চশমা কি কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে?
চশমা পড়াটা অনেকের জন্য নিতান্ত প্রয়োজন। কারো কারো জন্য তা নিতান্তই ফ্যাশন। কিন্তু, চশমা পরে কী মহামারির কালে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব? আর যারা কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন, তারাও কী সুরক্ষিত থাকতে পারবেন? মহামারির প্রথমদিকে যখন চোখের মাধ্যমেও জীবাণুর সংক্রমণ হয়, এমন তথ্য জানা যায়- তখন বেশ বিভ্রান্তিতেই তৈরি হয় এসব প্রশ্ন ঘিরে।
শুধু সাধারণ মানুষ নন, বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চিত ছিলেন না অনেক ব্যাপারে। যেমন; যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অপথালমোলজিক্যাল সোসাইটি ওই সময় জানায়, কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারকারীদের হাতের মাধ্যমে চোখ স্পর্শ করতে হয়, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই তাদের উচিৎ চশমা পরা।
তার কিছুদিন পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত মতামত নিবন্ধে সতর্ক করা হয় যে, চশমা পরলেও সংক্রমণের বাড়তি ঝুঁকি থাকে। কারণ, মাঝেমধ্যেই পরিধানকারীকে হাত দিয়ে চশমার ফ্রেম ঠিক করতে হয়।
প্রাথমিক এসব পরামর্শই মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। দৃষ্টিশক্তির তীব্র সমস্যা আছে- এমন ব্যক্তিদের জন্য যা ছিল খুবই অস্বস্তির ব্যাপার। তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না- আসলে কোনটা সঠিক।
তবে গত সেপ্টেম্বরে চীনের শিঝু জেংদু হাসপাতালের তথ্য নিয়ে একটি বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশিত হয়। হাসপাতালটি বিশ্বে প্রথমবার ভাইরাসটি হানা দেওয়ার স্থান উহান নগরী থেকে মাত্র ৯০ কি.মি. দূরে শিঝুতে অবস্থিত। চীনে যখন সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল, তখন এই হাসপাতালে অনেক কোভিড রোগীর চিকিৎসা করা হয়।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, নিয়মিত চশমা ব্যবহার করা রোগী সেখানে খুব কমই ভর্তি হয়। চীনের মোট চশমা পরিধানকারী জনসংখ্যার সঙ্গে হাসপাতালে আসা রোগীদের জন্য যে শতকরা হার থাকা উচিৎ তার তুলনা করে তারা এবিষয়ে নিশ্চিত করেন। অর্থাৎ, চশমা পরে সবসময় কোভিড-১৯ এর চক্ষু সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা যায়, গবেষণাটি সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফলটি শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এনিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
তবে মনে রাখা উচিৎ, এটা কোনো পরীক্ষা নয় বরং একটি পর্যবেক্ষণ ছিল মাত্র। এর বেশ কিছু বিষয়ও ছিল অসম্পূর্ণ। যেমন; চিকিৎসকরা রোগ নিরাময়ে সাহায্য পান প্রমাণিত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। গবেষকরা নিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যার মধ্যে পরীক্ষা না করায়; চশমা না পরলে সংক্রমণ হার কেমন দাঁড়ায় সে সম্পর্কিত তথ্যও দিতে পারেননি।
বোস্টন ভিত্তিক ম্যাস আই অ্যান্ড ইয়ার হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ মার্লিন ডুরান্ড জানান, ''চীনা গবেষণা পদ্ধতিটি বেশ অপ্রচলিত। তাদের পর্যবেক্ষনের আওতায় ছিলেন ২৭৬ জন রোগী। কিন্তু, এসব রোগীর কেউই কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারকারী ছিলেন না। নমুনা জনসংখ্যায় আরও ছিলেন না চোখে অপারেশন করা হয়েছে এমন রোগীরাও। তাই এধরনের ফলাফল সব দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তো মোটেই নয়। কারণ এদেশে মোট সাড়ে ৪ কোটি মানুষ কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন।''
দেশটির কেন্দ্রীয় রোগ প্রতিরোধ কেন্দ্র- সিডিসি'র দেওয়া উপাত্ত অনুসারে, ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে ১৬ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মার্কিন নাগরিক কন্ট্যাক্ট লেন্স পরেন।
লেন্স ব্যবহারকারীদের কী করা উচিৎ?
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলমার আই ইনস্টিটিউডের অপথালমোলজির অধ্যাপক এলিয়া ডুহ বলেন, ''চীনের গবেষণায় হয়তো ফলাফল নিয়ে একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছে। তবে এটাও ঠিক, এমন অনেক প্রমাণ ইতোমধ্যেই মিলেছে যার ভিত্তিতে বলা যায়, খালি চোখের চাইতে আবরণের আড়ালে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পায়। এটা মাস্ক পড়ার মতো সুরক্ষা না দিতে পারলেও, সংক্রমণ এড়াতে অনেকটাই সাহায্য করে।''
সার্স কোভ-২ জীবাণু আর চোখ:
ইতোপূর্বে, মার্কিন জীবাণু বিশেষজ্ঞ জোসেফ ফেয়ার বিমানে ভ্রমণের সময় খালি চোখে থাকার কারণে তিনি সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানান। ফ্লাইটে তিনি মাস্ক এবং গ্লাভস ঠিকঠাকই পরেছিলেন, শুধু যাত্রীভর্তি বিমানে কোভিড প্রতিরোধী গগলস পরতে ভুলে যান। সেসময় তিনি কোনো লেন্স বা চশমাও পরেননি। তার ওই চোখের মাধ্যমে সংক্রমণের দাবি নিয়ে জনস হপকিন্সের যে গবেষক দলটি অনুসন্ধান করছে এলিয়া ডুহ তাদেরই একজন।
গত জুনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শীর্ষ সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণাও তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। নিবন্ধটি জানায়, চোখ ঢাকা থাকলে কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি কমলেও, সেটি মাস্ক পরা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো ফলপ্রসূ নয়।
এসব তথ্যাবলির ভিত্তিতেই ডাহ মনে করছেন, খালি চোখের চাইতে বাড়তি আবরণ সংক্রমণ প্রতিরোধে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়।
তবে চক্ষু কোষের টিস্যুতে সার্স কোভ-২ ভাইরাস প্রবেশে সহায়ক প্রোটিন আছে কিনা- তা নিয়ে জনস হপকিন্সের বিশেষজ্ঞ দলটি ইতোপূর্বে একটি গবেষণা করেছেন। চোখের উপরিভাগে থাকা ACE2 এবং TMPRSS2 নামক দুইটি মূল প্রোটিন নতুন করোনাভাইরাসকে প্রবেশ করতে দেয় বলে তারা প্রমাণ পান। এভাবেই চোখের মাধ্যমে জীবাণুটি মানবদেহে অনুপ্রবেশ করে।
ডাহ বলেন, চক্ষুনালী অশ্রুগ্রন্থির মাধ্যমে আমাদের নাক এবং গলার সঙ্গে যুক্ত। তাই চোখ কচলালে বা নাক স্পর্শ করলে তার মাধ্যমেও সরাসরি সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই লেন্সের চাইতে চশমা পরা বেশি নিরাপদ। তবে সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, কোভিড প্রতিরোধী গগলস পরা।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন