যাদের শ্রমে গড়ে উঠেছিল হোয়াইট হাউজ, সেই দাস শ্রমিকদের কাহিনী সন্ধান করছেন ইতিহাসবিদরা
অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক বক্তব্যের মতোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার এক বক্তব্য ব্যাপক সাড়া ফেলে, ইন্টারনেটের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। বক্তব্যটিতে মার্কিন ইতিহাসের এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক উঠে এসেছিল যা নিয়ে সচরাচর বড় কোনো প্লাটফর্মে কথাই বলা হয় না।
সেই বক্তব্যের পর অনেকেরই ধারণা ছিল, তিনি বোধহয় পরবর্তী মেয়াদে নির্বাচনে দাঁড়াতে যাচ্ছেন। ২০১৬ সালের ফিলাডেলফিয়ার ডেমোক্রেটিক কনভেনশনের সময়কার ঘটনা এটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, প্রেসিডেন্সি, জাতিসত্ত্বা এসব বিষয়ে কথা বলছিলেন তিনি। তবে তার বক্তব্যের ভাবার্থের সারমর্ম ও সবচেয়ে সাড়া ফেলা উক্তিটি হলো: "আমি প্রতিদিন সকালে এমন একটি বাড়িতে ঘুম থেকে উঠি যা নির্মিত হয়েছিল দাসদের শ্রমে।"
এই উক্তিটির সঙ্গেই দেশজুড়ে অসংখ্য মানুষ একাত্ম অনুভব করেন বলে মনে করেন হোয়াইট হাউজ হিস্টোরিকাল অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউএইচএইচএ) প্রেসিডেন্ট স্টুয়ার্ট ম্যাকলরিন। বিগত ছয় দশক ধরে হোয়াইট হাউজের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছে সংস্থাটি।
ম্যাকলরিন জানান, মিশেল ওবামার ওই বক্তব্যের পরই ওই লাইনটির পেছনের অর্থ জানতে চেয়ে অসংখ্য মানুষ সংস্থাটিতে কল করে। আসলেই কি দাস শ্রমিকরা হোয়াইট হাউজ নির্মাণের কাজ করেছিল? তারা কোথায় থাকতেন? তাদের নাম কী ছিল?
গত পাঁচ বছর ধরে 'স্লেভারি ইন দ্য প্রেসিডেন্ট'স নেইবারহুড' শীর্ষক একটি প্রকল্পে ডব্লিউএইচএইচএ'র সঙ্গে কাজ করছেন ইতিহাসবিদরা। লাফায়েত স্কয়ারে বাসরত কয়েক শত দাস যারা হোয়াইট হাউজ গড়ে তুলেছিলেন, তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছেন তারা।
প্রকল্পটির ওয়েবসাইটে অ্যাসোসিয়েশন লিখেছে,
"হোয়াইট হাউজের নির্মাণকাজ করেছিল, বাস করতো এমন মুক্ত ও দাস আফ্রিকান আমেরিকানদের ব্যাপারে খুব কম তথ্যই লিখিত আছে। বিভিন্ন চিঠিতে, সংবাদপত্রে, আত্মজীবনীতে, আদমশুমারির রেকর্ডে ও মৌখিক ইতিহাস থেকে তাদের ব্যাপারে জানা যায়।
ম্যাকলরিন জানিয়েছেন, এই গবেষণা এখনো চলমান। তবে এখন পর্যন্তই তারা যা জানতে পেরেছেন তা—জনস্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আগামী ২৮ জুলাই লাফায়েত স্কয়ারের উত্তর দিকের শেষপ্রান্তে এ ঘটনার স্মৃতিবহনকারী তিনটি ফলক উন্মোচন করবে সংস্থাটি। ওই একই স্থানেই এইচ স্ট্রিট ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজা অবস্থিত। এটিকে হোয়াইট হাউজের সঙ্গে দাসত্বের সম্পৃক্ততার সীমারেখাও বলা যায়।
"আমরা জানতাম যে দাস শ্রমিকদের সহায়তায়ই হোয়াইট হাউজ নির্মিত হয়েছিল। তবে আমরা জানতাম না তারা কারা ছিলেন, কীভাবে আমরা তা খুঁজে বের করতে পারি। তারা কী ধরনের কাজ করতেন, কোথা থেকে এসেছিলেন, তাদের কাজ কী ছিল?- এসব কিছুই জানতাম না আমরা।"
ইতিহাসবিদরা বিভিন্ন রেকর্ড ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন, এ কাজে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষককে নিয়োগ দেন। ওইসব গবেষকরা তাদের নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দাসত্বের সম্পৃক্ততা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৭৯২ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রাসাদসম ভবনটির নির্মাণকাজে জড়িত পাথর শ্রমিক, কাঠমিস্ত্রি, কাঠুরে, ইট তৈরি শ্রমিকদের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে শুরু করেন তারা।
সংস্থাটি জানিয়েছে ওই সময়ে দাস শ্রমিকদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকরাও কাজ করতেন, কিন্তু তারা বেতনভুক্ত ছিলেন।
হোয়াইট হাউজ নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন এমন দাস শ্রমিক বা যে ১০ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাদের সময়কালে দাসদের মালিক ছিলেন, এখন পর্যন্ত ইতিহাসবিদরা এমন ৩০০ জনের নামের তালিকা তৈরি করেছেন।
এদের মধ্যে অনেকেরই সম্পূর্ণ নাম জানা যায়নি। ম্যাকলরিন জানান, লাফায়েত পার্কে দাস সম্প্রদায়ের মানুষকে শুধু তাদের মালিকের নামেই তালিকাবদ্ধ করা হতো। এ ব্যাপারে যে কোনো তথ্য জানিয়ে সাহায্যের জন্য একটি ই-মেইলও চালু করেছে সংস্থাটি।
নতুন উন্মোচিত হতে যাওয়া ফলকগুলোতে এসব ইতিহাসের বর্ণনা থাকবে।
ফলকগুলো দেখতে কেমন হবে সংস্থাটি তা প্রকাশ না করলেও ম্যাকলরিন জানিয়েছেন, "ফলকগুলো সম্ভবত হাঁটু সমান উচ্চতার বা এর চেয়ে কিছুটা বেশি উচ্চতার হবে। এই পার্কে যারা শ্রম দিয়েছেন, এই বিশাল বাড়ি নির্মাণ করেছেন, তাদের গল্প জানতে পারবেন।"
১৯৬১ সালে তৎকালীন ফার্স্ট লেডি জ্যাকলিন কেনেডি ডব্লিউএইচএইচএ'র প্রবর্তন করেন, তার জন্মদিনের সকালে সংস্থাটির ৬০ বছর পূর্তির উদযাপনের অংশ হিসেবে ফলকগুলো উন্মোচিত হবে।
তবে ম্যাকলরিন জানিয়েছেন, এ কাজ শেষ হতে এখনো বহু পথ বাকি। তিনি জানান, পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ওইসব শ্রমিকদের বংশধরদের খুঁজে বের করা যারা হয়তো তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস জানেনই না।
"সেন্ট লুইসে কোনো জায়গায় হোয়াইট হাউজ নির্মাণ যুক্ত ছিলেন এমন কোনও শ্রমিকের বংশধরকে খুঁজে পাই তা অসাধারণ ব্যাপার হবে। আমি জানি না তা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, কীভাবে এ প্রক্রিয়া কাজ করবে। তবে আমি মনে করি, আমাদের এ কাজে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো উচিত, এসব ব্যক্তির গল্প মানুষকে জানানো উচিত।"
- সূত্র: এনপিআর