কর্মসংস্থান তৈরিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট কতটা কার্যকর?
বৃহস্পতিবার (১ জুন) সংসদে পেশকৃত বাজেট বক্তৃতায় 'কর্মসংস্থান' শব্দটি ৬৪ বার এবং 'চাকরি' শব্দটি ১২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি শব্দই মূলত অন্যান্য বিষয় নিয়ে বলায় সময়ই ব্যবহৃত হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেবল কর্মসংস্থান সংকট মোকাবেলার বিষয়টি উঠে আসে।
কর্মসংস্থান তৈরির মূল পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য নতুন গন্তব্য অন্বেষণ, দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখা ইত্যাদি।
কিন্তু এগুলোই কি যথেষ্ট? স্টেকহোল্ডার ও বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রিসার্চ ডিরেক্টর খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়টি এবারের বাজেটে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বেকারদের জন্য বিশেষ করে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেই। আমরা কেবলমাত্র পুরনো উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতার কথা শুনেছি। এসব মোটেও যথেষ্ট নয়।"
তিনি টিবিএসকে বলেন, দ্রুত কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ ছিল সরকারের, কিন্তু তা হয়নি।
গত মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, ২০২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৫৯ মিলিয়নে, যা ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল ২.৩২ মিলিয়ন। সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে বেকারত্বের হার ৩.৫১%।
দেশের শ্রমশক্তিকে বর্তমানে রয়েছেন আনুমানিক ১৪৪.৭ মিলিয়ন মানুষ। এরমধ্যে ৭৩.৬ মিলিয়ন কায়িক পরিশ্রম বিষয়ক কাজে নিযুক্ত, এবং প্রশাসনিক ও নির্বাহী পজিশনে কর্মরত ৭১.১ মিলিয়ন মানুষ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর সেলিম রায়হান বলেন, "আমার মতে, এবারের বাজেট বক্তৃতায় কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়ে তেমন জোরালো আলোচনা হয়নি। এবার কিছু উইশফুল থট ছিল কেবল।"
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাজেটে কর্মসংস্থান সম্পর্কিত বিষয়গুলো নতুন বা চিত্তাকর্ষক নয়।" দেশের অর্থনীতি সঠিক আকারে না আসা পর্যন্ত কর্মসংস্থান তৈরির চ্যালেঞ্জ চলতে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
"বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি মূলত বেসরকারি খাতের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু এ খাতে আমি খুব আশাবাদী নই। বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের দ্রুত বৃদ্ধির আশা করা হয়েছে। কিন্তু আগামী বছর এই নাটকীয় অগ্রগতি ঠিক কীভাবে ঘটবে তা ব্যাখ্যা করা হয়নি," বলেন তিনি।
বেসরকারি খাতে প্রধান অর্থায়ন আসে ব্যাংক থেকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "যেহেতু সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে বড় পরিমাণে ঋণ চায়, তাই বেসরকারি খাত কম পরিমাণে ঋণ নিতে পারবে," তিনি যোগ করেন।
সরকার অনুমান করছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপি'র ২৭.৪% হবে, যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই বিনিয়োগ ছিল ২১.৮%। এর অর্থ হলো, বেসরকারি বিনিয়োগে অতিরিক্ত ৪,০৪,০৯৭ কোটি টাকা বা ৪১.৮% বৃদ্ধি প্রয়োজন।
"ব্যক্তিগত বিনিয়োগের পরিসংখ্যান কি উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে মেলে?" প্রশ্নটি সিপিডি তার বাজেট পর্যালোচনায় তুলে ধরে। তারা বলে, আগের অর্থবছরের তুলনায় এবারও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব আছে। এসব উৎসে সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে।
এছাড়াও, রাজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আইএমএফ আরোপিত শর্তের কারণে বেসরকারি খাত থেকে ট্যাক্স প্রণোদনা অপসারণ নিয়ে চাপ রয়েছে, যার ফলে কমতে পারে কর্মসংস্থান- বলছে সিপিডি।
বাজেট নথি অনুসারে, যে মন্ত্রণালয়গুলো বেশিরভাগ কর্মসংস্থান তৈরি ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কাজ করে তাদের বরাদ্দ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর মধ্যে কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২৪% কমেছে। একইসাথে যুব মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমেছে ২২% এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের কমেছে ৩২%। শুধুমাত্র বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ৩৯% বেড়েছে।
ডিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, "আমরা এবারের বাজেটে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য বড় উদ্যোগ এবং দক্ষতা উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ানোর আশা করেছিলাম, কিন্তু তা আর হয়নি।"
"আইটি দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়টি কেবল নতুন, বাকিসব আগের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া নিয়েই। আমার মতে এগুলো শুধু দেখানোর জন্যই," টিবিএসকে বলেন তিনি।
"এমনকি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বৃদ্ধির জন্য কোন উল্লেখযোগ্য সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়নি বাজেটে," যোগ করেন তিনি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সাবেক পরিচালক (প্রশিক্ষণ) নুরুল ইসলাম মনে করেন, কর্মসংস্থান তৈরির জন্য বরাদ্দের চেয়ে সরকারের প্রতিটি স্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
"আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। আসলে বাজেট চাইলেই পাওয়া যায় কিন্তু উদ্যোগ কম," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) এর মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, দেশে দক্ষতা উন্নয়ন এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দ্রুত বেকারত্ব কমানোর সুযোগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "বিদেশী কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের অভিজ্ঞ লোক দরকার। প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। বাংলাদেশ থেকে যে জনশক্তি উৎপাদিত হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। সারাবিশ্বে দক্ষ লোকের প্রয়োজন, কিন্তু আমরা সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছি না।"
বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকার ২,৩৫,০০,০০০ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালে মোট চাকরির সংখ্যা ৭,১১,০০,০০০ ছিল বলে অনুমান করা হয়েছে।
"আইটি, ফ্রিল্যান্সিং, সফ্টওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার শিল্প, বিপিও, ই-কমার্স, রাইড শেয়ারিং, ফিনটেক, এডু-টেক এবং ইন্টারনেট পরিষেবা খাতে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সংখ্যা বাড়ানো হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৩০ লাখ হবে," বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।