বাজারের সব খোলা তেলেই ভেজালের প্রমাণ পেয়েছে খাদ্য কর্তৃপক্ষ
ভোজ্য তেলের বাজারে যেসব খোলা সয়াবিন ও পাম ওয়েল বিক্রি হচ্ছে তার সবগুলোতেই ভেজালের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। যদিও সারাদেশেই সয়াবিন ও পাম ওয়েল আলাদা আলাদা নামে বিক্রি হচ্ছে। দেশের ৮টি বিভাগ থেকে ভোজ্যতেলের নমুনা পরীক্ষা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে বিএফএসএ আয়োজিত এক সেমিনারে এ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এতে গবেষণার মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন বিএফএসএয়ের সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, বাজারে ভোজ্যতেল খোলা ও বোতলজাত করে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ তেল বিক্রি হয় খোলা। এই খোলা তেল আবার সয়াবিন ও পাম তেল হিসেবে বিক্রি হয়। তবে সয়াবিন ও পাম তেল আলাদা নামে বিক্রি হলেও শুধু সয়াবিন বা শুধু পাম তেল হিসেবে কোন তেল পাওয়া যায়নি। সবই ছিল সয়াবিন ও পাম তেলের মিশ্রণ।
৮টি বিভাগ থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় মূল তেলে উপস্থিত ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। এই তেলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণও আলাদা হয়। নমুনা পরীক্ষায় ফ্যাটি অ্যাসিডের যে পরিমাণ পাওয়া গেছে তার কোনটাই এককভাবে সয়াবিন বা পাম তেলের নির্ধারিত মাত্রায় পাওয়া যায়নি। বরং কোন কোন তেলের মধ্যে পাওয়া গেছে কটন সীড ওয়েলের বৈশিষ্ট্য।
ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, "বোতলজাত সয়াবিন তেলের অবস্থা ভালো হলেও খোলা সয়াবিন ও পাম ওয়েলের কোনটাই খাঁটি নয়। নমুনা সংগ্রহের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাজারে পাম তেল পাওয়া যায়নি। সবই ব্যবসায়ীরা সয়াবিন নামেই বিক্রি করছে।"
তেলের পাশাপাশি তেলের ড্রাম পরীক্ষায় বিএফএসএ দেখতে পেয়েছে, এই ড্রামগুলো কোনটাই ফুড গ্রেডের নয় এবং এগুলোতে নানা ধরনের ময়লা যুক্ত থাকে। যে কারণে এখান থেকে কটু গন্ধ তৈরির একটি সম্ভাবনা থাকে। যদিও তেল পরিবহনে ফুড গ্রেডের ড্রাম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইআইটি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, 'সয়াবিনের দাম বেশি হওয়ায় পামকে সয়াবিন হিসেবে বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে। এই অবস্থা দূর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে।'
ভিটামিন এ ফর্টিফিকেশনের বাধ্যবাধকতাও মানছে না কোম্পানিগুলো
ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ ফর্টিফিকেশনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো তা পুরোপুরি মানছে না। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) তথ্য তুলে ধরে বিএফএসএ বলছে, পিইটি বোতলের ৮৭ শতাংশ নমুনায় ভিটামিন এ ফর্টিফিকেশন এর প্রমাণ মিলেছে। অন্যদিকে খোলা তেলের ৪৭.৩৩ শতাংশ নমুনাতেই ভিটামিন এ যথাযথ মাত্রায় নেই।
যেখানে ভিটামিন এ ফর্টিফিকেশনই ঠিকঠাক হচ্ছে না সেখানে এক ধাপ এগিয়ে বসুন্ধরার সয়াবিন তেলের মোড়কে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ভিটামিন এ, বি, ডি এবং ই ফর্টিফিকেশনের। অথচ বিএফএসএ বলছে, তেলের মধ্যে ভিটামিন বি ফর্টিফিকেশনের কোন সুযোগ নেই। কারণ এটি তেলের সঙ্গে মিশে না। এটা একটা ভাওতাবাজি, যা আইনত অপরাধ।
এছাড়া পুষ্টি সয়াবিন তেলের লেবেলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ফর্টিফায়েড সয়াবিন ওয়েল। তবে এর মধ্যে কি ফর্টিফিকেশন করা হয়েছে তা বলা হয়নি। এটাও এক ধরনের অপরাধ।
অনুষ্ঠানে সিটি, মেঘনা, এস.আলম সহ বিভিন্ন তেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা দাবি করেন, ফ্যাক্টরি থেকে নিম্নমানের তেল বাইরে আসে না। খাতুনগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের যেসব ব্যবসায়ীরা ড্রামে তেল কিনে তারাই এই ভেজালের জন্য দায়ী।
তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণে পুরোপুরি প্যাকেটজাত তেল বিপণনের বিকল্প নেই বলেও মত দেন তারা।
সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, "এখন সিটি গ্রুপ ৪০ শতাংশ তেল মোড়কজাত করছে, বাকি ৬০ শতাংশ ২০২২ সালের মধ্যে করে ফেলবে। তবে এখন মার্কেটে যারা আমাদের থেকে তেল নিয়ে পুনরায় প্যাকিং করছে তাদেরকে মনিটরিং করতে হবে।"
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, "আমরা এখনো সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্পের উদ্যোক্তাদের সচেতন করছি, সমস্যাগুলো তুলে ধরছি। কিন্তু ২০২২ সালের ১৬ মার্চের পর থেকে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সবাইকেই বাধ্যতামূলক প্যাকেজিং এ যেতে হবে।"
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, "যারা আমদানি করছে, প্রসেসিং করছে, বিক্রি করছে তাদের ওপর মানুষের আস্থা নেই কেন? মানুষ দাম দেয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তার জন্য তো আস্থা অর্জন করতে হবে। আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীরা বিষয়গুলো জানেন না, নাকি জানার পরও না জানার ভান করছেন।"
উল্লেখ্য, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন তেল উৎপাদন হচ্ছে যার মধ্যে ২২ লাখ টন ভোজ্য তেল হিসেবে এবং বাকিটা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হচ্ছে। এই তেলের ৯৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর। অপরিশোধিত তেল এবং ওয়েল সীড আমদানি হয় মূলত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে।