কম দাম ও অবিক্রিত কাঁচা চামড়া নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা
ঈদুল আযহার প্রায় একমাস পরেও চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে অন্তত তিন লাখ পিস অবিক্রীত চামড়া পড়ে আছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামের কারণে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কা এসব ব্যবসায়ীরা।
এবারের কোরবানি ঈদে সারাদেশ থেকে ৩,৬০,৯০৫ পিস কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। প্রত্যাশা ছিল, ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট চামড়ার জন্য সরকার নির্ধারিত ৫০ থেকে ৫৫ টাকা করে দাম পাবেন। কিন্তু চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে ট্যানারী মালিকদের কাছ থেকে পাচ্ছেন বর্গফুট প্রতি ৩৭ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। ফলে একটি গরুর চামড়া বিক্রিতে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে প্রায় ৩০০ টাকা কম পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
চামড়া ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, এবারের ঈদুল আজহায় সংগৃহীত ৩,৬০,৯৫০ পিস চামড়ার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৮০ হাজার (২২ শতাংশ) পিস চামড়া বিক্রি হয়েছে। সাধারণত কোরবানির ঈদের পর দুই পর্যন্ত সময় লাগে চামড়া বিক্রি হতে। তবে এবার একমাস পেরিয়ে গেলেও অর্ধেক চামড়াও বিক্রি হয়নি। ফলে আবারও প্রক্রিয়াকরণ, গুদামজাতকরণ ও শ্রমিক খরচের চিন্তায় হতাশা প্রকাশ করেছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও একইরকম। এখনও পর্যন্ত অর্ধেক চামড়া বিক্রি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সেইসঙ্গে, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে লোকসানের মুখোমুখিও হচ্ছেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, "আমরা এখন পর্যন্ত মাত্র ৮০ হাজার পিস চামড়া বিক্রি করতে পেরেছি। ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাচ্ছি না। যারা আসছেন, তারাও সরকার নির্ধারিত দর দিচ্ছেন না। প্রতি বর্গফুটে ১২-১৫ টাকা কম পাচ্ছি। এভাবে চামড়া বিক্রি করলে খরচ তুলে আনাও মুশকিল হয়ে পড়বে।"
তিনি আরও বলেন, "অনেক ব্যবসায়ী ধারদেনা করে বিনিয়োগ করেছেন। ন্যায্য মূল্য না পেলে সবাই লোকসানে পড়বে। এ বিষয়ে আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।"
বন্দরনগরীর এক ব্যবসায়ী জানান, প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ২০-২২ বর্গফুট, যা প্রায় ৪০০ টাকায় কেনা হয়। লবণাক্তকরণ, মজুরি এবং স্টোরেজের খরচ যোগ করলে— এর অঙ্ক দাঁড়ায় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। সবশেষে ৯০০-১,০০০ টাকায় বিক্রি করা না গেলে লোকসানের মুখে পড়তে হয়।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, "চট্টগ্রামে আগে অনেকগুলো ট্যানারি ছিল। এখন শুধু রিফ লেদার আছে। তাই আড়তদারদের ঢাকার ট্যানারির ওপর নির্ভর করতে হয়।"
তিনি বলেন, "সরকারের কথামতো আমরা চামড়া কিনেছি। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা যদি আমাদের সহযোগিতা না করেন, তাহলে সরকারের সদয় দৃষ্টি ছাড়া আমাদের আর কি চাওয়ার থাকে?"
চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় চামড়ার আড়ত ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির তথ্যমতে, সংগঠনটির অধীনে ১১২ জন নিবন্ধিত পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ী ছিলেন। এর বাইরেও ৭০ থেকে ৮০ জন পাইকার চামড়া কিনতেন। লোকসান ও প্রতিকূলতায় ব্যবসা ছেড়ে বর্তমানে মাত্র ২৫-৩০ জন ব্যবসায়ী টিকে আছেন।
চট্টগ্রামের একমাত্র ট্যানারি প্রতিষ্ঠান রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড সেলস) মোখলেসুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমরা এখনো পর্যন্ত চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০ হাজার পিস চামড়া ক্রয় করেছি। পর্যায়ক্রমে আরো ৫০ হাজার চামড়া ক্রয় করা হবে।"
ব্যবসায়ীদের সরকার নির্ধারিত দাম না দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "নিশ্চয়ই লোকসান দিয়ে কেউ চামড়া কিনতে চাইবে না। চামড়ার গুণগত মান অনুযায়ী প্রচলিত দাম দিয়েই আমরা চামড়া কিনেছি।"
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির প্রেসিডেন্ট ওমর হাজ্জাজ টিবিএসকে বলেন, "ঈদুল আজহা মৌসুমে চামড়ার পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে চামড়ার কোয়ালিটি ধরে রাখতে না পারা। সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ব্যবসায়ীরা কাঙ্খিত দাম পান না। চামড়া খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানে গেলে আর্থিক ক্ষতি কমে আসবে। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষ নজর দিতে পারে।"
এদিকে, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কর্তৃক গতমাসে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশে এক দশক ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কম।
দীর্ঘদিন ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কম থাকার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয় এ প্রতিবেদনে— একসঙ্গে বিপুল পরিমাণে সরবরাহ, লবণের মূল্যবৃদ্ধি, ভ্যানভাড়া ও ঈদ বোনাস, ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস পাওয়া ও বিপুল সংগ্রহ, ব্যবসায়ীদের তহবিল সংকট, ট্যানারিমালিকেরা সঠিকভাবে অর্থ দেন না, ট্যানারিমালিকদের সিন্ডিকেট এবং বাজার সিন্ডিকেট।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, "ঢাকার আড়তদাররা মোটামুটিভাবে দাম পেলেও ঢাকার বাইরের যারা আছেন, তারা ঠিকমত দাম পাচ্ছেন না এবং তাদের বিক্রিও কম। এখানে একসঙ্গে যোগান বেশি হওয়া এবং ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট, দুটো কারণই বড় ভূমিকা রাখে।"