চিরায়ত সমস্যাগুলোই ভারতের কোভিড সঙ্কটের জন্য দায়ী
ভারতকে বিশ্বের ফার্মেসি হিসেবে তুলে ধরে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিচ্ছিলেন দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা। সস্তায় বিপুল পরিমাণে টিকার ডোজ উৎপাদনের মাধ্যমে ভারত বিশ্ব মহামারি দূর করার লড়াইয়ে মূল সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা রাখবে, এমন সব কথা তারা বার বার বলছিলেন।
আরেক পা এগিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, ভারত তার মহামারি প্রতিরোধের লড়াইয়ে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এমনকি আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার আভাসেও ছিল অর্থনীতিতে সুদিন ফিরে আসার ব্যাপক ইতিবাচক সুর। আরবিআই বলে, "ভারত রেখাচিত্রে সংক্রমণ হারের ঊর্ধ্বমুখী গতিকে বাঁকানোর ক্ষেত্রে (মানে নিচে নামাতে) ফুটবলার বেকহামের মতো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, যার সুবাদে খুব শিগগির "সঙ্কটের অন্ধকার শীত কাটিয়ে আলো ঝলমলে বসন্তে পা রাখবে অর্থনীতি।"
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিকট অতীতের এসব দম্ভকে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু মনে করা যায় না। এখন প্রতিদিন আশঙ্কাজনক গতিতে বাড়ছে সংক্রমণ সংখ্যা ও মৃত্যুর হার, এমনকি গেল শরতকালে দেখা যাওয়া সর্বোচ্চ কেস সংখ্যাকেও সহজেই ছাড়িয়ে তা নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। হাসপাতালের শয্যাগুলো ফুরিয়ে আসার পথে, সঙ্কট দেখা দিয়েছে ভ্যাকসিন ডোজেরও। ভারত সরকার রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও কিছু রাজ্যের হাতে আর মাত্র কয়েকদিন টিকা দেওয়ার মতো ডোজ মজুত আছে।
প্রশ্ন ওঠে, আশা উজ্জ্বল দিন থেকে অন্ধকার এই সময়ে প্রত্যাবর্তন কীভাবে হলো? কোন বিষয়টি অনুধাবনে কর্তৃপক্ষ ভুল করেছেন? উত্তরটাও সহজ, ভারতের অন্য আর দশটা সমস্যার মতোই এক্ষেত্রেও দায়ী; আনুষ্ঠানিক গোঁয়ার্তুমি, উগ্র জাতীয়তাবাদ, জনপ্রিয় রাজনীতির অনুসরণ এবং তার সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার পর্যাপ্ত মিশ্রণ মিলেমিশে আজকের সঙ্কটের জন্ম দেয়। ফলে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউসহ, ভাইরাসের নতুন অভিযোজন মোকাবিলা এবং বার বার জনজীবনে বিপর্যয় ডেকে আনা লকডাউন এড়ানোর ক্ষেত্রে একেবারেই দুর্বল অবস্থানে ছিল ভারত।
তার চেয়েও দুঃখের বিষয়, ভারতীয়রা একা এসব ভুলের মাশুল দিচ্ছেন না। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো 'বিশ্বের এই ফার্মসির' উপর আস্থা রেখেছিল, এখন যখন নতুন ধরনগুলো মারাত্মকভাবে ছড়াচ্ছে ঠিক তখনই তাদেরকে ডোজ সরবরাহ পেতে আরও দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। চোখের সামনে নাগরিকদের প্রাণহানি অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করছে তারা। ভারতের উপর আস্থা রাখা মারাত্মক ভুল কিনা- সেই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আলোচনায় উঠছে।
এমতাবস্থায়, প্রথমেই ভারতীয় কর্মকর্তাদের দাম্ভিকতা ও গোঁয়ার্তুমি নিয়ে আলোচনা করা যাক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, গেল বছর বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর লকডাউন জারির মাধ্যমে রেখাচিত্রে সংরক্রমণ হার বাঁকানো নিয়ে সরকার তাদের নিজস্ব প্রচারকেই অবিবেচকের মতো বিশ্বাস করেছে। তাই যখন ভারতের প্রধান প্রধান কিছু জনবহুল অঞ্চলে ভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্ত হচ্ছিল তখন কর্মকর্তারা টিকাদানের গতি জোরদার করার বিষয়ে খুব একটা উদ্যমী ছিলেন না। ইতোপূর্বে, ভারতে আবিষ্কৃত একটি ভ্যাকসিনকে গেল বছরের ডিসেম্বরে অনুমোদন দেওয়া হলেও, তার দুই সপ্তাহ পরে দেওয়া হয় এর প্রথম ডোজ।
তারপর আসা যাক, জাতীয়তাবাদের প্রভাবের আলোচনায়। ভারতীয় আমলা ও নিয়ন্ত্রকরা যেকোনো সরকারের অধীনেই থাকুন না কেন- তারা গোপন জাতিবিদ্বেষ পোষণ করেন। তাই তারা তৃতীয় মানব ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগের পর্যায়ে থাকা ভারতে আবিষ্কৃত কোভ্যাক্সিনের জরুরী অনুমোদন দিলেন। অন্য্যদিকে, প্রথমে ভারতে মানব ট্রায়াল শেষ করতে হবে- এমন শর্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পাওয়া ফাইজার ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা দুটির অনুমোদনকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) গাইডলাইন অনুসারে, "টিকার প্রভাবে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন বা কার্যকারিতা কম হওয়ার বিশ্বাসজনক বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পূর্ববর্তী ট্রায়ালের তথ্য থাকলেই- সেক্ষেত্রে কোনো দেশ অনুমোদনের পূর্বে ব্রিজিং ট্রায়ালের পদক্ষেপ নিতে পারে।" ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোন বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে পুনঃট্রায়ালের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা সেটা জানানোর প্রয়োজনও অনুভব করেননি। অথচ জনসনের ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে আবির্ভূত ভাইরাসের মারাত্মক ধরনগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত। তাই ভারতে আবার ট্রায়াল চালানোর পেছনে তার যথাযথ কারণ দেখানো আবশ্যক ছিল। উল্লেখ্য, কোম্পানিটি এখনও ব্রিজিং ট্রায়াল শুরুর অনুমোদনের অপেক্ষা করছে।
আর জনপ্রিয়তার রাজনীতির কথা উঠলেই চলে আসে মূল প্রসঙ্গ। সরকারি ব্যয় কমাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতে বেসরকারি বাজারে বিপণনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সেরামের উপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সংস্থাটির প্রধান অ্যাস্ট্রাজেনেকা আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের ডোজ মাত্র ১৫০ রুপি বা দুই ডলারে ভারত সরকারের কাছে বিক্রি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি বার বার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তবে আদর পুনেওয়াল্লা এও জানান যে, এই মূল্য দ্রুত উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর মতো বিনিয়োগের সামর্থ্য দিচ্ছে না। যদিও তিনি বেসরকারি মুক্ত বাজারে ১৩ ডলার বা ১,০০০ রুপি মূল্যে প্রতি ডোজ বিক্রির আশা করেছিলেন। উচ্চদরে রপ্তানি বন্ধের পাশাপাশি সেই প্রত্যাশাও পূরণ না হওয়ায় কমেছে কোম্পানিটির আর্থিক সামর্থ্য।
আবার রপ্তানি বাজারে সময়মতো চালান না যাওয়ায় অ্যাস্ট্রাজেনেকা কর্তৃক আইনি নোটিশের সম্মুখীন হয়েছে সেরাম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, কোম্পানিটির উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করার মতো অর্থের সঙ্কটে। বর্তমানে তারা মাসিক ৫ থেকে ৭ কোটি ডোজ উৎপাদন করছে, কিন্তু বৈশ্বিক চাহিদা পূরণ করতে হলে এর অন্তত দ্বিগুণ সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। নিরুপায় পুনেওয়াল্লা এখন ভারত সরকারের কাছেই ৪০ কোটি ডলারের সাহায্য কামনা করেছেন।
তারপরও, উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ এবং অব্যবহৃত ভ্যাকসিন অবকাঠামোকে উৎপাদন সক্ষম করে তুলতে সংস্থাটিকে সহায়তা করা হচ্ছে না, অথচ বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে এমন পদক্ষেপ নিয়ে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে আরও শক্তিশালী করেছে। ভারত সরকার ডোজ ক্রয় চুক্তি করার ক্ষেত্রেও দেখিয়েছে ধীরগতি। যেমন জানুয়ারিতে সেরামের কাছে ৫ কোটি ডোজের মজুদ ছিল; তারপরও কয়েক সপ্তাহ ধরে সংস্থাটি থেকে টিকা কেনার তাড়া ছিল না সরকারের। এরপর প্রাথমিকভাবে মাত্র ১১ মিলিয়ন ডোজ কেনা হয়। -+
আন্তর্জাতিক নানা পক্ষের সঙ্গে বিদ্যমান চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে শুধু নিজ দেশের চাহিদা পূরণেই ভারতীয় উৎপাদকেরা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা কাজে লাগাবে এবং অত্যন্ত কম মূল্যে সরবরাহ অব্যাহত রাখবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার। এই অবস্থা দেখেই ফাইজারের ভারতীয় শাখা জরুরী অনুমোদন পাওয়ার আবেদন প্রত্যাহার করেছে। এমন পদক্ষেপ মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না।
নিয়ামক সংস্থার এধরনের অনিশ্চয়তায়, কোম্পানিগুলোকে হেনস্থা করায় সরকারি নজির স্থাপন করায় এবং দূরদর্শীতা ও জরুরি তাগাদার অভাবে ভারতে টিকা উৎপাদন করে ন্যায্য মুনাফা অর্জন উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অনুঘটকগুলো শুধু মহামারি প্রতিরোধে নয় বরং ভারতের উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের পথে বাধা। আর এবার পুরো বিশ্বই ভোগ করবে তার পরিণাম।
- লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত