কোভিড টিকা তৈরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল ফাইজার
প্রথমে করোনা টিকা তৈরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল ফাইজার। কারণ প্রতিষ্ঠানটির কার্যনির্বাহীরা ভেবেছিলেন ভাইরাসটির বিস্তার অচিরেই থেমে যাবে।
ফাইজারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড. ফিল ডরমিটজারের মনে হয়েছিল এমআরএনএ প্রযুক্তির টিকাটি উদ্ভাবনে হাত দেওয়াটা বড় বেশি পরীক্ষামূলক হয়ে যাবে। এ কারণে প্রথমে বায়োএনটেকের প্রতিষ্ঠাতা ড. উগুর শাহিন ও তার স্ত্রী ড. ওজলেম টুরেচিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ড. ডরমিটজার স্বীকার করেছেন, 'কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে এটা (কোভিড-১৯) নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।'
শেষ পর্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে এমআরএনএ-ভিত্তিক কোভিড টিকা তৈরির সিদ্ধান্তে অটল থাকেন শাহিন ও টুরেচি। বায়োএনটেক এখন ৮৫০ কোটি ডলার মূল্যের প্রতিষ্ঠান। প্রকাশিতব্য বই দ্য ভ্যাকসিন-এ উঠে এসেছে এসব তথ্য।
থমে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও ফাইজার ও ড. ডরমিটজারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়নি শাহিন ও টুরেচির। কারণ ড. শাহিন বুঝতে পেরেছিলেন, ফাইজারের ভাইস-প্রেসিডেন্টের চিন্তা যুক্তিসংগত।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফকে ড. শাহিন বলেন, 'ফিলকে প্রথমবার ফোনকল দেওয়ার পর কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলেছিলাম, "কয়েক সপ্তাহ পর আবার ওকে ফোন দেব।"'
এই বিজ্ঞানী দম্পতি ভেবেই রেখেছিলেন, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির মন বদলাতে বেশিদিন লাগবে না। তাদের ভাবনা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। এর এক মাস পরই দুই কোম্পানির মধ্যে চুক্তি হওয়ার ঘোষণা আসে।
এখন পর্যন্ত ১২০টির বেশি দেশে ফাইজার-বায়োএনটেকের এমআরএনএ প্রযুক্তির টিকার ১৪০ কোটি ডোজ সরবরাহ করা হয়েছে। ফাইজারের চেয়ে বেশি টিকা বিতরণ করতে পেরেছে কেবল চীন।
শাহিন ও টুরেচির এসব গল্প উঠে এসেছে প্রকাশিতব্য দ্য ভ্যকসিন-এ। এ সপ্তাহেই প্রকাশ পাবে বইটি। এই দম্পতির সহায়তায় বইটি লিখেছেন সাংবাদিক জো মিলার।
তুরস্ক থেকে ছেলেবেলায় শাহিন ও টুরেচি কীভাবে জার্মানিতে অভিবাসী হলেন, তারপর হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে দুই তরুণ ডাক্তারের পরিচয় হলো, এরপর সেখান থেকে দুজনে মিলে কীভাবে দু-দুটো বিলিয়ন-ডলার মূল্যের বায়োটেক কোম্পানি গড়ে তুললেন—সে গল্প আছে উঠে এসেছে এ বইয়ে। এতে আছে ২০২০-এর গোড়ার দিকে কী করে তারা ঝুঁকি নিয়ে কোভিড টিকা তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সেই গল্পও।
ফাইজার তাদের ফিরিয়ে দিলেও হতোদ্যম হননি শাহিন-টুরেচি। ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক চীনা গবেষকের নিবন্ধ পড়ে এই দম্পতির মনে বিশ্বাস জন্মে যায় যে একটা মহামারি আসছে। আর সেজন্য তাদের কাজে নামা উচিত।
ওই নিবন্ধ থেকেই প্রথম জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভাইরাসটি মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ড. শাহিন পেয়েছিলেন এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। নিবন্ধে সাত বছর বয়সি এক মেয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। মেয়েটি করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েছিল অথচ তার মধ্যে করোনার কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি।
এই তথ্য থেকেই সামনে কী হতে চলেছে, তার একটা ছবি ফুটে ওঠে শাহিনের মনে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মহামারি আসন্ন।
তিনি বলেন, 'আমি হিসাব করে দেখেছিলাম, (ভাইরাসটি) ইতিমধ্যে ক্যান্সারের মতো ছড়াচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সারেরও কোনো উপসর্গ দেখা যায় না।'
ফাইজার-বায়োএনটেক টিকার দাম অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তুলনায় বেশি হওয়ায় বেশ সমালোচনা হয়েছে। প্রকাশিতব্য বইয়ে উল্লেখ আছে, ব্রাসেলসের একদল লবিস্ট ইইউকে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা না কেনার জন্য চাপ দিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, এতে বিপুল পরিমাণ টাকা আমেরিকায় চলে যাবে।
ড. শাহিন বলেছেন, এ টিকা বিক্রি করে তারা যে অর্থ পেয়েছেন, তা অন্য রোগের টিকা তৈরির গবেষণায় কাজে লাগাতে পারবেন। তিনি আরও দাবি করেন, ফাইজার-বায়োএনটেক টিকার মূল্য নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য যথেষ্ট সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো আগামী বছরের শেষ নাগাদ ২০০ কোটি ডোজ ফাইজার টিকা পাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ফাইজার টিকার প্রযুক্তির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। ফলে ওসব দেশে স্থানীয়ভাবে ফাইজার-বায়োএনটেক টিকা উৎপাদন করা যাবে।
হাহিন-টুরেচি দম্পতি আশাবাদী যে, অদূর ভবিষ্যতে ক্যান্সারের মতো রোগের জন্য এমআরএনএ টিকা তৈরি করা সম্ভব হবে। ড. শাহিনের তো বিশ্বাস, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই ক্যান্সারের টিকা আবিষ্কার সঙ্গে। এ ব্যাপারে স্বামীর সঙ্গে একমত ড. টুরেচিও।
- সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