৌঁছেছে। মিলেনিয়াম ফ্যাশনের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, তার কোম্পানি বিদেশে পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করার লক্ষ্যে কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করেছে।
এ সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, নতুন কোম্পানি শুরু করায় অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে। এছাড়া নতুন কারখানায় নতুন জনবলের প্রয়োজন পড়ে।
তবে ইতিমধ্যে চালু রয়েছে এমন একটি কোম্পানি অধিগ্রহণ করে এই ঝামেলাগুলো এড়ানো যেতে পারে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, একটি পুরোনো কোম্পানির বাজারে গ্রহণযোগ্যতাও থাকে। ফলে ওই কোম্পানির নামে ব্যবসা পরিচালনা করা সহজ হয়।