উন্নয়নশীল দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ ও পশ্চিম বিরোধিতায় চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক জোরদার
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের টিকাদান কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে রাশিয়ান স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন, আর এর মধ্যে শত কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের লেবেল শোভা পাচ্ছে 'মেইড ইন চায়না' লেখা।
বিগত মাসগুলোতে ২৬ কোটি ডোজের বেশি রাশিয়ান স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন উৎপাদনের চুক্তি করেছে চীনা কোম্পানিগুলো। ভ্যাকসিনটি ইতোমধ্যে ৬০টির বেশি দেশে ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে মেক্সিকো, ভারত ও আর্জেন্টিনার মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে।
যতো সময় গড়াচ্ছে, চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন কার্যক্রমের লক্ষ্যও অনেকটাই একই সুঁতোয় বাঁধা- এমনটাই মনে হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে যখন কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন মজুদের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, চীন ও রাশিয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখা গেছে, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলো যে পরিমাণ ভ্যাকসিনের ডোজ মজুদ করেছে, তা দিয়ে তাদের সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে তিনবারের বেশি টিকাদানের আওতায় আনা যাবে। অন্যদিকে বেশিরভাগ দেশই তাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দেওয়া নিশ্চিত করতেই হিমশিম খাচ্ছে, এরমধ্যে কোভিডের আঘাতে ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত অনেক দেশও রয়েছে।
চীন-রাশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বোবো লো এব্যাপারে বলেন, মহামারির মধ্যে রাশিয়া-চীন দুটি দেশই ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের সুযোগ পেয়েছে।
"পশ্চিমা দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে তা দেখিয়ে দেওয়াটা তাদের কাজে আসবে। বেইজিং ও মস্কোর জন্য এই ধারণা খুবই গুরূত্বপূর্ণ,"
বেইজিং ও মস্কোর ভ্যাকসিন সহায়তার পেছনে অন্য গল্পও আছে। ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জুরিথ টুইগ জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ও যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টির মতো রাশিয়ার পক্ষ থেকে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়।
চীনও এমনটা একই কাজই করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তৈরি ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা ফলাও করে প্রচার করা হয় যা কিছুটা অতিরঞ্জিত।
সাবেক কূটনীতিক লো বলেন, "বলা যায় চীন অনেকটা এভাবে আহ্বান জানাচ্ছে: আমরা আপনাদের সমস্যা বুঝতে পারছি, আমরা পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলোর মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নই, আমরা সাহায্য করতে এসেছে,"
এশিয়ার দেশ দু'টির দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট শাসনের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বিগত শতক ধরে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক একেবারেই অনুকূলে ছিল না। দেশ দুটির মধ্যে সীমান্ত সংঘাত, রাজনৈতিক জিম্মি করার ঘটনা আছে অনেক; জোসেফ স্টালিন ও মাও সে তুংয়ের দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্ক তো বহুল জনপ্রিয়।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শি জিন পিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনামলে দেশ দুটি বেশ কিছু পারস্পরিক ভূ-রাজনৈতিক আগ্রহের বিষয়কে কেন্দ্র করে সম্পর্ক জোরালো করেছে। ২০১৯ সালে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের বাণিজ্য যুদ্ধ ক্রমশই বিস্তার লাভের সময় শি জিন পিং পুতিনকে তার 'বেস্টফ্রেন্ড ও বোজম ফ্রেন্ড' আখ্যা দিয়েছিলেন।
কোভিড-১৯ মহামারি দেশ দুটির এ বন্ধন আরও দৃঢ় করেছে। ২০২০ সালের এপ্রিলে চীনে নিয়োজিত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ডেনিসোভ বলেছিলেন, দুটি দেশের শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করবে চীন-রাশিয়া। "যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হয়েছিল," বলেন তিনি।
