এক দশকের মুক্তির দিন শেষ: সু চি'র আঁধার দিনের শুরু
এক যুগ আগের সে সময়ে দেখা দিয়েছিল আশার আলো। ২০১০ সালে নভেম্বরে সেই শীতল সন্ধ্যায় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ইয়াঙ্গুনের ইউনিভার্সিটি এভিন্যিউয়ের সামনে থেকে ব্যারিকেড তুলে নেয়। এই সড়কের একটি বাড়িতে গৃহবন্দী ছিলেন মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকারী অং সান সু চি। সেনাবাহিনীর অবরোধ তুলে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে জনগণের সঙ্গে সু চি'র দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার অবসান ঘটে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ ঘটনায় তীব্র উচ্ছ্বাসে মাতে। প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান ওই সময় লেখে:
লুঙ্গি ও স্যান্ডেল পরিহিত সমর্থকেরা সেনা অবরোধ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ৪শ' মিটার দৌড়ে সু চি'র বাড়ির মূল ফটকের সামনে পৌঁছান। এক নারী সমর্থকের কাপড়ে পিন দিয়ে লাগানো ছিল তার নেত্রীর প্রতিকৃতি। তিনি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ানোর সময়, সু চি'র নাম ধরে ডাকছিলেন। প্রধান ফটকের সামনে এসে সমর্থকেরা জীর্ণ বাঁশের বেড়ায় ধাক্কা দিতে দিতে গান গেয়ে আর 'সু চি দীর্ঘজীবী হোক' এই স্লোগানে মুখরিত করছিলেন চারপাশ।
শুধু গণমাধ্যম নয়, সু চি'র মুক্তি সংবাদ বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনেও ফেলে তুমুল আলোড়ন। নানা দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা তার মুক্তিকে মিয়ানমারে 'গণতন্ত্রের নতুন সুর্যোদয়' বলে স্বাগত জানান। সামরিক জান্তার নিষ্ঠুর বুটের তলায় পিষ্ট মিয়ানমারে শান্তি ও মানবাধিকার ফেরার আশাই করেছিলেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
সু চি হলেন মিয়ানমারের জাতির জনক জেনারেল অং সানের কন্যা। অং সান তাদমাদাউ (সেনাবাহিনী) প্রতিষ্ঠা করে নিজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। একে বিখ্যাত পিতা অন্যদিকে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৫ বছরের গৃহবন্দিত্ব তাকে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত করে।
বন্দী থাকার কালে বিশ্বের কাছে অং সান সু চি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য ও কলঙ্কহীন এক নেত্রী। নিজ সংগ্রামের জন্যে তিনি একাধিক শীর্ষ পদকে ভূষিত হন। ১৯৯১ সালে তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। তার আগে ১৯৯০ সালে মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতার পক্ষ জন্য পান শাখারভ পুরস্কারের মনোনয়ন। ২০০০ সালে তাকে দেওয়া হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম। সামরিক জান্তার বর্বর দমন-পীড়নের মুখে তিনি সৌম্যতা এবং সম্মানের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।
কিন্তু, মুক্তির এক যুগের মধ্যে সু চি' গণতান্ত্রিক প্রতীক থেকে একজন সাধারণ রাজনীতিবিদে রূপ নেন। অনুপ্রেরণার উৎস থেকে বিশ্ব দেখে তার নাটকীয় পদস্খলন।
পশ্চিমা বিশ্বের চোখে অবশ্য তার পতন ছিল ধীরগতির। এটি সঠিক পর্যবেক্ষন কিনা- তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
২০১৫ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পার সু চি'র দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি। তবে সেনা শাসকদের প্রনীত সংবিধান অনুসারে স্বামী বিদেশি নাগরিক হওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। পরিবর্তে তাকে দেওয়া হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্টেট কাউন্সিলরের পদ। ফলে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে তিনি দেশটির পরোক্ষ শাসকে পরিণত হন।
নির্বাচনে জিতলেও সু চি'কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপোষ করেই ক্ষমতায় আসতে হয়। এজন্য পরিবর্তন করা হয় সংবিধান, যার মাধ্যমে পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্যে ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার বিধি যুক্ত হয়। এছাড়া, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয়ে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারাই মন্ত্রীত্ব নেন। ফলে কার্যত তার সরকার ছিল কাঠামোগত দিক থেকেই দুর্বল।
সেনাবাহিনী অর্থনৈতিক মুক্তির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; তার বাস্তবায়নও ছিল প্রায় অদৃশ্য এবং প্রতারণাপূর্ণ।
কিন্তু, তার সাহায্যে একটি নিষ্ঠুর ও গণতন্ত্রবিরোধী জান্তা বৈধতা পাওয়ার বিষয়টিই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক মহলে উদ্দেগের কারণ হয়ে ওঠে।
উদ্বেগ নিন্দায় রূপ নিতেও সময় লাগেনি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যখন বর্বর গণহত্যা চালানো হয়, তাদের গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে, তাদের নারী-শিশুদের নির্বিচার ধর্ষণ করা হয়; তখন পিতার প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীর কোনো সমালোচনা করেননি সু চি। সমালোচনা দূরে থাক তিনি আন্তর্জাতিক ধিক্কারের মুখে তার সহযোগী সেনা শাসকদের পক্ষে সাফাই গান। এমনকি সমর্থন দেন কট্টর বর্ণবাদি বর্মী জাতীয়তাবাদকে। বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার পালিয়ে আসাকে তিনি তুচ্ছ করে তুলতে চেষ্টার অন্ত রাখেননি।
পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত ও অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য তার প্রতি আহ্বান জানায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। কিন্তু, সু চি রক্ষা না করে সংহারকের দলে যোগ দেন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়ে সু চি ২০১৯ সালে হেগের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে গনহত্যার অভিযোগকে মিথ্যে বলে দাবি করে বলেন, "এসব ঘটনাকে শুধু একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে রঙ চড়িয়ে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে সামগ্রিক চিত্রটি অসঙ্গতিপূর্ণ।"
আসলে এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। অং সান সু চি বরাবর বার্মিজ জাতীয়তাবাদীই ছিলেন। তার রাষ্ট্র দর্শন ছিল বর্মী জাতিসত্বাকে কেন্দ্র করেই। শুধু রোহিঙ্গা নয়, অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দমন-পীড়ন নিয়ে তিনি কোনোদিন সরব হননি।
দেশের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কের কন্যা হওয়াটাই তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দর্শন গঠন করে।
তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে তার মর্যাদার পতন হলেও, মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে তিনি এখনও সমান জনপ্রিয়। এমনকি গেল ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২০১৫ সালের চাইতেও ভালো ফল করে তার দল। সু চি পান আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট।
তবে সামরিকবাহিনী এ নির্বাচনের ফল মেনে নেয়নি এবং আজ সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) তারা ক্ষমতা দখল করেছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন অং সান সু চি-সহ তার ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা। জান্তার দৃষ্টিতে, নির্বাচন ছিল জালিয়াতিতে ভরা। কিন্তু, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা এমন দাবির গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম বলছেন।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে সু চি'র গ্রেপ্তারকে দেখা হচ্ছে, ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায় ফিরে আসা হিসেবে। রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেনা জান্তা এক বছরের জন্যে জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দিয়েছে। অনেক এলাকায় বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ।
তার বরাত দিয়ে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনীর এই পদক্ষেপ দেশকে আবারও স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রয়াস।
"এই সিদ্ধান্ত যেন জনগণ মেনে না নেন। আমি তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে এই সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানাচ্ছি।"
সু চি'র তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে সামরিক জান্তার পদক্ষেপ তাদের জন্যে হিতে-বিপরীত ফলে ডেকে আনতে পারে, বলে মন্তব্য করেন মিয়ানমার পর্যবেক্ষক ডেভিড ম্যাথিসন।
"আমি মনে করি সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপে দেশটির সিংহভাগ মানুষ নিশ্চুপ বসে থাকবে না। সু চি যখন গৃহবন্দি ছিলেন, তখন তাকে অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে পুরো একটি প্রজন্ম। অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্ম পেয়েছে তার আমলে সীমিত গণতন্ত্রের আস্বাদ। এদের সকলে তাকে সমর্থন দেবে। এছাড়া, মিয়ানমারের সংখ্যালঘু অনেক রাজ্যে অপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, তবে তারা সেনাবাহিনীকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে," ম্যাথিসন যোগ করেন।
বিশ্বজুড়ে সু চি'র ভাবমূর্তি এখন নিন্দিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ। তারপরও সামরিক জান্তার ক্ষমতাগ্রহণকে প্রভাবশালী সকল দেশ নিন্দা করেছে। মিয়ানমারের ভেতরেও দেখা দিয়েছে অস্থিতিশীলতার আবহ।
বর্মী লেখক ও ঐতিহাসিক থান্ট মিন্ট- উ লিখেছেন, ' সম্পূর্ণ বিপরীত এক ভবিষ্যতের দুয়ার খুলেছে। আমার আশঙ্কা, এরপর যা হবে, তা কেউ আটকাতে পারবে না। মনে রাখা উচিৎ, মিয়ানমারে অবৈধ অস্ত্রের অভাব নেই। আছে ধর্মীয় আর নৃতাত্ত্বিক জাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে চরম বিভাজন। সামরিক জান্তা এই বহুমুখী চাপ সামলাতে পারবে না।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান