৩ মাসে বৃদ্ধি পাওয়া খেলাপি ঋণের ৯৩ শতাংশই মাত্র ১১ ব্যাংকের
দেশের ব্যাংকিংখাতে চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪,৪১৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৯৩ শতাংশ খেলাপি ঋণই মাত্র ১১টি ব্যাংকের।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত পূরণের মধ্যে ব্যাংকগুলোর অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে এমনটিই জানিয়েছে তারা। কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে তা নির্ধারণে বিশেষ তদারকি জরুরি বলেও মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এ বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রেকর্ড করেছে অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী, এবি, আইএফআইসি, মার্কেন্টাইল, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১০টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন মাসে বেড়েছে ৪০০ কোটি টাকা থেকে প্রায় ১,৮০০ কোটি টাকা
এছাড়া, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের একাই খেলাপি ঋণ বেড়ছে ১৩,৬৫৫ কোটি টাকা। এতে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮,৫৪২ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৩২.৬৪ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি বেড়েছে এবি ব্যাংকের ১,৮৮৩ কোটি টাকা। এরপরে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১,৬১৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকে ঋণ পরিশোধের বিশেষ ছাড়া তুলে নেওয়া হয়, যা কোভিডের পর থেকে পাওয়া যাচ্ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ব্যাংকিং খাতের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এজন্য মূলত দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়নীতি।
তিনি বলেন, "এ রকম যত সুবিধা দেওয়া হবে খেলাপি ঋণ ততই বাড়বে। পুনঃতফসিল ঋণও এখন খেলাপি হচ্ছে।"
"এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল পলিসি। পুনঃতফসিল সুবিধা না দিয়ে সরাসরি খেলাপি করার বার্তা দেওয়া উচিত ব্যাংকগুলোকে। সেটি না করে আরও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার বেড়েছে," যোগ করেন তিনি।
সাবেক গভর্নর আরও বলেন, "পৃথিবীর অন্যান্য দেশে খেলাপি হলে ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন সেবা ও ব্যাংকের বিভিন্ন সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি, বিমান বা মেট্রোতেও চড়াতে দেওয়া হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, তার উল্টো চিত্র। যারা আইন কানুন মানেন না, তাদেরই আরও সুবিধা দেওয়া হয়।"
"গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এটা মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। খেলাপি ঋণ কমাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জোর দিতে হবে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে ব্যাংকররা বলছেন, বৈশ্বিক র্অথনৈতিক মন্দার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা ধীরগতিতে রয়েছে; যার কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।
বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। তিনমাসে একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে, যার কারণে সামগ্রিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশকে আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিলের মঞ্জুরকৃত ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তির অন্যতম শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। অথচ খেলাপি ঋণ কমার বদলে ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭৪,৪৫৪ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৫ শতাংশ।
এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৭৩,৬৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬.৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে, বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩১৯৬ কোটি টাকা; এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪.৮০ শতাংশ।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলেছে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে তারা সমস্যায় ভোগা ব্যাংকগুলোর সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে এবং সংকট মোকাবেলায় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিদর্শন জোরদার করে নিয়মনীতিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রম্পট কারেকশন অ্যাকশন (পিসিএ) সংক্রান্ত নির্দেশিকাও জারি করা বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই নির্দেশিকার জারি হলে, বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঘিরে দ্রুত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০.১১ শতাংশ।
গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বা ৮.৮০ শতাংশ। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ১ লাখ ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকাই শীর্ষ ১০ ব্যাংকে রয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ক্লাসিফায়েড (শ্রেণীবদ্ধ) ঋণের ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটেছে।
তিনি বলেন, "আমি অনেক আগেই বলেছিলাম যে, আগামী দিনে আমাদের ক্লাসিফায়েড লোন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এর একটি কারণ হলো– ক্লাসিফায়েড লোনে ডেফারাল এবং পুনঃতফসিলের সুবিধা। এসব সুবিধার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। তাই ঋণ পুনঃশ্রেণীবদ্ধ হওয়ার ফলে মোট শ্রেণীবদ্ধ ঋণ বা ক্লাসিফায়েড লোনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।"
এই শ্রেণীবদ্ধ ঋণের একটি বড় অংশ ইচ্ছাকৃত খেলাপি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, "আমাদের শ্রেণীবদ্ধ ঋণের একটি বড় অংশই ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের ঋণের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করলেও খুব বেশি কিছু করতে পারছে না।"