টিকে থাকতে অধিক শিশু জন্মহার এবং অভিবাসীর প্রয়োজন দক্ষিণ কোরিয়ার
রেকর্ড পরিমাণ বার্ষিক জনসংখ্যা হ্রাসের মধ্য দিয়ে নতুনবর্ষ বরণ করতে হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার। দুর্ভাগ্যবশত করোনার ভেতর এ সঙ্কট নিরসনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে দেশটিকে।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত রোববার জানিয়েছে, গত বছর জনসংখ্যা কিছুটা কমে ৫১.৮ মিলিয়নে নেমে আসে। জন্মহারে ১০.৬% ধ্বস এবং মৃত্যুহার ৩.১% বৃদ্ধির ফলে তৈরি হয়েছে এমন পরিস্থিতি।
গত বছরের এই অবস্থাসহ তার আগের কয়েক বছরেও জন্মহার বৃদ্ধির হার কমতে থাকার ফলে দক্ষিণ কোরিয়াও এখন প্রতিবেশী দেশ জাপানের সাথে যোগ দিয়েছে জনসংখ্যা পতনের সূচকে। দেশটির জাতীয় সংবাদ সংস্থা ইয়োনহাপ এর তথ্য মতে, এই পরিস্থিতির "মৌলিক পরিবর্তনের" আহ্বান জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দ. কোরিয়ার জনসংখ্যার এই সঙ্কটের জন্য আংশিকভাবে দায়ী ১৯৬০-এর দশকে সামরিক সমর্থিত প্রশাসন কর্তৃক আরোপিত পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশটির দারিদ্র্য বিমোচন করা। দারিদ্র বিমোচনে তারা সফল হলেও শতাব্দীর শেষের দিকে তা সূচনা করেছিল জনসংখ্যা হ্রাসের দিগন্ত।
তবে বর্তমান পরিস্থিতির সাপেক্ষে সৌভাগ্যজনক হয়নি এ অর্জন। দক্ষিণ কোরিয়া কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রশংসিত হলেও, ২০২১ সালের তরতাজা অর্থনীতির ক্ষেত্রে রয়ে গেছে বেশ কিছু হুমকি ।
যা নিরসনে অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়াকে জাতীয় নিরাপত্তার জামিনদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীনের ক্রমবর্ধমান তিক্ত বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।
২০১৯ সালে করোনা পূর্ববর্তী সময়ে অনেকেই সুপারিশ করেছিলেন দম্পতিদের আরো সন্তান গ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বৃহত্তর অভিবাসনের জন্য উৎসাহিত করতে। তবে করোনার কারণে তা এখন অবাস্তব হয়ে উঠেছে। অনেক দেশের সীমানা ব্যবহার এখন বন্ধ। দক্ষিণ কোরিয়া নিজেও স্থাপন করেছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। বেকারত্ব নির্মুল এবং রাষ্ট্র যতই প্রণোদনা প্রদান করুক না কেন, সামাজিক যোগাযোগের উপর নিষেধাজ্ঞা আসলে মানুষের মিলনকে উৎসাহিত করেনা। অন্যদিকে, রাজধানী সিউলের বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ জানিয়ে আসছে শিশুদের লালন-পালনের খরচ নিয়ে।
রাজধানী সিউলের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ এবং জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে দেশটির গ্রামঞ্চল। ইয়োনহাপ এর মতে, সিউল এবং এর আশেপাশের এলাকার জনসংখ্যা আসলে বেড়েছে, যা জনসংখ্যার দিক থেকে দেশটির মোট বাসিন্দার প্রায় অর্ধেক।
বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করেছে যে- অনেক গ্রামীণ বাসিন্দা বলেছেন যে, তারা আমার ভ্রমণের সময় অভিবাসন নিয়ে স্বচ্ছন্দে ছিলেন। বিদেশিদের প্রতি আড়ষ্টতার জন্য খ্যাতি সত্ত্বেও, আমার দোভাষী লক্ষ্য করেছেন যে রেস্টুরেন্টের কিছু কর্মচারী ছিল স্থানীয়।
দেশটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত উইসেয়ং-এর চত্বরে একটি ব্যানারে আহ্বান জানাতে দেখা গেছে উত্তর কোরিয়ানদের বিয়ে করার। সেখানে গির্জার হলরুমে একটি ব্যস্ত অফিস ছিল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বধূদের সহযোগিতা প্রদান করতো নিঃসঙ্গ স্থানীয় কৃষকদের বিয়ে করবার জন্য।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই সমস্যা উপদ্বীপে নতুন নয়। যদিও, জাপান দীর্ঘদিন ধরে গভীর জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে আছে। তবে পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র'ও পরিবর্তন ঘটেছে একই ধরনের।
চীনকে একসময় সস্তা শ্রমের একটি সীমাহীন উৎস হিসেবে দেখা হতো, যেখানে এখন একটি মোটামুটি আঁটসাঁট চাকরির বাজার আছে। হংকং এবং তাইওয়ানেও খুব কম জনসংখ্যা উর্বরতার হার। ২০০৩ সালের পর সিঙ্গাপুরে জনসংখ্যা প্রথমবারের মত পতিত হয়ছে। যদিও এই পতনের কারণ হিসেবে মূলত দায়ী করা হয় গভীর মন্দার ভেতর বিদেশীদের চলে যাওয়াকে। নগর-রাষ্ট্রটি বছরের পর বছর ধরে জন্মহার বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই চেষ্টায় উদ্দীপনা যোগ করতে- জন্মদান করলেই বোনাসের ব্যবস্থা করেছিল সিঙ্গাপুর ।
জনসংখ্যা চিত্র রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব নয়। এটা আদৌ হওয়াও উচিত কিনা সে প্রশ্নও ওঠে । সামাজিক দূরত্বের ফলে সবক্ষেত্রেই স্বয়ংক্রিয়তার প্রয়োজনীয়তা আরো জরুরি হয়ে উঠেছে। যার দরুন দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে জনজীবন মোটামুটি শিথিল ছিল সামাজিক দূরত্বের সময়েও (উভয়ই দেশই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' প্রযুক্তির প্রধান রপ্তানিকারক)।
রোবটরা ইতোমধ্যে উভয় দেশের বিমানবন্দরে আগের চেয়ে বেশি কাজ করছে। সিঙ্গাপুরে প্রচলিত ক্যাফেতে রোবটদের ক্যাপোচিনো তৈরি করতে এবং হকার সেন্টারে তাদের পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা যায়। অক্টোবর মাসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক প্রতিবেদনে জানায় যে, জরিপ করা ৪০% এরও বেশি ব্যবসা প্রযুক্তি একত্রীকরণের কারণে তাদের কর্মী সংখ্যা কমাতে যাচ্ছে। ব্যবসা সম্প্রসারণের বিকল্প পরিকল্পনাও এর কারণ ।
এই দশকের মাঝামাঝি সময়ে কর্মক্ষেত্রে মানুষ এবং মেশিনের কাজের পরিধি দাঁড়াবে সমান সমান।
তবে এটা কিছু না করে বসে থাকবার অজুহাত নয়। প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন ২০২০ সালে বেশ কয়েকটি সম্পূরক বাজেট পাশ করেছেন এবং এবছর পরিকল্পনা করেছেন রেকর্ড পরিমাণ ঋণ গ্রহণের। তবে এটা তখনই কাজে দেয়, যখন সুদের হার থাকে খুব কম এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণ তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) ভুক্ত অধিকাংশ সদস্যের তুলনায় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই বলা যায়, সরকারি ব্যয় নির্বাহে রেকর্ড ঋণ নেওয়া আসলে কার্যকর সমাধান আনতে পারবে না।
কিন্তু কিছু পর্যায়ে, এই সহজ অর্থের উৎস অক্ষত রাখা প্রয়োজন। জাপান কয়েক বছর পরপর মন্দাকে প্ররোচিত করে আয়করের উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য ভোগকর বৃদ্ধি করছে। এক পর্যায়ে দক্ষিণ কোরিয়াকেও এই নীতি অনুসরণ করতে দেখা অসম্ভব নয়।
দীর্ঘদিন হলো সংশ্লিষ্টরা আলাপ করছেন এশিয়ার "জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ" নিয়ে, এটি মূলত গতিশীল জনসংখ্যার জন্য ব্যবহৃত একটি রূপক, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে চালিত করবে।
অর্থনৈতিক বাঘ নামের রূপকটিও যে এখন বড় কোনো শহরের জাদুঘরে স্থান পাওয়ার বস্তুতে পরিণত হয়েছে, সেদিকেই ইঙ্গিত দেয় এই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ঘাটতি।
- লেখক: ড্যানিয়েল এশীয় অর্থনীতি নিয়ে ব্লুমবার্গ এ কলাম লেখক। পূর্বে তিনি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ব্লুমবার্গ নিউজের নির্বাহী সম্পাদক থাকাকালে এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন।