শীঘ্রই বাজারভিত্তিক সুদহার, ইঙ্গিত গভর্নরের
ঋণের সুদহার 'খুব শীঘ্রই' সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক ব্যবস্থায় চলে যাবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
'আমি মনে করি, আমরা বাজারভিত্তিক সুদহারের খুব কাছাকাছি। আশা করছি যে, খুব শীঘ্রই আমরা একটি সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থায় চলে যাব,' রোববার (৫ মে) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
'ফার্স্ট ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ঢাকা ২০২৪' শীর্ষক দুইদিনব্যাপী এক কনফারেন্সের প্রথম দিনে 'ফিসক্যাল অ্যান্ড মানিটরি পলিসিস ইন দ্য ইভলভিং ইকোনোমিক অর্ডার' শীর্ষক অধিবেশনে গভর্নর বলেন, 'সুতরাং, সুদের হারের ওপর আর কোনো সীমাবদ্ধতা থাকবে না। ব্যাংকগুলো সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সুদহার নির্ধারণের স্বাধীনতা পাবে।'
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি পর্যালোচনা মিশনের বাংলাদেশ সফরে মাঝে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এমন মন্তব্য করলেন। মিশনটি বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছে এবং দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা পর্যবেক্ষণ করছে।
বাজারভিত্তিক সুদহার বাস্তবায়ন করা, বিনিময় হারের জন্য একটি ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা অবলম্বন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি নির্দিষ্ট স্তরে বজায় রাখা হলো আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শর্ত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান অধিবেশনের সভাপতিত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ফজলে কবিরসহ সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক ও মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী প্যানেল বক্তা হিসেবে ছিলেন।
'কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোটেও সরকারি ট্রেজারি বন্ড বা বিল কিনছে না। আমরা এখন স্মার্ট (ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড় হার) নামক একটি রেফারেন্স রেট অনুসরণ করছি, কারণ কয়েক বছর আগে এটি ৯ এবং ৬ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল,' গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন।
বিনিময় হারের জন্য ক্রলিং পেগ প্রবর্তনের বিষয়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আমরা বর্তমানে বিনিময় হার পর্যালোচনা করছি এবং ক্রলিং পেগ প্রবর্তনের জন্য কাজ করছি। এটি বাজারভিত্তিক সুদহারে সম্পূর্ণরূপে রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।'
গভর্নর বলেন, দেশের এক্সটার্নাল ব্যালেন্স ভালোভাবে চলছে, রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
'আমরা আমদানি কমিয়েছি, কারণ আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হয়েছিল। তাই আমাদের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে, বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় এবং কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি। গত চার বা পাঁচ মাস ধরে চলতি হিসাব ইতিবাচক, কিন্তু আমাদের আর্থিক হিসাব এখনও নেতিবাচক অঞ্চলে রয়েছে,' তিনি আরও বলেন।
'গত কয়েক মাস ধরে, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলে আমাদের আর্থিক হিসাব নেতিবাচক থাকলেও চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তের পাশাপাশি আমাদের লেনদেনের ভারসাম্য আদতে ইতিবাচক। আমরা কম চাপ অনুভব করছি এবং আশা করছি বছরের শেষ নাগাদ আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হবে, যা আমাদের লক্ষ্য।'
গভর্নর বলেন, বর্তমানে দেশ দুটি প্রধান সমস্যার মুখোমুখি: মুদ্রাস্ফীতি এবং রিজার্ভ কমে যাওয়া।
'মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছি। আমরা শুধু চাহিদা নিয়ন্ত্রণের দিকেই মনোনিবেশ করছি না, আমরা সাপ্লাই-সাইড ইন্টারভেনশন নিয়েও উদ্বিগ্ন,' তিনি বলেন।
'সুদব্যয় বাদ দিলে যে প্রাথমিক ঘাটতি, তা মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সুতরাং, আমাদের রাজস্ব ঘাটতি তেমন বেশি নয়। তবে, আমি মনে করি আগামী অর্থবছরে এটি আরও কমিয়ে ২ দশমিক ৪ থেকে আড়াই শতাংশ করা হবে। যেহেতু অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার খরচ বেশি, তাই আমাদের সুদ পরিশোধের হিসাব প্রতি বছর বাড়ছে। তবে আমি বিশ্বাস করি রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আছে। জিডিপির আড়াই শতাংশ রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণসাধ্য,' তিনি আরও বলেন।
'তবে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত না বাড়ানোর কোনো কারণ নেই। বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ শুধু প্রত্যক্ষ কর এবং দুই-তৃতীয়াংশ পরোক্ষ কর। এর মানে দাঁড়ায়, গরিব মানুষেরা আসলে ধনীদের চেয়ে বেশি কর দিচ্ছেন।'
আমদানি কমানোর অসংখ্য নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমদানি কমানোর ফলে সরকারের কর রাজস্ব কমে যায়। একই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগও কমে।'
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির পেছনে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ৪০টি দেশের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি একটি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।
'এটা ধনীদের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে না। তাই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেওয়া উচিত হবে না,' তিনি আরও বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বিভিন্ন চাপের বিষয়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমলাতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে নিজেকে বের করে আনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জিং।
'রাজনৈতিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে বের হওয়া সম্ভব নয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে অবশ্যই এসব মোকাবিলায় আরও দৃঢ়তা দেখাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। এখন সময় এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্ত অবস্থানে যাওয়ার,' তিনি আরও বলেন।
সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১ লাখ কোটি টাকা বেশি। তবে তিনি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রাখার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান।
তিনি বলেন, সংকোচনমূলক আর্থিক নীতিতে সাময়িক চ্যালেঞ্জ থাকলেও তবে এটি ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ ফলাফল দেবে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, 'আমি মনে করি আমাদের বাজেটকে স্রেফ সংখ্যা দিয়ে নয়, জিডিপির শতাংশ হিসেবেও বিবেচনা করতে হবে। সুতরাং, আপনি যদি এটিকে জিডিপির শতাংশ হিসাবে বিবেচনা করেন, তাহলে এটি আসলে এ বছরের বাজেটে এবং সংশোধিত বাজেটেও গত বছরের আকারের চেয়ে ছোট। আমার মনে হয়, সংশোধিত বাজেটে ১৩ বা ১৪ শতাংশের বেশি কাটা হয়েছে। তাই এটি এখন শুরুর তুলনায় আরও সংকোচনশীল।'
সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক বলেন, 'আমাদের দেশে আর্থিক গভীরতা (এম২/জিডিপি) ৪০ শতাংশের কম, যেখানে আমাদের অনেক প্রতিবেশী দেশে এ হার অনেক বেশি। আমাদের মতো একই আকারের অর্থনীতির দেশগুলোতেও এ শতাংশ বেশি।'
আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, 'আর্থিক গভীরতা প্রায় ৩৯ শতাংশ। সেক্ষেত্রে আমরা কীভাবে এটি আরও গভীর করতে পারি? দুটি উপায় আছে: নেট বাহ্যিক সম্পদ বৃদ্ধি বা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধি। তবে আপাতত নেট বাহ্যিক সম্পদ বাড়ানো চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানো আবার মুদ্রাস্ফীতিজনিত প্রভাব ফেলে।'
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মতো সমান অর্থনীতির দেশ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার আর্থিক গভীরতা তাদের জিডিপির প্রায় ১০০ শতাংশের সমান। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে এটি ১৫০ শতাংশ। ভারতের আর্থিক গভীরতা তার জিডিপির প্রায় ৮০ শতাংশ।
'সুতরাং, আমরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি, এবং আমি মনে করি আমাদের রাজস্ব ঘাটতির বিষয়ে অনেক কাজ করার আছে,' তিনি বলেন।
সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎ ও সারের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে, যা বাজারে অর্থ সরবরাহ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বাড়িয়েছে। 'আমাদের এটি বিবেচনায় নেওয়া দরকার, কারণ এটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়,' বলেন তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন তার ব্যালেন্স শীটে সমন্বয় বা সরকারি বন্ড কেনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ করে তখন অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি পায়।
তিনি স্পষ্ট করেন যে, কেবল বন্ড ইস্যু করলে অর্থ সরবরাহ বাড়বে, এমন ধারণা ঠিক নয়।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যার ফলে অর্থ সরবরাহ বেড়েছে মাত্র ৫০ হাজার কোটি টাকা।