আসছে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট, নেই ত্বরিত কোনো সমাধানও
প্রাকৃতিক গ্যাসের অকল্পনীয় মূল্যবৃদ্ধি, কয়লার দর আকাশছোঁয়া, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলও অচিরেই ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে পৌঁছানোর আভাস দেওয়া হচ্ছে।
চাহিদা বৃদ্ধি ও মৌসুম পরিবর্তনে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটও দিন দিন তীব্র হচ্ছে। অথচ পশ্চিম গোলার্ধে আসন্ন শীতে ঘর আলোকিত ও উষ্ণ রাখতে জ্বালানির ব্যবহার বাড়বে বই কমবে না। জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে তাই উৎকণ্ঠাও বাড়ছে সব দেশেরই সরকারি মহলে।
জ্বালানির দরস্ফীতিতে যেন ভোক্তাদের ওপর পড়া প্রভাব সীমিত রাখা যায়, সরকারি পর্যায়ে সে চেষ্টাই চলছে। কারণ ভোক্তারা ব্যয় সংকোচনে বাধ্য হলে ব্যাহত হবে মহামারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার। তবে চেষ্টা সত্ত্বেও জনগণেরর বাড়তি খরচের চাপ যে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না, সেটাও স্বীকার করছেন তারা।
পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারগুলোর ওপর অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহারের চাপ বৃদ্ধির বিষয়টি। উন্নত দেশে জনগণ যেমন এমন চাপ দিচ্ছে, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক স্তরে জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থাও দিচ্ছে দূষণকারী থেকে পরিবেশ সম্মত জ্বালানি ব্যবহারে রূপান্তরের তাগিদ। কিন্তু সে যাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে প্রচলিত জ্বালানি বাজারের অস্বাভাবিক দরস্ফীতি। কারণ এখনও বিশ্বের ৮০ শতাংশ শক্তিচাহিদা পূরণ করে তেল,গ্যাস,কয়লার মতো জীবাশ্ম উৎস।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনের বাসিন্দারা ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্নতার কবলে পড়ছেন। ভারতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কমেছে কয়লার মজুদ, হন্যে হয়ে নতুন চালান খুঁজছে তারা। অন্যদিকে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দর বাড়ায় ইউরোপের ভোক্তাদের বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থায় যেসব গ্রাহক তাৎক্ষনিক বিল পরিশোধে ব্যর্থ হবে, তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তুলেছেন।
এদিকে জ্বালানি গ্যাস ক্রয়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ায় কয়লা ও তেলের বাজারেও আগুন লেগেছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এ দুটি উৎস ব্যবহার করা হয়, তবে পরিবেশের জন্য এগুলো পোড়ানো আরও বেশি ক্ষতিকর।
গত বুধবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানিবিষয়ক প্রধান সিমসন কাদরি আগামী সপ্তাহে জোটটির দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতির রূপকাঠামো তুলে ধরার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, "খুবই সংবেনশীল মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির অপ্রত্যাশিত সংকট দেখা দিল। সামাজিক প্রভাব হ্রাস ও অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দানকেই প্রাথমিকভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।"
ইউরোপে প্রতি হাজার ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস গত বুধবার নাগাদ রেকর্ড ১,৯০০ ডলারে লেনদেন হয়েছে। তেলের মতো ব্যারেলপ্রতি হিসাব করলে যা ২৩০ ডলার মূল্যের সাথে তুলনীয়। গত মাস (সেপ্টেম্বর) থেকে সার্বিক দর বেড়েছে ১৩০ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের চাইতে আটগুণ বেশি, বলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমোডিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সূত্র জানায়।
এদিকে সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে পূর্ব এশিয়ায় প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ৮৫ শতাংশ বাড়ে, তেলের মতো ব্যারেলপ্রতি হিসাব করলে যার মূল্য দাঁড়িয়েছে ২০৪ ডলারে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের অন্যতম বড় রপ্তানিকারক যুক্তরাষ্ট্রে দর তুলনামূলক কম থাকলেও, ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ নিকোস টেসাফস বলেন, "এসব কিছু আসন্ন শীতকাল ঘিরে শঙ্কার পালে হাওয়া দিচ্ছে।"
এ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, উৎকণ্ঠার কারণে সরকারগুলোর অতিরিক্ত জ্বালানি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত বাজারকে চাহিদা ও সরবরাহের মৌলিক শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। অর্থাৎ সরবরাহ থাকলেও সংকটের ভীতি থেকেই জন্ম নেবে আরও তীব্র চাহিদা ও মূল্যস্ফীতি।
এদিকে জ্বালানি গ্যাস ক্রয়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ায় কয়লা ও তেলের বাজারেও আগুন লেগেছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এ দুটি উৎস ব্যবহার করা হয়, তবে পরিবেশের জন্য এগুলো পোড়ানো আরও বেশি ক্ষতিকর।
কয়লার ওপর অতি-নির্ভরশীল ভারত চলতি সপ্তাহে জানায় যে, দেশটির ১৩৫টি বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৬৩টিতে মাত্র দুই দিন বা তার কম সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো কয়লার মজুদ রয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হলে সঙ্গত কারণেই তার ফলে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে, বাধাগ্রস্ত হবে পরিষেবা খাতও। তাই বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ও বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত।
