মিয়ানমারে ক্যু'র আগে ও পরে
মিয়ানমারের নেত্রী ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও তাঁর ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে আজ (সোমবার) ভোরে আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী।
পরে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চি সরকারকে হটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনী।
আজ সোমবার দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেই সঙ্গে একজন জেনারেলকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
প্রশাসনিক রাজধানী নাইপিদোতে মোবাইল ফোন ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং রেডিওর প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
মিয়ানমারের শাসনক্ষমতা কার অধীন
সু চি মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের কন্যা। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অন্তত ১৫ বছর বন্দী জীবন কাটিয়েছেন সু চি।
২০১৫ সালের নভেম্বরে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি এনএলডি'র নেতৃত্ব দেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অহিংস লড়াইয়ের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তিনি।
মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি কারণ তার সন্তানেরা বাইরের দেশের নাগরিক। তবে ৭৫ বছর বয়সী সু চি একজন' ডি ফ্যাক্টো' নেতা হিসেবেই সুপরিচিত।
তবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ স্টেশনে প্রাণঘাতী হামলার পর রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
সু চির সাবেক আন্তর্জাতিক সমর্থকরা তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ধর্ষণ, হত্যা এবং সম্ভাব্য গণহত্যা রুখতে কোন পদক্ষেপ নেননি এবং ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর নিন্দা কিংবা তাদের নৃশংসতার মাত্রাও স্বীকার করেননি।
তবে ২০১৯ সালে হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানিতে সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপের বিষয়ে তার নিজের স্বপক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
সু চি'র আন্তর্জাতিক সুনাম অবশিষ্ট না থাকলেও দেশের ভেতরে এখনো তিনি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী 'তাতমাদো' নামে পরিচিত। প্রায় ৪৯ বছর মিলিটারি জান্তার শাসনে ছিল মিয়ানমার। ১৯৬২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করে বর্মি সামরিক বাহিনী।
এরপর ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধানের ভিত্তিতে ২০১১ সালে দেশটিতে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারই অংশ হিসেবে নিজেদের সমর্থিত ইউএসডিপিকে (ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) গদিতে বসিয়ে মিয়ানমারে রাষ্ট্রপরিচালনার ভার ছেড়ে দেয় তাতমাদো।
তবে সামরিক বাহিনী কখনোই ক্ষমতার ভাগ ছাড়েনি।
দেশটির পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকে তাতমাদোর জন্য। সু চির সরকারেও প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ এবং সীমানা মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয় এখনো তাদের দখলে।
কেন মিলিটারিরা নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করল
গত বছরের ৮ই নভেম্বরের নির্বাচনে সু চি'র এনএলডি পার্টি ৮৩% আসন পায় । অথচ সেনাবাহিনী সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ৪৭৬ টি আসনের বিপরীতে ইউএসডিপি পায় মাত্র ৩৩টি আসন।
মিয়ানমারের পত্রিকা দ্য ইরাবতী জানায়, সাবেক মন্ত্রী এবং কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ইউএসডিপি'র হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পার্লামেন্টের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসন পাওয়ার শর্তও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১১ সালে সামরিক শাসন শেষ হওয়ার পর এটি ছিল মাত্র দ্বিতীয় নির্বাচন।
স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তোলে সেনাবাহিনী। জেলা পর্যায়ে ভোটার তালিকায় অনিয়মের অভিযোগ আনে তারা; সুপ্রিম কোর্টে দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং ইলেক্টোরাল কমিশনের প্রধানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে।
এনএলডি এবং অন্যান্য দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিক্রিয়া
সু চি তার দলের নির্বাচনী বিজয়, বা সেনাবাহিনীর অভিযোগ কোনটির বিষয়ে মন্তব্য করেননি, তবে তার দল এনএলডি থেকে জানানো হয় যে, সেনাবাহিনীর অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং নির্বাচনের কোনরূপ ত্রুটি এ ফলাফল পরিবর্তন করতে পারত না।
ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৯০টি দলের ভেতর ১৭টিই নির্বাচনে ছোটখাটো অনিয়মের অভিযোগ করেন। একমাত্র ইউএসডিপি ব্যতীত এদের সবগুলোই ছিল ছোট দল। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও উল্লেখ করেছিলেন যে, বড় ধরনের অনিয়ম ছাড়াই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে ।
নির্বাচনী কমিশন গত বৃহস্পতিবার জানায় যে, এমন কোন ত্রুটি বা জালিয়াতির ঘটনা ঘটেনি যার জন্যে নির্বাচন ফলাফল বাতিল করতে হবে।
সেনা প্রতিক্রিয়া
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাও মিন তুন গত সপ্তাহে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেও সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি সুস্পষ্ট কোন উত্তরই দেননি।
তিনি জানান, সেনাবাহিনী 'পদক্ষেপ গ্রহণ করবে' এবং প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবে। সামরিক বাহিনী নতুন সরকার ও আইনসভাকে সহযোগিতা করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন "অপেক্ষা করুন ও দেখুন"।
অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলেও বলেছিলেন " এখনই বলা যাচ্ছেনা"।
যদিও গত শনিবারেই এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সংবিধান মেনে চলা ও আইন অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
দেশটির সংবিধানে যা রয়েছে
মিয়ানমারের সংবিধানে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জরুরি অবস্থা জারির এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের অনুমতি দেয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, " কমান্ডার-ইন-চিফ কেবল এমন চরম পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেন যখন তা 'ঐক্যের বিভাজন, জাতীয় সংহতির বিভাজন এবং সার্বভৌম ক্ষমতা হ্রাস' করতে পারে, তবে শুধুমাত্র জরুরি অবস্থা চলাকালীন, যেটি কেবলমাত্র বেসামরিক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত হতে পারে"।
- বিবিসি ও রয়টার্স অবলম্বনে