২০২৪ অর্থবছরে শরিয়াভিত্তিক তিন ব্যাংকের মাধ্যমেই রেমিট্যান্স এসেছে ৩৬%
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শরিয়াভিত্তিক তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৮.৬৪ বিলিয়ন ডলার— যা এই অর্থবছরের দেশের ব্যাংকখাতের মোট সংগৃহীত রেমিট্যান্সের ৩৬.১৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ এনেছে ৬.১২ বিলিয়ন ডলার, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ৮৪৪ মিলিয়ন ডলার এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এনেছে ১.৬৬ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছ থেকে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার— যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০.৬৬ শতাংশ বেশি।
২০২৩ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকখাতে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২১.৬১ বিলিয়ন ডলার। সে সময়েও শরিয়াভিত্তিক এই তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স ছিল এসেছিল ৬.৪১ বিলিয়ন ডলার— যা সে সময়ে মোট ব্যাংকখাতের সংগৃহীত রেমিট্যান্সের ২৯.৬৮ শতাংশ ছিল।
ব্যাংকাররা বলছেন, গত দুই বছরে ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স আহরণে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। কয়েকটি ব্যাংক বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর মাধ্যমে তাদের রিপেজেনটেটিভ এর পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। এ কারণে এসব ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স বেড়েছে।
তবে ব্যাংকারদের অনেকের মতে, কিছু কিছু ব্যাংক ডলার মার্কেটের নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনেছেন। বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনেও।
রেমিট্যান্স সংগ্রহে শীর্ষ থাকা ১০ ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি ৩২ শতাংশ
২০২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স সংগ্রহে শীর্ষে থাকা ১০ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪.৯১ বিলিয়ন ডলার— যা ব্যাংকখাতের মোট সংগৃহীত রেমিট্যান্সের ৬২.৩৫ শতাংশ।
এছাড়া, এই ১০টি ব্যাংকের ২০২৪ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ শতাংশ। ২০২৩ অর্থবছরে এই ১০ ব্যাংকের মাধ্যমে ১১.২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১০ ব্যাংকের মধ্যে ২০২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স সংগ্রহের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (১৫০%)। এরপরে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক (১০১%), ব্র্যাক ব্যাংক (৯৪%), জনতা ব্যাংক (৫৭%) এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (৩০%)।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও জাফর আলম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের প্রবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে, আমেরিকা ও ইউরোপে।"
তিনি বলেন, "গেল বছরে আমি রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে গিয়েছি। এসব দেশে আমরা প্রবাসী ভাইদের নিয়ে বসেছি। তারা আমাদের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলা শুরু করেছেন এবং আপনি দেখছেন, আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাচ্ছি।"
"কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দামেই আমরা রেমিট্যান্স কিনেছি। এখন তো ১১৮ টাকার উপরে রেটে কেনার সুযোগ নেই। এর আগে বাফেদা যে দাম নির্ধারণ করে দিত, সেই দামেই ডলার নিয়েছি। আমাদের ডলার পর্যাপ্ত থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই আমাদের মাধ্যমে এলসি খুলেছে। আমরাও তাদের সাপোর্ট দিয়েছি," যোগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের মতে, "ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য অনেক প্রচারণা চালিয়ে গেছে। পাশাপাশি লোকাল মার্কেটে বিনিয়োগ আকর্ষণীয় হওয়া এবং ল' এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির তৎপরতা রেমিট্যান্স বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ডলারের দাম অ্যাডজাস্টমেন্টের প্রভাবও পড়েছে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিতে।"
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, "যেসব ব্যাংক আগে রেমিট্যান্স সংগ্রহে প্রথম দশে থাকত, তাদের অনেকেই শীর্ষে নেই। তাদের কেউ কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দামে ডলার সংগ্রহ করতে গিয়ে পর্যাপ্ত রেমিট্যান্স পায়নি। তবে যার মার্কেট রেটের চেয়ে ৫-৮ টাকা বেশি দিয়ে রেমিট্যান্স কিনেছে, তারাই বেশি রেমিট্যান্স পেয়েছে।"
তিনি বলেন, "গত এক বছর ধরে রেমিট্যান্সের দর ছিল ১১০ টাকার মধ্যে। কোনো কোনো ব্যাংক ১২০ টাকার বেশি রেটেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছিল। এমনকি ইম্পোর্ট পেমেন্ট ১২২-১২৪ টাকায়ও করেছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, অতিরিক্ত দামে ডলার কেনাবেচা করায় ২০২৩ সালে ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরবর্তীতে, অবার দশটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দামের ডলার কেনাবেচার প্রমাণ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন টিম।
এছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের একটি রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংককে বেশি দামে ডলার সংগ্রহের জন্য মৌখিক নির্দেশনাও দিয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের রেটম্যান্স কমেছে ৭১৫ মিলিয়ন ডলার
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদায়ী ২০২৪ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে ৭১৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ৩.৩৯ বিলিয়ন ডলার— যা ২০২৪ অর্থবছরে ২.৬৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ব্যাংকের মধ্যে ৫টি ব্যাংকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বিদায়ী অর্থবছরে কমেছে। তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে জনতা ব্যাংকের ক্ষেত্রে। এই সময়ে জনতা ব্যাংকে রেমিট্যান্স এসেছে ১.০৭ বিলিয়ন ডলার— যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি।
সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে যে ৫ দেশ থেকে
বিদায়ী ২০২৪ অর্থবছরে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে, ৪.৫৯ বিলিয়ন ডলার। এরপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ২.৯৬ বিলিয়ন ডলার; সৌদি আরব থেকে এসেছে ২.৭৪ বিলিয়ন ডলার; মালয়েশিয়া থেকে ১.৬০ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ২.৭৯ বিলিয়ন ডলার।