৭ এপ্রিল চায়না ডেইলিতে প্রকাশিত একটি মতামত প্রবন্ধে মস্কোতে নিয়োজিত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং হানহুই বলেন, "বিশ্বের যতোই পরিবর্তন আসবে, যতো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে; চীন ও রাশিয়ার দুর্দান্ত বন্ধুত্ব ততোটা তাত্পর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে,"
দেশ দুটির এই সহযোগিতামূলক কার্যক্রম কিছু পশ্চিমা কিছু নেতার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২৫ মার্চ ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো বলেছিলেন, 'এক নতুন ধরনের বিশ্বযুদ্ধে' রাশিয়া ও চীন ভ্যাকসিনের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রামের পরিচালক থমাস বোলকি বলেন, অনেক উন্নয়নশীল দেশ ভ্যাকসিনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
তবে বলিকি বলেন, চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন সরবরাহের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে মার্কিন সরকারের কিছুটা উদ্বেগ থাকতে পারে, দিন শেষে বিশ্ববাসীর আরও বেশি ভ্যাকসিনের চাহিদা আছে।
"চীনা ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে আমার একমাত্র উদ্বেগের জায়গা হলো, তারা এখনও তাদের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তথ্যাদি প্রকাশ করেনি, এই তথ্যাবলী দিয়েই ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা কতোটুকু মূল্যায়ন করা হয়," বলেন তিনি।
সাবেক কূটনীতিক লো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই ঘনিষ্ঠতা বজায় থাকবে কিনা তা জানা কঠিন। আপাতত শি ও পুতিন সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা বিরোধীতা তাদের একত্রিত করেছে। বেইজিং ও মস্কোর ওপর সৃষ্টি করতে প্রেসিডেন্ট জো বিডেনের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলো নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভ্যাকসিন কূটনীতি
ভ্যাকসিন কূটনীতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে চীন ও রাশিয়া। গত ২৩ মার্চ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সাথে এক বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি তার বক্তব্যে বলেন, উভয় দেশই 'মানবিক কাজে' যুক্ত আছে।
ওয়াং বলেন, "বেশ কয়েকটি শক্তিধর দেশ তাদের নিজ স্বার্থের জন্য ভ্যাকসিন মজুদ করছে। অন্যদিকে, কিন্তু আরও বেশি মানুষ টিকা নিচ্ছেন তা চাই। শীঘ্রই মহামারি নির্মূল হবে আমরা তা-ই চাই,"
"শুধু নিজেদের নয়, বরং পুরো বিশ্বকে সহায়তা করাই আমাদের (চীন-রাশিয়া) লক্ষ্য,"
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রুত স্পুটনিক ভ্যাকসিন সরবরাহের পেছনে রাশিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক বিশ্বনেতা প্রশ্ন তুলেছেন।
ইউরোপীয় কমিশনের রাষ্ট্রপতি উরসুলা ভন ডার লিওন ফেব্রুয়ারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "ভেবে অবাক হই, নিজ দেশের মানুষকে যথাযথভাবে টিকা না দিয়ে রাশিয়া কেন লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করছে,"
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিৎ এমন মন্তব্যও করেন তিনি।
এখন পর্যন্ত রাশিয়ার জনসংখ্যার মাত্র ৫.৯ শতাংশকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া হয়েছে। চীন জানিয়েছে, মে মাস পর্যন্ত দেশটির ৩০কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। তবে এরমধ্যে কতোজনকে একটি ডোজ আর কতোকনকে দুটি দেওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি।
রাশিয়া এবং চীন যদি উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে দ্রুত টিকা দেওয়ার কাজ করতে পারে, তারপরও তাদের মেই প্রচেষ্টার আকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ফল পাওয়া যাবে না বলে করছেন করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
জুরিথ বলেন, বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন সরবরাহ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া বাইডেন ভ্যাকসিন পেটেন্ট আইন মওকুফ করলে কিংবা এমন ধরনের যে কোনো ঘটনা বর্তমান দৃশ্যপট একেবারেই পাল্টে দিতে পারে। বেশিরভাগ দেশই বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন দিয়ে তাদের জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের আওতায় আনতে, মহামারির শেষে গিয়ে এমনটা দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, "আজ থেকে এক বছর বা দুই বা তিন বছর পর আমি মনে করি না এসব আর কারও মনে পড়বে,"।
- সূত্র: সিএনএন