জ্বালানির দরে নাটকীয় উল্লম্ফন ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতিতে অবদান রাখছে। অথচ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিগুলোর মহামারির দীর্ঘমেয়াদী অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাকালে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য চাপ বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
সহজ সমাধানের পথ বন্ধ
মহামারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ায় রাতারাতি বাড়তে থাকে জ্বালানির চাহিদা, সঙ্কটের মূল কারণও সেখানেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি সরবরাহ বাণিজ্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়, কিন্তু বিরূপ আবহাওয়া ও কারিগরি সমস্যা এখানে আকস্মিক সরবরাহ বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিতে পারে।
বিশ্বের কারখানাখ্যাত চীনও তরলীকৃত জ্বালানি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াচ্ছে, ফলে এলএনজি বাজার সরবরাহ সংকট সহসাই পূরণ করতে পারবে না। রাশিয়া থেকে গ্যাস রপ্তানি কমে যাওয়াও সংকটকে গভীর করে তুলছে।
যেমন চলতি বছরের শুরুতে ইউরোপে নজিরবিহীন এক দীর্ঘ ও হাড়কাঁপানো শীতকাল দেখা দেয়, যা প্রাকৃতিক গ্যাসের অতিরিক্ত মজুদ নিঃশেষিত করেছিল। তার সঙ্গে আকাশচুম্বী নতুন চাহিদা যোগ হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে পুনঃমজুদের চেষ্টাও। বসন্ত ও গ্রীষ্মের মধ্যে পুনঃমজুদ শেষ হওয়ার প্রথা থাকলেও, এ বছর তা করা যায়নি।
ফলে মজুদ ও নতুন চাহিদার মিলিত প্রভাবে ইউরোপের বাজারে জ্বালানি পণ্য উচ্চ অবস্থানেই থাকার আভাস দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বের কারখানাখ্যাত চীনও তরলীকৃত জ্বালানি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াচ্ছে, ফলে এলএনজি বাজার সরবরাহ সংকট সহসাই পূরণ করতে পারবে না। রাশিয়া থেকে গ্যাস রপ্তানি কমে যাওয়াও সংকটকে গভীর করে তুলছে।
এব্যাপারে বহুজাতিক ফরাসী বিনিয়োগ ব্যাংক- সোসিয়েট জেনারেল চলতি সপ্তাহে নিজ গ্রাহকদের প্রতি এক গবেষণা নোটে জানিয়েছে, "ইউরোপের বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রম। বিদ্যুতের খরচ কখনও এত দ্রুত এত উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। অথচ এখন কেবল শরৎ শুরু হয়েছে, তাপমাত্রা এখনও মৃদুই রয়েছে।"
অর্থাৎ, শীতকালীন তাপমাত্রা হ্রাসের সাথে সাথে খরচ আরও বাড়ার আভাস দিচ্ছে ব্যাংকটি।
বাজারের এসব সক্রিয় দিক বিশ্বব্যাপী অনুভূত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে আগস্টের পর থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে, কয়লার দাম বাড়ার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদক অধিকাংশ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে আরও বেশি কার্বন ঋণ দিয়ে নিজেদের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো নিশ্চিত করতে হবে।
শক্তি উৎপাদনের এ সংকট তেলের মূল্য বৃদ্ধির পক্ষে কাজ করছে। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে তেলের দর। ব্যাংক অব আমেরিকার মতে, হিমেল শীতের দাপট দেখা দিলে এ বছর জ্বালানির বৈশ্বিক সূচক ব্রেন্ট ক্রুডের দর ব্যারেল্প্রতি ১০০ ডলার ছাড়াবে। ২০১৪ সালের পর এত উচ্চমূল্য আর দেখা যায়নি।
এব্যাপারে বাজার বিশ্লেষক আইএইচএস মার্কিটের অপরিশোধিত জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও সঞ্চালন গবেষণা শাখার প্রধান জিম বুর্খহার্ড বলেন, "আপাতদৃষ্টিতে কোন তাৎক্ষনিক পরিত্রাণ দেখা যাচ্ছে না। গ্যাসের জন্য কোন সৌদি আরব নেই।"
এর মাধ্যমে তিনি এ জ্বালানি বাজারে সৌদি আরবের মতো বড় ও বিশ্বস্ত সরবরাহকের অনুপস্থিতির দিকটি তুলে ধরেছেন, যেমনটি থাকলে আকস্মিক চাহিদা পূরণ সহজ হতো।
"সব মিলিয়ে মনে হয়, এবার উত্তর গোলার্ধের মানুষকে বেশ ভুগতে হবে" যোগ করেন তিনি।
তাত্ত্বিকভাবে দেখলে, বাজার চাহিদা পূরণে রাশিয়া এগিয়ে আসতে পারে। সোসিয়েট জেনারেল উল্লেখ করে যে, রাশিয়া থেকে সরাসরি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হলেও, জার্মান কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত এর অনুমোদন দেয়, তাহলে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় চাপ কমবে।
গত বুধবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তার দেশ গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি করবে,এমন ইঙ্গিত দেন। এ সময় তিনি জানান, ক্রেতাদের থেকে ন্যায্য দর আহ্বান করা হলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বৃহৎ গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রম উৎপাদন বাড়াবে।
তবে চলতি সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট শিল্পের এক সম্মেলনে এক্সনমোবিলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিল চ্যাপম্যান স্বল্পকালীন বাধা দূর করার ওপরই গুরুত্ব দেন।
ভার্চুয়াল এনার্জি ইন্টেলিজেন্স ফোরাম শীর্ষক ওই আলোচনায় যুক্ত হয়ে চ্যাপম্যান বলেন, "নিঃসন্দেহে সবার ভেতর গভীর উৎকণ্ঠা কাজ করছে। আমাদের এই শিল্প ব্যাপক মূলধন নির্ভর হওয়ায়, চাইলেই কেউ ইচ্ছেমতো উৎপাদন বাড়াতে পারে না।"
- সূত্র: সিএনএন