চীন: যে দেশের জনসংখ্যা সঙ্কোচন পুরো বিশ্বের চিন্তার কারণ
এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে মন্থর গতির জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে চীনে, কিন্তু এটি দেশটির ভেতরে যতোটা না প্রভাব ফেলবে- তার চেয়েও বেশি ফেলতে পারে বিশ্বজুড়ে। জনসংখ্যা কমলেও তাতে চীনের অর্থনীতির চাকা অচল হবে না, বরং ধীর লয়ে হলেও আয় বৃদ্ধিও হয়তো অব্যাহত থাকবে। কিন্তু, তার ফলে বাকি বিশ্ববাসীকে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির শ্লথ গতি এবং তার কারণে মূল্যবৃদ্ধির চাপকে মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, তৈজসপত্র থেকে শুরু করে নিত্য-ব্যবহৃত প্রায় সকল পণ্যের উৎপাদক চীন, দেশটি সস্তা শ্রমের ওপর ভর করে সবকিছু কমদামে রপ্তানি করে- এমন ধারণা তখন হয়তো স্থান পাবে ইতিহাস বইয়ের পাতায়।
এক দশক পর পর জনমিতি পরিসংখ্যান করে বেইজিং। সদ্য প্রকাশিত সমীক্ষায় জানা গেছে, গেল বছরের শেষ নাগাদ দেশটির মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪১ কোটি ২০ লাখ। প্রতিবছর বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত জরিপের পর সবচেয়ে দুর্বল গতির। দীর্ঘদিন ধরেই যে জনসংখ্যা কমার প্রবণতা চীনে দেখা যাচ্ছিল, সাম্প্রতিক সমীক্ষা সেটাই নিশ্চিত করেছে। কর্মক্ষম জনসংখ্যাও তার ফলে এক দশক আগের ৭০ শতাংশের তুলনায় বর্তমানে ৬৩.৪ শতাংশে নেমে আসে। একইসময় লাফিয়ে বেড়েছে ৬০ বছর এবং তদূর্ধ অধিবাসীর সংখ্যা। আরও জানা যাচ্ছে, অর্ধেকের বেশি চীনা নাগরিক এখন শহরাঞ্চলেই বাস করেন।
জরিপসূত্রে অনুমান করা যায়, আগামী কয়েক বছরে চীনের জনসংখ্যা আরও কমতে পারে, কিন্তু তার মানেই এই নয় যে- সঙ্কট আসন্ন। জনসংখ্যা ঘাটতির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই এক প্রকার কুস্তি লড়েছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। ২০১০ সালে জাপানের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়, অন্যদিকে এইতো সেদিন, অর্থাৎ ২০২০ সালের জরিপে প্রথম জনসংখ্যা হ্রাস দেখা যায় দক্ষিণ কোরিয়ায়। এছাড়া, ২০০৩ সালের পর গত বছরই প্রথম কমতির কথা জানায় সিঙ্গাপুর। আলোচিত সব কয়টি জাতি দীর্ঘদিন ধরে বয়স্ক সমাজের পরিধি বৃদ্ধি এবং তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কমে যাওয়া উর্বরতা হার নিয়ে যুঝছে। অধিক সন্তান গ্রহণে সরকারি উৎসাহ সত্ত্বেও নাগরিকদের অনিচ্ছা ও অন্যুৎসাহ এক্ষেত্রে আরেক বাধা।
অথচ, এসব দেশে আছে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উচ্চমানের জীবনধারণের সুবিধার মতো প্রথম শ্রেণির অবকাঠামো। প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার কারণে মহামারি পরবর্তীকালের পৃথিবীতে আছে; নতুন প্রজন্মের আরও উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের জোর সম্ভাবনা।
উন্নতির হাত ধরেই আসে জনসংখ্যা হ্রাসের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত উপজাত, কিন্তু তার ফলে চীনের নিজের বাণিজ্যিক যোগ্যতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। আসলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির এটাই প্রচলিত ধারা, যেখানে: জীবনযাত্রার মান বাড়ে, শিক্ষার্থীরা বেশি সময় শিক্ষাগ্রহণে ব্যয় করে, বিয়ে করে দেরি করে, তারপর আগের চেয়েও ব্যয়বহুল জীবনযাপনের খরচ যোগাড় এবং নিজেদের সন্তানদের জন্য আরও বেশি খরচ করার চেষ্টা করে। দেং জিয়াওপিং- এর আমলের 'এক শিশু নীতি' বাতিলের মাধ্যমে বেইজিং অনেক আগেই এই প্রবণতা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে, কিন্তু মনে হয় না তাতে খুব বেশি লাভ হবে। বৈশ্বিক এই প্রবণতার শিকড় অনেক গভীরে যা হয়তো বেইজিংয়ের রাষ্ট্রশক্তির পক্ষেও উৎপাটন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু, বাকি দুনিয়ার জন্য তার পরিণাম হতে পারে আরও উল্লেখযোগ্য। বিগত কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিকাশে চীন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখে। ২০০৭-০৯ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর বিশেষত যা নতুন মাত্রা লাভ করে। এমনকি ২০০০ সালের পর থেকে চীনের মোট দেশজ উৎপাদন গড় হিসেবে প্রতিবছর ৮ শতাংশ করে বেড়েছে। একইসময়ে, বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রে এই গড় ছিল ২ শতাংশের সামান্য কম। সবকিছু ঠিক থাকলে, চলতি ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল নাগাদ এই পাঁচ বছরে চীন বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এক-পঞ্চমাংশ অবদান যোগ করবে। গত এপ্রিলে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর পূর্বাভাস প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে করা নিজস্ব হিসাবে এটি জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। হিসাবটি বলছে, একইসময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও জাপানের অবদান হবে যথাক্রমে; ১৪.৮, ৮.৪ এবং ৩.৫ শতাংশ।
তবে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি দুর্বল হলে বা তা পড়তির মতো ঘটনা ঘটলে, মাথাপিছু জিডিপি বাড়তে থাকলেও সার্বিক প্রবৃদ্ধির গতি কিন্তু কমবে। জনসংখ্যা পতনের এই সম্ভাবনাটিকে মাথায় রেখে প্রবৃদ্ধির হিসাব সংশোধন করা তাই ভেবে দেখা দরকার।
অত্যন্ত কম মাত্রায় এবং ধারাবাহিকভাবে কম মূল্যস্ফীতি হওয়াকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো শুরুতে স্বাগত জানালেও, এখন এই সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন তারা।
পশ্চাদপদ ও দারিদ্রপীরিত অবস্থা থেকে বিশ্বের প্রধান রপ্তানিকারক হয়ে ওঠা চীন- বিশ্বকে তার বিশাল জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে সস্তা শ্রমের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে কম মূল্যে পণ্য যোগান দেওয়ার সক্ষমতা জানান দেয়। এর ফলে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার বড় শক্তিতে পরিণত হয় দেশটি। কিন্তু, শ্রম বাজারটিতে জন-সঙ্কোচনের অর্থ; সেই যুগ এবার অতীতে পরিণত হতে চলেছে।
অর্থনীতিবিদ চার্লস গুডহার্ট ও মনোজ প্রধান ২০২০ সালে প্রকাশিত তাদের "দ্য গ্রেট ডেমোগ্রাফিক রিভার্সাল: এজিং সোসাইটিজ, ওয়েনিং ইন-ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড অ্যান ইনফ্লেশন রিভাইভাল" গ্রন্থে লিখেছেন যে, "বিশ্ব অর্থনীতিতে কম মূল্যের পণ্য রপ্তানিকারক থেকে চীনে ধীরে ধীরে একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে চলে আসার মতো ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার ফলে অদূর ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির সম্ভাব্যতা অনেকগুণ বাড়বে।"
তাহলে দেখা যাচ্ছে সবটাই খারাপ সংবাদ এমনটাও নয়, অন্তত এখনই তেমন বলা যাবে না।
যদিও চীনা অর্থনীতির মডেল এখন আর সস্তা শ্রম নির্ভর নয়, বরং দর কষাকষি করার মতো দামি পণ্য সরবরাহের আগামীদিনের বাস্তবতা- মূল্যস্ফীতি সীমিত রাখার চালিকাশক্তিটিকে ক্ষয় করবে। কিন্তু, মহামারি পরবর্তী টোকিও নগরীর উদ্যান, নাইটক্লাব ও রেস্তোরাঁগুলোতে মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, একটি পড়তি জনসংখ্যার মধ্যেও আর্থিক স্বাচ্ছল্য থাকার কারণে প্রানবন্ত শক্তি থাকতে পারে, যা খরচ প্রবণতাও বাড়ায়। গত দশকে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মন্থর গতির জনসংখ্যা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় যুক্তরাষ্ট্রে, যার পরিমাণ ছিল মাত্র ৭.৪ শতাংশ, মহা-মন্দাকালীন সময়ের ৭.৩ শতাংশের চাইতে এটি সামান্য বেশি। কিন্তু, তারপরও জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি অচল হয়ে পড়েনি।
চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান নেতা হতে চায়, তাহলে এমন বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে, শ্লথগতির জনসংখ্যাই উন্নত রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সেই বাস্তবতা।
- লেখক: এশীয় অর্থনীতি বিষয়ক ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট ড্যানিয়েল মস। ইতঃপূর্বে তিনি ব্লুমবার্গের বৈশ্বিক অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদ শাখায় নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা শাখায় নেতৃত্ব দেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত