ভারতে বেড়ে চলেছে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ সংক্রমণ
ভারতের মুম্বাইয়ের অধিবাসী, পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মিলিন্দ দেশমুখ (৩৫) প্রথমে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ের মাঝেই তিনি সংক্রমিত হন আরেকটি ছত্রাকঘটিত রোগে।
'মিউকরমাইকোসিস' নামক সে রোগের আক্রমণে তার মুখের বড় একটা অংশ সংক্রমিত হয়- যার মধ্যে ডান চোখ এবং তালুও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মিলিন্দ দেশমুখের বড় ভাই জানান, মিলিন্দকে তিনটি অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন এবং তালুর অপসারণের জন্য স্বাভাবিকভাবে কথা বলা বা খাওয়াদাওয়াটা করাটাও তার জন্য সামনের দিনগুলোতে অত্যন্ত কঠিন হতে চলেছে।
শনাক্তকৃত কেসের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান
ভারতে আগেও এই বিরল সংক্রমণে আক্রান্ত রোগী পেয়েছেন চিকিৎসকেরা, তবে বর্তমানে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এবং এ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের ভেতরেই মিউকরমাইকোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে।
বর্তমানে এ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশমুখের তালু অপসারণ করেছেন যিনি সেই চিকিৎসক মুম্বাইয়ের গ্লোবাল হাসপাতালের কান, নাক ও গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ ডা. মিলিন্দ নাভালাখ বলেন, "এখন অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি চলছে"।
২৫ বছর যাবত চিকিৎসা পেশা চর্চা করে আসছেন ডা. নাভালাখ। মহামারির আগে এতদিন প্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ একজন মিউকরমাইকোসিস সংক্রমণে ভোগা রোগী আসতেন তার কাছে।
"অথচ এখন আমি সপ্তাহে ২৫ জনের মত রোগী পাচ্ছি, এদের কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত আবার কেউ বা সুস্থ হয়ে উঠেছেন কোভিড থেকে", জানান তিনি।
মুম্বাইয়ের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত মিউকরমাইকোসিসে প্রায় ২ হাজার আক্রান্ত এবং আটটি প্রাণহানির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তপে ছত্রাকজনিত এ রোগের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে বিশেষ ওয়ার্ড স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন।
বিরল এই সংক্রমণের পেছনের কারণ
মিউকরমাইকোসিস- একটি বিরল তবে বিপজ্জনক ছত্রাকের সংক্রমণ। এক রকম বিষাক্ত ছত্রাকের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এটি 'ব্ল্যাক ফাঙ্গাস' বা জাইগোমাইকোসিস নামেই অধিক পরিচিত।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের মতে এই ছত্রাক পরিবেশে বিশেষত মাটিতে এবং পচনশীল জৈব পদার্থ যেমন পাতা, কম্পোস্টের স্তূপ বা পচা কাঠে বাস করে।
কেউ যখন নিঃশ্বাসের সাথে এই ছত্রাকের বীজগুলো গ্রহণ করে, তখন তাদের সাইনাস বা ফুসফুস এগুলো দ্বারা সংক্রমিত হয়।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ছত্রাকের সংক্রমণকে 'সুযোগসন্ধানী সংক্রমণ' বললেও ভুল হবে না। যারা অসুস্থ অথবা এমন কোন ওষুধ গ্রহণ করছেন যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হ্রাস করে তাদের ওপরে সুযোগ পেলেই এ ছত্রাক আক্রমণ করে বসে।
করোনার চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেরয়েড এ ছত্রাকঘটিত রোগটি বাড়িয়ে তোলে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তারা বলেন, কোভিড-১৯ রোগীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল থাকে এবং হাইপার ইমিউন প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের বেশিরভাগের ওপর স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিউকরমাইকোসিসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস রয়েছে এমন কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মাঝে।
ভারতের বাতাসের নিম্ন মান এবং মুম্বাইয়ের মত শহরের অতিরিক্ত ধূলিকণা ছত্রাকের ছড়িয়ে পড়া সহজ করে দিয়েছে।
ডা. নাভালাখ এর মতে, "ভারতে স্টেরয়েড এবং অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ অপব্যবহারও এই জাতীয় ছত্রাকের সংক্রমণ বাড়িয়ে তুলতে অবদান রাখছে"।
সংক্রমণের মাত্রা
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির চিকিৎসকেরাও ইতিমধ্যে এই কালো ছত্রাকের সংক্রমণ প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছেন।
ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ সুনামির মত আছড়ে পড়েছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ২ কোটি জনসংখ্যার নয়াদিল্লী শহরে এবার সেখানে দ্বিগুণ আতঙ্ক হয়ে এসেছে মিউকরমাইকোসিস বা এই কালো ছত্রাকের সংক্রমণ।
নয়াদিল্লীর গুরুগ্রামের মেদান্ত হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ মেডিসিন এবং সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নেহা গুপ্ত বলেন, "আমরা বর্তমানে এ রোগে সংক্রমিত দুই থেকে তিনগুণ বেশি রোগী দেখতে পাচ্ছি"।
আলগা বা পড়ে যাওয়া দাঁত, মুখে তীব্র ব্যথা এবং মুখে ফোলাভাবের মতো লক্ষণ নিয়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে আসছেন বলে জানান ডা. গুপ্ত।
তিনি আরও বলেন, "আগে যারা আসতেন তারা সকলেই সড়ক দুর্ঘটনা বা তীব্র ডায়াবেটিসে ভুগে মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্তের লক্ষণ নিয়ে আমাদের শরণাপন্ন হতেন। কিন্তু এখন যারা আসছেন, তারা সকলেই কোভিড-১৯ এর রোগী"।
এছাড়া কাটা অঙ্গ বা ত্বকের বিভিন্ন আঘাতের ফলেও মিউকরমাইকোসিস দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে এমন কারো ক্ষেত্রে সংক্রমণের মাত্রা অধিক।
পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটে, কালো ছত্রাকের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের ফলে ইতিমধ্যে হাসপাতালগুলো বিশেষায়িত ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখতে শুরু করেছে।
কর্তৃপক্ষ এ রোগের প্রতিরোধে সহায়ক এমফোটেরিসিন-বি নামক একটি অ্যান্টি-ফাংগাল ড্রাগ মজুতেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
গুজরাট সরকারকে বর্তমানে কালো ছত্রাকের ১০০টি সংক্রমণের ব্যাপারে অবহিত করা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে রাজ্যের চিকিৎসকদের ধারণা।
রাজ্যের সার্জন ডা. দীনেশ হারানি বলেন, "আমি আমার ৩৫ বছরের চিকিৎসা পেশায় মিউকরমাইকোসিসের একজন রোগীও দেখিনি"। অথচ গত কয়েকদিনে তিনি ৫ জন সংক্রমিত রোগীকে অস্ত্রোপচারের জন্য আহমেদাবাদে প্রেরণ করেছেন।
আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে ১৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। অন্যান্য রাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকেও এসেছে সংক্রমণের খবর।
মিউকরমাইকোসিসের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। রোগের একেবারে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সংক্রমিত টিস্যু অপসারণ করতে হয়, এরপর চলে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধের ডোজ গ্রহণ।
মুম্বাইয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তনু সিংহল বলেন, "মিউকরমাইকোসিসকে তুলনা করা যায় ক্যান্সারের সাথে, যা শরীরের কোষে দ্রুত ছড়িয়ে যায়"।
- সূত্র- আল জাজিরা