কোভিড-১৯ টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের মৃত্যুর আশঙ্কা ১১ গুণ বেশি: গবেষণা
সম্পূর্ণ ডোজ কোভিড-১৯ টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের তুলনায়, যারা টিকা নেয়নি তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশঙ্কা ১০ গুণ বেশি এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা ১১ গুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) থেকে শুক্রবার প্রকাশিত তিনটি প্রধান গবেষণার একটিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এই গবেষণাটি মূলত উচ্চ সংক্রমণের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে বাঁচতে, বুস্টার ডোজ বা তিন ডোজ টিকা নেওয়ার ওপরেই জোর দিচ্ছে।
দ্বিতীয় গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোধে ফাইজার-বায়োটেক এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার তুলনায় মডার্নার টিকা বেশি কার্যকর।
টিকার কার্যকারিতা অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গবেষণা এটি। উল্লিখিত তিনটি টিকার কার্যকারিতা যাচাইয়ে দেশটির ৯ টি অঙ্গরাজ্যের হাসপাতাল এবং এর জরুরি বিভাগের সঙ্গে জড়িত ৩২ হাজার রোগীর উপর ভিত্তি করে করা এ গবেষণা চালানো হয়েছে।
প্রাথমিক গবেষণায় বলা হয়েছিল, হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধে তিনটি টিকা সম্মিলিতভাবে ৮৬ শতাংশ সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তবে, ফাইজার (৮০ শতাংশ) এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের (৬০ শতাংশ) তুলনায় মর্ডানার (৯৫ শতাংশ) কার্যকারিতা বেশি।
গত আগস্ট মাসে মায়ো ক্লিনিক হেলথ সিস্টেম ঠিক এমনই একটি গবেষণা ছোট পরিসরে চালিয়েছিল; সেখানেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় ফাইজার এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের তুলনায় মর্ডানাকেই বেশি কার্যকর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে সেই গবেষণার পিয়ার-রিভিউ করা সম্ভব হয়নি এখনো।
এদিকে, মারাত্মক অসুস্থতা এবং মৃত্যুর হার কমাতে, যেই ব্র্যান্ডের টিকাই পাওয়া যাক না কেনো সেটিই নেওয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শুক্রবার হোয়াইট হাউজের করোনাভাইরাস ব্রিফিংয়ে সিডিসি-এর পরিচালক রোচেল ওয়ালেনস্কি বলেন, "মূল কথা হলো, এই মহামারি থেকে বাঁচতে আমাদের যেসব বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম প্রয়োজন, তা আমাদের কাছে রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "টিকা কাজ করে এবং কোভিড -১৯- এর মারাত্মক জটিলতা থেকে টিকাই আমাদের রক্ষা করবে।"
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে ৬ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত ৮ দিনের হিসাবে প্রতিদিনের গড় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। অথচ মার্চের প্রারম্ভ পর্যন্তও পরিস্থিতি এমন ছিল না।
সিডিসি'র হিসাব অনুযায়ী, নতুন আক্রান্তদের প্রায় ৯৯ শতাংশই এখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত। তাই ডেল্টা মোকাবেলায় এবং মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া রোধে কর্তৃপক্ষ বুস্টার ডোজের অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
মার্কিন ঔষধ প্রশাসন বিভাগের তথ্যমতে, বুস্টার ডোজের অনুমোদন পাওয়া প্রথম ব্র্যান্ড হতে চলেছে ফাইজার-বায়োটেক। সুরক্ষা বৃদ্ধিতে কোম্পানিটি দুই ডোজের পর, তৃতীয় ডোজের কার্যকারিতা সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত ইতোমধ্যেই জমা দিয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া, সামনের মাসগুলোতে, অন্যান্য টিকার বুস্টার ডোজের অনুমোদন দেওয়া হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
অন্য দু'টি টিকার তুলনায় মর্ডানার কার্যকারিতা ঠিক কী কারণে বেশি, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি সিডিসি'র প্রতিবেদনে। এর একটি কারণ হতে পারে, মডার্নার ডোজ ফাইজার-বায়োটেকের ডোজের তুলনায় তিনগুণ বেশি। আর এই কোম্পানি দু'টির দুই ডোজ টিকার মাঝে সময়ের ব্যবধানেও পার্থক্য রয়েছে। ফাইজার-বায়োটেকের দুই ডোজের মাঝে সময়ের ব্যবধান তিন সপ্তাহ; অন্যদিকে মডার্নার ক্ষেত্রে এই ব্যবধান চার সপ্তাহ। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ডোজগুলোর মধ্যে দীর্ঘ ব্যবধান, বিশেষ করে চার সপ্তাহের বেশি ব্যবধান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে বেশি কার্যকর।
তবে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মারাত্মভাবে অসুস্থ হওয়া এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোধে টিকার কার্যকারিতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ভাইরাসটির ক্রমাগত ধরন পরিবর্তনকে নির্দেশ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।
তবুও, মারাত্মক অসুস্থতা এবং হাসপাতালে ভর্তি রোধে তিন ডোজ টিকা সব প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রায় ৮২ শতাংশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে বলে জানিয়েছেন তারা।
সিডিসি'র আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিস্তারের পর ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় টিকার কার্যকারিতা কিছুটা কমেছে। কিন্তু গুরুতর রোগ এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা আগের মতোই শক্তিশালী আছে।
এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট মেহুল সুথার বলেন, "টিকার মাধ্যমে ৮০ শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া, নিঃসন্দেহে একটি ভালো সংবাদ। টিকাগুলো এখনো উচ্চ সংক্রমণের ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করছে।"
গত বসন্তের তুলনায় টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ও মৃত্যুর হার উভয়ই বেড়েছে। সিডিসি জানিয়েছে, ২০শে জুন থেকে ১৭ই জুলাইয়ের মধ্যে কোভিড-১৯ জনিত অসুস্থতায়, টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের ১৭ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৬ শতাংশের, যা গত বসন্তের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
এছাড়া, জনসংখ্যার বড় অংশের হিসাব করলে টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথের ইন্টারন্যাশনাল ভ্যাকসিন অ্যাক্সেস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক উইলিয়াম মোস বলেন, "টিকাগুলো মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তবে আমি মনে করি, টিকার ব্যাপারে আমরা অনেক উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে রেখেছি। টিকা মারাত্মভাবে অসুস্থ হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে পারে, সংক্রমণ থেকে নয়।"
তৃতীয় গবেষণাটিতে দু'টি এমআরএনএ টিকা, মর্ডানা এবং ফাইজারের কার্যকারিতা যাচাই করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এমআরএনএ টিকাগুলো হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধে ৮৭ শতাংশ কার্যকর ছিল এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার রোধেও ছিল বেশ কার্যকর।
তবে এখন, হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধে ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে এর কার্যকারিতা নেমে এসেছে ৮০ শতাংশে; অন্যদিকে, ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের মধ্যে কার্যকরিতা ৯৫ শতাংশ।
শুক্রবার প্রতিবেদনগুলোয় যে তথ্য উঠে এসেছে তা মূলত এটিই নির্দেশ করছে, শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট বাইডেনও কীভাবে বারবার সিডিসি'র পুরনো তথ্যই ব্যবহার করে যাচ্ছিলেন। পুরনো প্রতিবেদনের আলোকে তারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং মৃত্যু হারকে কম হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, টিকা অত্যন্ত উপকারী; কিন্তু এটি উচ্চ সংক্রমণ রোধ, প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানা সাপেক্ষেও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট