মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করল বাংলাদেশ ব্যাংক
উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে চলতি বছরে তিনবার নীতি সুদহার বাড়ানো হলো।
আগামী মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) থেকে নতুন সুদের হার কার্যকর হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। রোববার (২৫ আগস্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকাররা বলেন, নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে তারল্যে সংকটে পড়া কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে টাকা ধার করবে, সেটির সুদহার বাড়বে। একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহারও বাড়বে। গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় কমে এলে মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন টিবিএসকে কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ করছে, কারণ মূল্যস্ফীতির মাসিক গড় ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখন লক্ষ্যই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, যার জন্য পলিসি রেট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন, সেগুলো নেওয়া হবে।
এ নিয়ে ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাতবার নীতি সুদহার বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৩ সালের শুরুতে নীতি সুদহার ছিল ৬ শতাংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে অচিরেই সুদের হার বাড়াবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথম দফায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী বা রেপোর সুদহার বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হবে। পরে এ হার আরও বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, ব্যবসায়ীরা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আশ্বস্ত করেছে।
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমান মুদ্রানীতি ঠিকভাবে কাজ করছে। এটি আরও কিছুটা সংকোচন করা হবে; তবে খুব বেশি নয়। যথাযথভাবে চললে সাত থেকে আট মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি ভালো অবস্থায় আসবে। তখন এটি ৫-৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা যায়।'
আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করার আগপর্যন্ত সুদহার বাড়িয়ে যেতে হবে। আমরা এ নীতিতে রয়েছি। পাশাপাশি বর্তমানে মুদ্রার বিনিময় হার যেহেতু মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে, তাই এটিও মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে।'
দেশে টানা কয়েক সপ্তাহব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে গত জুলাইয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে পৌঁছায় মূল্যস্ফীতির হার। এমন সময়ে তা ঘটছে যখন দেশের মুদ্রা রিজার্ভ পড়তি অবস্থার মধ্যে আছে, রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পোশাক শিল্পও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সবশেষ বন্যা পরিস্থিতিতে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত নিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পলিসি রেট বাড়িয়েছে, এটা ভালো দিক। তবে পলিসির রেটের সঙ্গে ফিসকাল পলিসিও গুরুত্বসহ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অ্যাদমিনিস্ট্রেটিভ ও অপারেশনাল কস্ট কমিয়ে আনতে হবে।'
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক ক্যাশ সাপ্লাই কামাতে চাচ্ছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন যেসব অঞ্চল বন্যাকবলিত সেখানে সরকারের ব্যয় বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'এখন মূল্যস্ফীতি কমবে, কারণ নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ার সুযোগ নেই। পণ্য সরবরাহে পথে পথে চাঁদা দিতে হয়েছে, এখন এটাও মোটামুটি কমে যাচ্ছে। যার ফলে ট্রানজেকশনাল কস্ট কমে গেলে পণ্যের দামও ভোক্তা পর্যায়ে কমে আসবে।'
এদিকে স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেটও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) রেট একইভাবে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭.৫০ শতাংশ করা হয়েছে।
তারল্যের প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর স্পেশাল রোপোর নাম পরিবর্তন করে এখন এসএলএফ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর যখন বিশেষ প্রয়োজনে ঋণ দরকার হয়, তখন এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারবে।
এছাড়া যেসব ব্যাংক উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নিতে পারে, সেটা হয়ে থাকে স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির (এসডিএফ) মাধ্যমে ।
একটি তফসিলি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, 'আগে আমাদের মুদ্রানীতি হতো ভলিউম বেইজড। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলো রেপোর মাধ্যমে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিত। এছাড়া ব্যাংকগুলোর ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ও স্ট্যাটাটরি লিকুইডিটি রেশিওর (এসএলআর) রেট বাড়াত। যার ফলে আমাদের অতিরিক্ত ক্যাশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে গিয়ে মার্কেটে ঋণ কমে যেত। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসত।
'এখন আইএমএফের পরামর্শ হচ্ছে ইন্টারেস্ট রেট বেইজড মুদ্রানীতি করা। গত তিনবারের মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ইন্টারেস্ট রেট বেইজড করেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে একদিকে ইন্টারেস্ট বাড়িয়েছে, অন্যদিকে মানি সাপ্লাইও বাড়িয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। যা ছিল হিতে বিপরীত।'
তিনি বলেন, 'এখন ব্যাংকগুলোর বোর্ড রিফরম করা হচ্ছে। আশা করছি নামে-বেনামে ঋণ বের না হলে মানি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।'