টিকা যুদ্ধ: আন্তর্জাতিকভাবে কে এগিয়ে?
বিশ্বজুড়ে দেশগুলো যখন কোভিড-১৯-এর টিকা সংগ্রহের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখনই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টিকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে উঠে গেছে নতুন বিতর্ক।
দেশগুলো নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন টিকা গ্রহণ করবে আর কোনটিকে বাতিল করে দেবে।
এখন পর্যন্ত সর্বাধিক ১১৯টি সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া ভ্যাকসিন হলো অ্যাস্ট্রাজেনেকা। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভ্যাকসিনও এটি। কিন্তু অ্যাস্ট্রাজেনাকার ভারতীয় সংস্করণ কোভিশিল্ড এতগুলো সরকারের অনুমোদন পায়নি।
কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিদের ইইউভুক্ত দেশগুলোতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। কারণ ইইউয়ের ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এ টিকার অনুমোদন দেয়নি। বাংলাদেশ সরকারিভাবে কোভিশিল্ড টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত এই ভ্যাকসিনটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনেরই অনুরূপ। তবু এটি ইইউর ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পায়নি।
ভারত সরকার ইইউয়ের এ ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ইইউয়ের এ সিদ্ধান্ত পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার কোভিশিল্ড টিকা গ্রহণকারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ব্রিটেনে ৫ মিলিয়ন ডোজ কোভিশিল্ড সরবরাহ করা হয়েছে।
অবশ্য ইইউভুক্ত দেশ অস্ট্রিয়া, জার্মানি, স্লোভেনিয়া, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন কোভিশিল্ড গ্রহণকারী পর্যটকদের ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছে।
শেনজেনভিসাইনফো ডটকমের তথ্যানুসারে, ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সির অনুমোদন পায়নি কিন্তু যে দেশে যাবেন সেখানে অনুমোদিত, এমন টিকা গ্রহণকারীদের ঢুকতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এস্তোনিয়া।
স্পেন আইসল্যান্ড, স্লোভেনিয়া ও গ্রিস ইএমএ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়া সমস্ত ভ্যাকসিন গ্রহণ করে। এ দুই সংস্থার অনুমোদন পাওয়া টিকার মধ্যে কোভিশিল্ড আছে।
এখন পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি ইইউভুক্ত দেশ বলেছে তারা ইইউর ঘোষণা মানে না। এই দেশগুলো কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন গ্রহণ করবে। তবে চীনা টিকার ব্যাপারে তাদের এই নমনীয়তা বজায় থাকার সম্ভাবনা কম। ২০১৯ সালে ১২ মিলিয়ন চীনা পর্যটক ইউরোপে প্রবেশ করেছিলেন।
টিকা নিয়ে চিন্তায় আছে কানাডিয়ানরাও। প্রতিবেশী আমেরিকায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এখনও ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদন পায়নি। তাই বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ঢুকতে দেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা নেওয়া কানাডিয়ানরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। আমেরিকার বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে প্রবেশের জন্য এফডিএ-অনুমোদিত টিকা নেওয়া থাকতে হয়। আমেরিকায় প্রবেশের জন্য অবশ্য টিকা নেওয়ার দরকার পড়ে না (ব্রিটেন, ইউরোপ, চীন ও ভারতের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষেধ)।
আমেরিকা অবশ্য ৩০০ মিলিয়ন ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ক্রয়াদেশ দিয়ে রেখেছে। তাই আশা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে শিগগিরই টিকাটি অনুমোদন পাবে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও এর ভারতীয় সংস্করণ অনুমোদন পেয়ে গেলেও চীনা টিকাগুলোর সম্ভবত সেই ভাগ্য হবে না। চীনা টিকাগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি অনুমোদন পেলেও এই টিকাগুলোর ট্রায়ালের তথ্যে কিছু ফাঁকফোকর রয়ে গেছে বলে অভিযোগ আছে।
রাশিয়ার স্পুটনিক ভি, ভারতের কোভ্যাক্সিন এবং কিউবার আবদালা ভ্যাকসিনেরও অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। অভিযোগ আছে রাজনৈতিক কারণে এই দেশগুলো খুব বেশি না ভেবেই নিজেদের উদ্ভাবিত টিকার অনুমোদন দিয়েছে। তাই অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারিতে পড়তে হতে পারে এসব টিকাকে।
পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ, এ ধরনের বিধিনিষেধের ফলে মানুষ ঘর থেকে বের হবে না। বাণিজ্য সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা নিক ক্যারিন বলেছেন, সরকারগুলোর মধ্যে চুক্তি না থাকায় যাত্রীদেরকে নির্বিঘ্নে ভ্রমণের নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহকারী মহাপরিচালক ম্যারিয়েঞ্জেলা সিমাও বলেছেন, যেসব টিকা ডব্লিউএইচও-র জরুরি অনুমোদন পেয়েছে, দেশগুলোকে ওসব টিকা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট।
এদিকে আমেরিকার কয়েকটি রাজ্য ভ্যাকসিন পাসপোর্ট নিষিদ্ধ করে আইন জারি করায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে গেছে। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট নিষিদ্ধ করা রাজ্যগুলোর মধ্যে আছে আলাবামা, অ্যারিজোনা, ইন্ডিয়ানা ও ফ্লোরিডা। যাত্রীদের টিকা নেওয়া না থাকলে ক্রুজ শিপগুলোর জন্য চলাফেরা করা কঠিন হয়ে যাবে।
তবে আশার খবর হলো, গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোভিড-১৯ টিকার মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবিকে সমর্থন দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেকদিন থেকেই এ দাবি জানিয়ে আসছে।
দ্য ল্যানসেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০০টির বেশি দেশ মেধাস্বত্ব উন্মুক্তের দাবিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে দর কষাকষি করছে। তবে ইইউ, জাপান ও যুক্তরাজ্য এ দাবির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো সহজেই টিকা উৎপাদনে যেতে পারবে। বাংলাদেশের সরকারও বারবার বলে আসছে, বাংলাদেশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টিকা উৎপাদন করতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট-এর প্রশান্ত যাদব ল্যানসেটকে বলেছেন, ২০২১-এর অক্টোবরের দিকে টিকার মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দেওয়া হতে পারে। তিনি জানান, মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দিলে টিকার সরবরাহ বাড়তে পারে। অবশ্য সেটা এই বছরে সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে ৩.৭ বিলিয়ন ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। মানুষ এখন দেশের বাইরে ঘুরতে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু ২০২১ সালটা কোভিড হতাশা এবং সীমান্ত পেরোনোর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বছর হয়েই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। যতদিন টিকাযুদ্ধের সুরাহা না হচ্ছে, ততদিন অনেকের জন্য বিদেশভ্রমণ স্বপ্নই থেকে যেতে পারে। দেশের বাইরে ছুটি কাটাতে যাওয়ার জন্য ভ্রমণেচ্ছুকদের কমপক্ষে আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
আপাতত দর্শক হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে টিকা রাজনীতি দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই বিশ্ববাসীর।