বাস্তুসংস্থান সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার অবস্থায় বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ দেশ
বন্যপ্রাণি এবং তাদের প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংসের কারণে পৃথিবীর পাঁচ ভাগের এক দেশের বাস্তুসংস্থান সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার মুখোমুখি। সুইজারল্যান্ডের বৃহৎ বিমা কোম্পানি সুইস রি' তাদের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ বিপর্যয় তুলে ধরে।
প্রকৃতি মানুষেরই কল্যাণ করে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি আর নির্মল বাতাস আমরা সেই উৎস থেকেই পাই। বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের মতো বিপর্যয় থেকেও মানব বসতিকে সুরক্ষা দেয় বনাঞ্চল। যেমন সুন্দরবন না থাকলে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসে আরও বেশি ক্ষতি হতো বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায়।
অর্থনীতির সংজ্ঞায় একে বলা হয়- প্রাকৃতিক সেবা। আর মানুষেরই কর্মকাণ্ডে এসব প্রাকৃতিক সেবা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সুইস রি' জানায় পৃথিবীর অর্ধেক উৎপাদন ও সেবা প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) বা ৪২ লাখ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্ভরশীল বৈচিত্র্যপূর্ণ অতি-সক্রিয় প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের উপর। কিন্তু, সেটা এখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির তালিকা অনুসারে, জীব-বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সেবা ব্যবস্থা সমূলে বিনষ্ট হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে; অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।
এরপরেই বলা হয়েছে ভারত, স্পেন এবং বেলজিয়ামের কথা। এছাড়া, নাজুক প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং চাষবাসের উপর বেশি নির্ভরশীল দেশ যেমন; পাকিস্তান এবং নাইজেরিয়ার কথাও গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়।
ব্রাজিল এবং ইন্দোনেশিয়ায় এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত বড় আকারের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রয়েছে। যদিও, উভয় দেশই তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরণের উপর নির্ভরশীল। এর মাধ্যমে দেশ দুটির বনাঞ্চল রক্ষা করার গুরুত্ব উঠে আসছে বলে সুইস রি' প্রতিবেদন উল্লেখ করে।
বিমা ব্যবসার বৈশ্বিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত প্রভাবশালী এ কোম্পানিটির মতে, ''পাঁচ ভাগের এক ভাগ দেশে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা এবং জীব-বৈচিত্র্য যেভাবে ভেঙ্গে পড়ছে, তার কারণেই প্রকৃতি থেকে পাওয়া সুফল বা সেবার পরিধি দিনে দিনে কমে আসছে। আগামীদিনে যা বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশের গতি বাধাগ্রস্ত করবে।''
সুইস রি'র সাম্প্রতিক গবেষণা নিবন্ধের মূল লেখক অলিভার স্কেলস্কে জানান, 'ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে যদি প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান থেকে পাওয়া সেবা হারিয়ে যেতে থাকে, তাহলে এসব উপকরণের সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করবে।'
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা জেফ্রি ভন বলেন, আমাদের জানা মতে এটাই প্রথম তালিকা যেখানে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থান নিয়ে সাড়া বিশ্বের নানা স্থানের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এরপর তা সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিতেও তার প্রভাব তুলে ধরা হয়।
বিশ্বের নানা দেশের বিমা প্রতিষ্ঠান যেন প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ঝুঁকি অনুসারে নিবন্ধিত ব্যবসার প্রিমিয়াম ফি নির্ধারণ করতে পারে- সেজন্যেই এটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
তবে ভন জানান, শুধু বিমা খাত নয়, চাইলে নানা দেশের সরকার এবং ব্যবসায়ী মহলও এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরেই জাতিসংঘ জানায়, বিগত এক দশকে অধিকাংশ দেশের সরকার প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান রক্ষায় দেওয়া তাদের অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ইতোপূর্বে, ২০১৯ সালে শীর্ষ বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, পৃথিবীতে প্রাণ ধারণের সহযোগী পরিবেশ যেভাবে নষ্ট হচ্ছে, তা শেষমেষ মানবজাতি বিলুপ্তির কারণ হয়ে উঠবে।
তারা নানাবিধ রোগ-ব্যাধি ও মহামারির প্রকোপ দেখা দেওয়ার সতর্কবার্তাও দেন। তাদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত করেই যেন, বছরের শেষভাগে চীনের উহান নগরে প্রথম করোনার সংক্রমণ দেখা দেয়। যা এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, কেড়ে নিচ্ছে অজস্র প্রাণ। অর্থনীতি স্থবির করে দারিদ্র্য কবলিত করেছে অসংখ্য মানুষকে।
চলমান কোভিড অতিমারিকে তাই প্রকৃতি সংরক্ষণের চূড়ান্ত আহ্বান হিসেবে দেখার অনুরোধ করছেন বিজ্ঞানীরা।
সুইস রি ইনডেক্সটি দশটি প্রাকৃতিক সেবার মাপকাঠির ভিত্তিতে পৃথিবীর প্রতি বর্গ কিলোমিটার জমি সম্পর্কে বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। এ সেবাগুলো হচ্ছে; বিশুদ্ধ পানি, বাতাস, খাদ্য, কাঠ, পরাগায়ন, মাটির উর্বরতা ও ক্ষয় রোধ, উপকূলীয় সুরক্ষা ইত্যাদি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক সুরক্ষার মাত্রকে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
সে অনুসারে বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব দেশের মোট প্রাকৃতিক পরিবেশের ৩০ শতাংশ অঞ্চলে অতি-দুর্বল বাস্তুসংস্থান রয়েছে সেখানে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতি সাতটির ভেতর মাত্র একটি দেশে মোট আয়তনের ৩০ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশ অটুট রয়েছে।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান