ডেল্টা ভেরিয়েন্ট নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি প্রশ্নের উত্তর
ডেল্টা ভেরিয়েন্টের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে বেড়েই চলেছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ। নতুন এ ধরনটি শুধু টিকাদানে পিছিয়ে থাকা দেশ নয়, বরং যুক্তরাজ্যের মতো যেসব দেশ টিকাকরণে এগিয়ে সেখানেও অর্থনীতি পুনঃউন্মুক্তকরণের পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এনিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বাণিজ্যিক তথ্য ও সংবাদ পরিবেশক সংস্থা- ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের ওষুধ শিল্প বিষয়ক মতামত কলামিস্ট স্যাম ফাজেলি ডেল্টা ধরনের বৈশিষ্ট্য ও এর হুমকি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
#প্রশ্ন: ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তার অত্যন্ত দ্রুত ঘটছে, টিকাহীন জনসংখ্যার মধ্যে যার পরিমাণ বেশি হলেও- টিকাপ্রাপ্ত অনেকেই এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই সবার মনেই প্রশ্ন জাগছে যে, টিকা নিলে এই ধরনটির বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা পাওয়া যায়- এই বিষয়টি কতখানি সত্যি?
উত্তর: আসলে বিষয়টি কয়েক রকম ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল ও কিছুটা জটিল। ডেল্টা আসার আগেও আমাদের জানা ছিল, কোনো টিকাই সংক্রমণ থেকে শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। যেমন; বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর দুটি টিকা; ফাইজার- বায়েনটেক এবং মডার্নার আবিষ্কৃত টিকা দুটি মানব ট্রায়ালে ৯০ শতাংশের অধিক কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। যার এর অর্থ ট্রায়াল চলাকালে খুব কম সংখ্যক অংশগ্রহণকারীই পজিটিভ শনাক্ত হন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, ট্রায়ালে অংশ নেওয়াদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা ও তার ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঠেকাতে টিকা দুটি শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়।
তবে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একে সংক্রমণ ঘটাতে অধিক সক্ষম করে তুলেছে। অর্থাৎ, এটি টিকার ফলে গড়ে ওঠা প্রাথমিক অ্যান্টিবডি রক্ষাকবচকে ফাঁকি দিতে পারে। তারপরও টিকাপ্রাপ্তদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি অনেকগুণ কম; আক্রান্ত হলেও তাদের উপসর্গগুলো দ্রুত সেরে যায়।
টিকা নিলেই কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাবেন না বিষয়টি এমন নয়, তবে এমন মানুষদের মৃত্যুর পরিমাণ অনেক কম হবে।
#প্রশ্ন: ডেল্টা কেন একটি মারাত্মক হুমকি? ভাইরাসের ধরনটি কীভাবে কাজ করে?
উত্তর: সার্স কোভ-২ ভাইরাসের অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের তুলনায় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট অভিযোজনের মাধ্যমে এমন কিছু সক্ষমতা অর্জন করেছে যা একে আরও ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক রূপ দিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেওয়ার বৈশিষ্ট্য যার প্রধান কারণ। তাছাড়া, মানব কোষে অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এটি নিজের কপি তৈরিতেও অধিক সক্ষম।
মহামারির প্রথম ঢেউয়ে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের নাক থেকে সোয়াবের মাধ্যমে সংগ্রহ করা নমুনায় যে পরিমাণ ভাইরাস মিলেছিল, তাদের তুলনায় ডেল্টায় আক্রান্তদের সোয়াবের নমুনায় অনেক বেশি ভাইরাস পাওয়া গেছে। এটি ভাইরাসটির অধিক বিস্তার ক্ষমতার প্রমাণ।
এছাড়া, সিঙ্কটিয়াম ফরমেশন নামের একটি প্রক্রিয়াও এজন্য দায়ী হতে পারে। এর মাধ্যমে ভাইরাস আক্রান্ত কোষ সুস্থ কোষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে দ্রুত নিজের কপি তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে পারে।
একারণেই ডেল্টা তুলনামূলক বড় ধরনের গুচ্ছ সংক্রমণ জন্ম দিয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে আক্রান্ত করে আরও সংক্রামক কপি তৈরি করতে পারে। ভাইরাল লোড বেশি থাকার অর্থ আক্রান্ত ব্যক্তির নিঃশ্বাস থেকেও অনেকগুণ বেশি ভাইরাসের সূক্ষ্ম কণা নির্গত হয়; যাতে করে আশেপাশের কোন ব্যক্তিকে আক্রান্ত করার বাড়তি সুযোগ পায় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। তবে অণুজীবের জীবন প্রক্রিয়া বিচারে এটি তার বংশবিস্তার ও অস্তিত্বরক্ষার উচ্চ মানের কৌশল।
#প্রশ্ন: ব্রেকথ্রু ইনফেকশন বা টিকা নিয়েও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কতখানি?
উত্তর: এ প্রসঙ্গে আলোচনা নিয়ে সতর্ক থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, সংক্রমণ প্রতিরোধে কোনো টিকা-ই শতভাগ কার্যকর না হওয়ায় ব্রেকথ্রু ইনফেকশন মোটেও আশ্চর্য বিষয় নয়। তার সঙ্গে আবার নতুন ভেরিয়েন্টের প্রভাব যোগ হয়ে কার্যকারিতার প্রাথমিক হার ক্ষয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো; করোনাভাইরাস শ্বাসযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ নালিতে থাকা কোষ মিউকোসাল মেমব্রেন- এ যুক্ত হয়ে মানুষকে সংক্রমিত করে। এসব কোষে ভ্যাকসিন সৃষ্ট অ্যান্টিবডি অনেক সময় কম থাকায় ভাইরাস সেখানে সহজেই প্রাথমিক ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। তারপরও, টিকাপ্রাপ্তদের গুরুতর অসুস্থতা বা উপসর্গ ছাড়া শুধুমাত্র সংক্রমিত হওয়া নিয়ে খুব বেশি চিন্তার কোনো কারণ নেই।
#প্রশ্ন: এপর্যন্ত কতখানি মারাত্মক ব্রেকথ্রু কেস দেখা যাচ্ছে? টিকাদানে এগিয়ে থাকা যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলের মতো রাষ্ট্রেও ডেল্টা বিস্তার লাভ করতে থাকায় ব্রেকথ্রু কেস কতোটা উদ্বেগজনক?
উত্তর: সৌভাগ্যের বিষয় ব্রেকথ্রু সংক্রমণে টিকাপ্রাপ্তদের অসুস্থ হওয়ার ঘটনা তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। (যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলে ফাইজার টিকা জাতীয় টিকা কর্মসূচিতে প্রাধান্য পায়) ডেল্টা ধরনের আবির্ভাবের পরও মারাত্মক অসুস্থতা বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঠেকাতে ভ্যাকসিনটি উচ্চ কার্যকারিতা ধরে রেখেছে।
আবার টিকাপ্রাপ্তরা আক্রান্ত হলে তাদের ইমিউন সিস্টেম তাৎক্ষনিক যে প্রতিরোধ গড়ে তার ফলে মাথাব্যথা, সর্দি এবং মাংসপেশি বা হাড়ের জোরায় ব্যথার মতো মৃদু উপসর্গ দেখা যায়।
তবে সকল বয়সী ও স্বাস্থ্যগত অবস্থার ব্যক্তির মধ্যে টিকার কার্যকারিতা এক রকম নয়। কোনো কোনো টিকার প্রভাবে কিছু মানুষের মধ্যে অন্যদের চেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া গড়ে উঠতে পারে। ফলে সংক্রমিত হলে এসব মানুষের শারীরিক প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন রকম হয়। কাউকে কাউকে দেখে তাদের সাধারণ সর্দি-কাশি হয়েছে বলে মনে হতে পারে।
অন্যদিকে, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অধিকারী টিকাপ্রাপ্তরা মৃদু সংক্রমণের শিকার হতে পারেন। সময়ের সাথে সাথে দেহের রক্তরসে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমে যাওয়াও এজন্য দায়ী হতে পারে।
#প্রশ্ন: এরকম মৃদু ব্রেকথ্রু কেস কী আশঙ্কাজনক?
উত্তর: এক্ষেত্রেও একাধিক ঘটনা ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমত; আপনি টিকা নিয়েও মৃদু সংক্রমিত হলে আপনার থেকে ভাইরাস টিকা না পাওয়া আরেকজনের দেহে বাসা বাঁধতে পারে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, টিকাপ্রাপ্তদের মধ্যে এধরনের পারস্পরিক সংক্রমণ বেশ কম।
এভাবে ভাইরাসে নতুন অভিযোজনের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা হয়তো একসময় টিকাপ্রাপ্তদের আরও জোরালো ভাবে আক্রমণের শক্তি অর্জন করবে। তবে টিকার প্রভাবে সংক্রমণের মাত্রা ও সময় কমে যাওয়ায় ভাইরাস এ ধরনের অভিযোজন করার সুযোগ তেমন একটা পায় না। তবে টিকা নেওয়ারা ডেল্টার কারণে লং কোভিডের মতো দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগতে পারে। বর্তমানে এ বিষয়টিকেই আমার সবচেয়ে উদ্বেগজনক বলে মনে হচ্ছে।
#প্রশ্ন: টিকাভেদে ব্যক্তি বিশেষের ব্রেকথ্রু সংক্রমণের ঝুঁকি কতখানি?
উত্তর: এব্যাপারে এপর্যন্ত পাওয়া সকল তথ্যের উৎস ছিল ল্যাব টেস্ট, যার মাধ্যমে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে প্রদত্ত ডেটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এমআরএনএ প্রযুক্তির টিকাগুলো অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসনের মতো তথাকথিত অ্যাডনোভাইরাল প্রযুক্তির ভ্যাকসিনের চেয়ে উন্নত মানের।
যুক্তরাজ্যে টিকাপ্রাপ্তদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ বা রিয়েল ওয়ার্ল্ড ডেটাও বলছে, আস্ট্রাজেনেকার চাইতে ডেল্টা সংক্রমণ ঠেকাতে ফাইজার-বায়োএনটেক টিকার সফলতা বেশি। তবে ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যে এই হার তুলনামূলক কম বলে উল্লেখ করা হয়।
#প্রশ্ন: ডেল্টাকে ভেরিয়েন্টের হুমকি জানার পর সম্পূর্ণরূপে টিকাপ্রাপ্তরা কী ধরনের বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করতে পারে?
উত্তর: নিজেকে দিয়ে সাবধানতার উদাহরণটি দিতে চাই। যেমন আমি টিকাপ্রাপ্ত হয়েও সুপারমার্কেট বা শপিংমলে মাস্ক পরে যাই। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করলে, কে টিকা নিয়েছেন আর কে নেননি সে সম্পর্কেও জেনে নেই; এরপর সেই অনুসারে তাদের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করি। এখনও রেস্তোরাঁয় বসে খাই না, আর পানশালাও এড়িয়ে চলি। তবে কাজের জন্য ভ্রমণের দরকার হলে তখন অন্তত দুটি মাস্ক পরে বিমানে চড়ি, যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি জনসমাগম স্থল।
#প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমে বয়স্করা টিকা পেয়েছিলেন, এখন তাদের দেহে সুরক্ষা কমে যাওয়া নিয়ে কী আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? ডেল্টার কারণে এ বয়সী মানুষের জন্য কী বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে?
উত্তর: সকল বয়সের মানুষের মধ্যে এমআরএনএ প্রযুক্তির টিকা ভাইরাসের আগের ধরনগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা বয়োবৃদ্ধদের গুরুতর অসুস্থতাও রোধ করেছে। তবে ডেল্টা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ওপর কেমন প্রভাব ফেলে এবং সময়ের সাথে সাথে বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ব্য্যবস্থা কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা এখনও খুব একটা জানতে পারিনি। এ বিষয়টি সামনে আসার আগে অবশ্যই বয়স্কদের নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
#প্রশ্ন: ডেল্টা প্রতিরোধে এখন কী বুস্টার শট বা অতিরিক্ত টিকা ডোজ দেওয়া দরকার?
উত্তর: আমার ধারণা এনিয়ে প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। ডেল্টার পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত বেটা ভেরিয়েন্ট মোকাবিলাতেও প্রস্তুতি রাখতে হবে। ভাইরাসের অভিযোজন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তাই এ মুহূর্তেই যুক্তরাষ্ট্রে বুস্টার শট দেওয়ার প্রয়োজন না থাকলেও; অদূর ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে বাড়তি ডোজ দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।
#প্রশ্ন: শিশুদের ব্যাপারে করণীয় কী?
উত্তর: ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি চিন্তা। এ বয়সীরা সহজে গুরুতর অসুস্থ হয় না এমন একটি ধারণা আছে,
যা কিছু মাত্রায় এটি সত্য হলেও সবার জন্য নয়। কোনো কোনো শিশু সংক্রমণের গুরুতর প্রদাহ- মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোমের (এমআইএস-সি) শিকার হয়। তাই তাদের ব্যাপারেও সাবধান থাকা দরকার।
লেখক: ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের ওষুধ শিল্প বিশ্লেষক এবং ইউরোপিয় মেডিসিন্স এজেন্সির গবেষণা শাখার পরিচালক।