তেল পাচার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভোক্তা অধিদপ্তরের চিঠি
দাম বেশি হওয়ার কারণে ভারতের বাজারে ভোজ্যতেলের পাচার ঠেকাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তেল পাচার রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চাওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও মিডিয়ার মাধ্যমে ভোক্তা অধিদপ্তর পার্শ্ববর্তী দেশে তেল পাচারের ঘটনা আমলে নেয়। এরপরই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এই চিঠি প্রদান করে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান স্বাক্ষরিত এই চিঠির বিষয় ছিল 'ভোজ্য তেল পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত।'
ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, 'তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে এমন কিছু অভিযোগ পেয়েছি আমরা। তবে পাচার রোধে কাজ করার মত কোন উইং আমাদের নেই। এ কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। যাতে করে বাণিজ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।'
ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব কনজ্যুমার এফেয়ার্সের (প্রাইস মনিটরিং সেল) তথ্য বলছে, এ মাসের ১৬ তারিখে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের গড় দাম ১৬২ রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তরিত (১ টাকা ১৩ পয়সা) করলে দাঁড়ায় ১৮৩ টাকার বেশি।
অন্যদিকে ভারতীয় পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে এডিবল ওয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ রুপির মধ্যে। এর মধ্যে অবশ্য সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার, পামসহ বিভিন্ন তেল রয়েছে। এই হিসেব করলে তেলের দাম পড়ছে ১৯২-২০৪ টাকার মধ্যে।
এদিকে বাংলাদেশে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৩ টাকা, বোতলজাত ১৬৮ টাকা এবং পাম ওয়েল প্রতি লিটার ১৩৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বোতলজাত সয়াবিনে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে দামের পার্থক্য কমপক্ষে ২২ টাকা (১৯২ টাকা লিটার ধরলে)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বর্ডার দিয়ে তেল পাচার করছে।
এই চিঠিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। সরকার ভোজ্য তেলের যে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের মূল্যের চেয়ে তুলনামূলক কম। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভোজ্য তেল পার্শ্ববর্তী দেশে বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা দিয়ে পাচার হচ্ছে।
পাইকারি ব্যবসায়ী নাকি পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো এই তেল পাচার করছে তা উল্লেখ করা হয়নি এই চিঠিতে। তবে বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশে যেন ভোজ্য তেল পাচার না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে।
এদিকে সম্প্রতি সরকার সয়াবিন তেলের উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ২০ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির আঁচ ভোক্তা পর্যায়ে কমিয়ে আনাই ভ্যাট কমানোর মূল কারণ। কিন্তু একদিকে তেলের দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, অন্যদিকে পাচার ঠেকানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'দাম কমার পরও যদি ভোজ্যতেল পাচার হয়ে যায় তবে সরবরাহ ঘাটতি থেকেই যাবে, ভোক্তাকে ভুগতে হবে। এ কারণে দাম কমিয়ে আনার পাশাপাশি পাচার রোধ করাটাও এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) এবং কনজ্যুমার ইয়ুথ বাংলাদেশ-এর (সিওয়াইবি) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, 'ভ্যাট কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা তা পুরোপুরি ব্যর্থ হবে যদি পাচার রোধ করা সম্ভব না হয়। এর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।'
সরবরাহ কমিয়ে দিয়েই সংকট তৈরি করা হয়
ভোক্তা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে ভোজ্য তেলের বাজারে যে অস্থিরতা তার পেছনে মূলত পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার বিষয়টিই উঠে আসছে।
সম্প্রতি কোম্পানিগুলোতে ভোক্তার বেশ কয়েকটি অভিযান সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারীর শেষে যখন ভোজ্য তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সয়াবিন ও পাম অলিনের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা দেয় তখন সরকার তা বাতিল করে দেয়।
কিন্তু এই সময় দাম বৃদ্ধি করতে না পেরে কোম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ একেবারেই কমিয়ে করে দেয়। অন্যদিকে সরবরাহ কম থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও বাড়তি দামে তেল বিক্রি শুরু করে। বাজারে একটি সংকট তৈরি হয়। সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার এই ঘটনা বেশ কয়েকটি অভিযানে উঠে আসে।
কয়েকদিন ধরেই ভোক্তার কর্মকর্তারা সিটি, মেঘনা, এস আলম, টিকে সহ পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোতে মনিটরিংয়ে যায়। এই মনিটরিংয়ে দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠানই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। আবার এস আলম এই সময়েও ৭৯৫ টাকার ৫ লিটারের তেল ৮৩৫ টাকায় নতুন খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে, যা সরকার নির্ধারিত দামের বেশি।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে আগে থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ভোজ্যতেলের বাজারে নতুন করে সংকট তৈরি করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সয়াবিন ও পাম অলিনের দাম উঠে যায় টনপ্রতি ১৮০০-১৯০০ ডলারে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল রপ্তানি কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আর্জেন্টিনা তাদের সয়াবিন তেল ও সয়া মিলের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়।
বাংলাদেশে প্রতি বছর সয়াবিন ও পাম অলিনের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টন, যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর।