উৎপাদন থেকে বিক্রি পর্যন্ত স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা চান ডিম, মুরগির উৎপাদনকারীরা
ডিম, মুরগির উৎপাদন খরচ থেকে শুরু করে কোন ধাপে কত দামে বিক্রি হওয়া উচিত আর আসলেই কত দামে বিক্রি হচ্ছে তার একটা স্বচ্ছতা দরকার। খাতের উন্নয়নে তাই স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার দাবি জানিয়েছেন ডিম-মুরগির উৎপাদনকারীরা। স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা থাকলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করা সহজ হবে না বলেও মনে করেন তারা।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম অডিটরিয়ামে 'পোল্ট্রি শিল্পে সংকট: প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষা ও ডিম-মুরগির উৎপাদন খরচ হ্রাসে করণীয়' শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অর্থনীতি-বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, "ব্যবস্থাপনাটা এমন হতে হবে যাতে খামারিদের দীর্ঘ সময় ধরে লোকসান করতে না হয়। তাহলে হঠাৎ করেই বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয় সেটা বন্ধ হতে থাকবে। এই ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছে, প্রতি মাসে প্রান্তিক খামারি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক খামারি সবাইকে নিয়ে খরচগুলো দেখছে, পর্যালোচনা করছে।"
শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, "২০২২ ও ২০২৩ সালের বেশিরভাগ সময় ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী খামারিরা লোকসান করেছেন, উৎপাদন খরচের চেয়েও কম মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। মধ্যস্বত্ব ভোগীরা অনায্য মুনাফা করেছে, অথচ খড়গ নেমেছে উৎপাদকদের উপর।"
মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে জানিয়েছে।
শামসুল আরেফিন খালেদ উৎপাদন খরচ কমানোর বিষয়ে বলেন, 'ফিডের কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলো ভারত ব্যবহার করছে, তাদের নিজস্ব উৎপাদন রয়েছে। এর আগে ফিডের দাম ৩-৩.৫ টাকা কমানো হয়েছে। এই বিকল্প উপকরণগুলো যদি এসআরও ভুক্ত করে বিনাশুল্কে আমদানি করতে দেওয়া হয় তাহলে ফিডের দাম আরও তিন টাকা পর্যন্ত কমতে পারে, যা প্রতিটি ডিমের দাম ১-১.৫ টাকা পর্যন্ত কমাবে। আমরা এনবিআরকে বিষয়টি জানিয়েছি, ডিএলএসও এ নিয়ে কাজ করছে।"
ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি কাজী জাহিন হাসান বলেন, "প্রতিনিয়ত চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে অনুপাতে উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রতিবছরই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অপপ্রচার করে খামারি ও কর্পোরেটদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। এতে করে সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।"
কাজী জাহিন হাসান বলেন, ডিম-মুরগি আমদানি করা হলে তাতে দেশেরই ক্ষতি হবে। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা ১.৭০ কোটি থেকে কমে ১.৩০ এ নেমেছে। লেয়ার মুরগির চাহিদা ১১ লাখ থেকে কমে সাড়ে ৯ লাখে নেমেছে।
বিএবির সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, "ডিম ও মুরগি একই দিনে একই মার্কেট এবং দেশের বিভিন্ন মার্কেটে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। যেখানে ক্ষুদ্র খামারিরা প্রধান উৎপাদক সেখানে সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়। একসময় বলা হয়, কাজী ফার্মস, প্যারাগন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, অথচ এবার ডিমের মূল্য বৃদ্ধির সময় এই প্রতিষ্ঠানগুলো দাম না বাড়ালেও বাজারে দাম বেড়েছে।"
উৎপাদনকারীরা বলছেন, ৮৫% উৎপাদন আসে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে, বাকিটা কর্পোরেট পর্যায়ে হয়।
ডিম ও মুরগির মূল্য বৃদ্ধির পেছনে ফিডের ভূমিকা রয়েছে। কারণ ডিম ও মুরগির উৎপাদন খরচের ৭৫-৮০ শতাংশই ফিডের খরচ।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, "ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ভু্ট্টা, সয়াবিন মিল সহ ফিড তৈরির অন্যান্য উপকরণ ও ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা দুরূহ, চট্টগ্রাম কাস্টমসে উচ্চহারে শুল্কায়ন, পণ্য খালাসে জটিলতা ব্যয় বাড়াচ্ছে। কারণ একটা ফিড তৈরিতে ৬০-৭০টি উপকরণ ব্যবহার করতে হয়, যার ৭০ শতাংশই আমদানি নির্ভর।"
তিনি আরও বলেন, "দুইশোর বেশি নিবন্ধিত ফিড মিল রয়েছে। এখন চালু রয়েছে মাত্র ৬৫-৭০টি। বাকিগুলো বন্ধ, কারণ তারা লোকসান করতে করতে টিকতে পারেনি।"
কমতে শুরু করেছে ডিমের দাম
ক'দিন আগে কর্পোরেট উৎপাদনকারীরা যে ডিম ১১.৪০ টাকায় বিক্রি করেছে সেটা এখন ১০.৯০ টাকায় নেমেছে। ঢাকার সেগুনবাগিচায় পাইকারী ডিম বিক্রেতারা বলছেন, তারা প্রতিটি ডিম ১২.৩০ টাকায় বিক্রি করছেন, যা দুই-তিন দিন আগেও ১৪.২০ টাকায় বিক্রি করেছেন।
তবে খুচরা বাজারে দামটা ধীরে ধীরে কমছে। প্রতি ডজন ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া ডিম এখন ১৬০-১৬৫ টাকায় নেমেছে।
এদিকে সুপারশপগুলোতে এখনও বেশি দামে ডিম বিক্রি করতে দেখা গেছে। স্বপ্ন সুপারশপে প্রতিটি ডিম ১২.৯২ টাকা এবং আগোরাতে একেকটি ডিম ১৪ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়াও মীনা বাজার প্রতিটি ডিম ১২ টাকায় বিক্রি করছে।