‘গুজবের ভিত্তিতে’ ৩ কোম্পানির মুনাফায় অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি, বেড়েছে শেয়ার দরও
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই শেয়ার দর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। মূলত কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা দেখাবে এমন 'গুজবের' ভিত্তিতেই বেড়েছে শেয়ার দর।
অথচ পরবর্তীতে আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জিআই ফিটিংস, কাগজ ও জুতার ব্যবসায় জড়িত এই কোম্পানিগুলোর আয় মূল ব্যবসা থেকে সেভাবে বাড়েনি। মূলত শেয়ারবাজারে ব্যবসা করেই তারা মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধি দেখছে।
এই কোম্পানিগুলো হলো- আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, সোনালি পেপার এবং ফরচুন সুজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানকে কেন্দ্র করে কিছু কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা করেছে। কিন্তু উৎপাদন খাতভিত্তিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য রেগুলেটরকে জানাতে হয় না। তাই কিছু কোম্পানি এই সুযোগ নিয়ে ইপিএসে (শেয়ারপ্রতি আয়ের পরিমাণ) বড় প্রবৃদ্ধি দেখাতে পেরেছে।
তিনি আরও বলেন,"এই তথ্য আগেই 'গুজব' আকারে ছড়িয়ে এদের শেয়ার দর কারসাজি করে বাড়ানো হয়েছে। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই এইসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই কোম্পানিগুলোর এমন প্রবৃদ্ধি সাময়িক।"
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুসারে, গেল বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের শেয়ার দর ৪২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৮৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি বার্তা ছড়িয়েছিল যে, কোম্পানিটি মুনাফায় ভালো প্রবৃদ্ধি দেখাতে যাচ্ছে। এর ভিত্তিতেই এর শেয়ার দর বেড়েছে। যার প্রমাণ ২০২০-২১ হিসাব বছরের মুনাফা বিশ্লেষণেই পাওয়া যায়। সে বছর জিআই ফিটিংস উৎপাদনকারী কোম্পানিটির মূল ব্যবসা থেকে মুনাফা বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। আর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ থেকে আয় যোগ করে নিট মুনাফা বেড়েছে ১০৩ শতাংশ।
চলতি হিসাব বছরের প্রথম ছয়মাসে, কোম্পানিটির জিআই ফিটিংস থেকে মুনাফা ৯ শতাংশ কমলেও তারা ইপিএসে প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে ৩৮০ শতাংশ। এই সময়ে তাদের ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৭.৬৩ টাকায়।
আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের অর্ধবার্ষিকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা যায়, কোম্পানিটি লাফার্জহোলসিম এবং ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ারে ১১.০৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তবে এই শেয়ারগুলো বিক্রি না করেই 'আনরিয়েলাইজড গেইন' হিসেবে কোম্পানিটি তার ব্যালেন্স শিটে নন-অপারেটিং ইনকাম হিসেবে দেখিয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক হিসাব মান মেনেই তারা এই কাজ করেছে বলে আর্থিক প্রতিবেদনে জানায়।
একই কাজ করেছে, সোনালি পেপার এবং ফরচুন সুজ। চলতি হিসাব বছরের প্রথম অর্ধেকে সোনালি পেপারের মূল ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ১৭.৭৫ কোটি টাকা এবং শেয়ারে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছে ১৭.৮৪ কোটি টাকা। এতে কোম্পানিটির মোট মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৭৮ শতাংশ।
আর ফরচুন সুজের মূল ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ১৮ কোটি টাকা এবং শেয়ারবাজার থেকে আয় হয়েছে ১৯.৩৯ কোটি টাকা। এতে তাদের মোট মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২২ শতাংশ।
এদিকে, গত এক বছরে সোনালি পেপারের শেয়ার দর ৩৯১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯৫৯ টাকা এবং ফরচুন সুজের শেয়ার দর ৭৮৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪১ টাকায়।
কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, করোনার কারণে ব্যবসায় মন্দা ছিল। আর সেসময় থেকে শেয়ারবাজার এখন চাঙ্গা হয়েছে। তাই বাড়তি মুনাফার জন্য বিনিয়োগ বাড়ছে।
ইপিএসে এমন প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে কোম্পানিটি স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে, নন-অপারেটিং ইনকাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ইপিএসে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু নন-অপারেটিং ইনকাম বৃদ্ধি নিয়ে তারা বিস্তারিত তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়নি।
যদিও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার জারি করা কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড অনুযায়ী, মুনাফায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হলে এর কারণ সুনির্দিষ্ট করে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানাতে হয়।
সেইসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, কোম্পানির ব্যবসা নিয়ে যদি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যার ফলশ্রুতিতে এর মুনাফা এবং রেভেনিউতে বড় ধরণের প্রভাব আসতে পারে, তাহলে তা 'প্রাইস সেন্সেটিভ ইনফরনেশন' হিসেবে বিনিয়োগকারীদের জানাতে হবে।
বিএসইসি'র কর্পোরেট ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের এক কর্মকর্তা বলেন, "বিষয়টি কমিশনের নজরে এসেছে। তবে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের স্বাধীনতা রয়েছে"
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, "এখানে আমাদের দেখতে হবে যে, শেয়ার দরে উত্থানের পেছনে ইনসাইডার ট্রেডিং বা কারসাজি রয়েছে কিনা। তাই বিএসইসি'র সার্ভেইল্যান্স বিভাগ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।"