পোশাক শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন করবে মডার্ন সিনটেক্স, কমবে আমদানি নির্ভরতা
বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রায় শতভাগ কাঁচামাল আমদানি হয় চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। ব্যাংকে এলসি খোলা থেকে শুরু করে পণ্য চালান আসতে সময় লাগে প্রায় দেড় মাস। চীন থেকে ৪০ ফুট সাইজের কন্টেইনারে পরিবহন ব্যয় হয় প্রায় ১৬ হাজার ডলার।
তবে এখন দেশেই তৈরী হবে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল। দেশের বৃহৎ ইকোনমিক জোন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে ১৩১ মিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগে কারখানা গড়ে তুলছে মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড। এই প্রকল্পে উৎপাদিত হবে পলিয়েস্টার ড্র টেক্সচার্ড ইয়ার্ন (ডিটিওয়াই), পলিয়েস্টার ফুল্লি ড্রন ইয়ার্ন (এফডিওয়াই), পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার (পিএসএফ) এবং পলিথিন টেরেফথালেট (পিইটি) চিপস নামক চার ধরনের পণ্য।
এর মধ্যে পিএসএফ এবং পিইটি পণ্য দুটো এই প্রথম বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া বাকি দুটো পণ্যও পলিকনডেনসেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথম উৎপাদন হবে এই কারখানায়। জার্মানি, চীন এবং ভারতের মেশিনারি ব্যবহার করা হচ্ছে কারখানায়। ২০২৩ সালের মার্চ অথবা এপ্রিলে উৎপাদন শুরু করবে মডার্ন সিনটেক্স।
মডার্ন সিনটেক্সের এসব পণ্য তৈরী পোশাক, হোম টেক্সটাইল, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, নেট, জুতা এবং মোটরগাড়ির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হবে। বর্তমানে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এসব কাঁচামাল চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি থেকে আমদানি করে থাকে।
মডার্ন সিনটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সুফিয়ান চৌধুরী বলেন, 'আমাদের কারখানায় যে পণ্য উৎপাদন হবে এগুলো দেশের মোট আমদানির প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণে সক্ষম। আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষার সুযোগ কম থাকে। দেশের উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে গুণগত মান পরীক্ষার অবারিত সুযোগ রয়েছে।'
পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর তৈরী পোশাকের অর্ডার বাড়ছে। ফলে একইসাথে বাড়ছে পোশাক শিল্পের কাঁচামালের চাহিদাও। অন্য দেশের পণ্যের তুলনায় গুণগত মান বজায় থাকলে বিশাল এই চাহিদাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। দেশে তৈরি কাঁচামাল ব্যবহারের কারণে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, তেমনি পণ্য আমদানির সময়ও বাঁচবে।
চট্টগ্রামের বৃহৎ পোশাক শিল্প গ্রুপ ক্লিফটন গ্রুপের পরিচালক ও সিইও এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'সিনথেটিক ইয়ার্ন ফ্যাক্টরি বাংলাদেশে ছিলোনা। এর ব্যবহারও কম ছিল। কালের বিবর্তনে স্থানীয় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। ইলাস্টিক এক্সেসরিজ, রিবনের জন্য সিনথেটিক ইয়ার্ন খুবই জরুরী। রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায়ও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সিনথেটিক সুতার দাম আর কটন সুতার দামের প্রায় অর্ধেক পার্থক্য। সাশ্রয়ের জন্য সিনথেটিক মিক্সিং কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।'
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) এই পরিচালক আরো বলেন, 'রপ্তানিতে ইলাস্টিক পণ্যের জন্য সিনথেটিক ইয়ার্ন মূল র' ম্যাটেরিয়াল। সুইং সুতার জন্যও এটি ব্যবহার হয়। বিশ্বে কটন থেকে সিনথেটিকের যে বিপ্লব হচ্ছে মডার্ন সিনটেক্সের এই কারখানা তাতে অনেক কাজ দেবে। তাদের এই প্রকল্পটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়।'
মডার্ন সিনটেক্সের জেনারেল ম্যানেজার (টেকনিক্যাল) সফল বড়ুয়া বলেন, ইতোমধ্যে কারখানার সিভিল ওয়ার্ক শেষ হয়েছে ৯০ শতাংশ। মডার্ন সিনটেক্স কারখানায় দৈনিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪৬০ মেট্রিক টন। ২০ একর জায়গায় নির্মিত এই কারখানায় কর্মসংস্থান হবে ১ হাজার ৫০০ জনের। বার্ষিক টার্নওভার হবে ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
তিনি আরো বলেন, 'আমাদের কারখানার উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশের তুলনায় গুণগত মান সম্পন্ন হবে। পণ্যগুলো শতভাগ দেশের বাজারে বিক্রি হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনে কারখানা সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।'
পোশাকখাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এই পণ্য উৎপাদন হলে আমদানির ফ্রেইট চার্জ বেঁচে যাবে। একই সাথে লিড টাইমও কমে যাবে। এটি বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য বড় সুখবর।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) পরিচালক শামছুল আজম বলেন, 'আমদানি নির্ভর পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন হতে যাচ্ছে এটি অনেক ইতিবাচক সংবাদ। এতে দেশের পোশাক খাত আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।'
মডার্ন সিনটেক্স সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিব শিল্প নগরের জোন ৬-এ গড়ে উঠছে এই কারখানা। ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এই প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন বেজার তৎকালীন নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। কারখানায় প্রযুক্তিগত সরবরাহ করছে জার্মানির ওয়িরলিকন গ্রুপ।
বিজিএমইএ'র সহ সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর সহ দেশের বিভিন্ন শিল্প নগরে গড়ে উঠছে পোশাক কারখানা। তাই কাঁচামালের চাহিদাও বাড়ছে। এই খাতে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসার জন্য পোশাক কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে মডার্ন সিনটেক্সকে ধন্যবাদ জানাই। আমদানি নির্ভরতা কমাতে এই খাতে বিনিয়োগের জন্য নতুন উদ্যোক্তাদের স্বাগত জানাই।'