যেভাবে ‘বিয়ে করে’ শিবির থেকে পালিয়ে আসছেন আইএস নারী সদস্যরা
অনলাইনে পরিচয় হওয়া পুরুষদের বিয়ে করে সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত আইএসের শত শত নারী শিবির থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে নিচ্ছেন। নতুন স্বামীদের থেকে উপহার পাওয়া নগদ অর্থ থেকে ঘুষ দিয়ে শিবির থেকে গোপনে পালিয়ে গেছেন অনেকেই।
সম্প্রতি, সিরিয়ার আল-হোল শরণার্থী শিবিরের ওপর নির্মিত এক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরেছে দ্য গার্ডিয়ান।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুসারে, ক্যাম্পে অবস্থানকারীদের কাছে বাইরে থেকে তারযোগে ৫ লাখ ডলারেরও বেশি অর্থ এসেছে। আল-হোলের সাবেক ও বর্তমান ৫০ জন নারী, স্থানীয় কুর্দিশ কর্মকর্তা, অর্থ পাচারের সাথে পরিচিত পূর্ব ইউরোপের একজন সাবেক আইএস সদস্য এবং পাচারের সাথে জড়িত ইদলিব প্রদেশের একজন যোদ্ধার সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে আছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। একইসঙ্গে, অবস্থানরত নারীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বহু দেশ। আটকে পড়া এসব নারীদের জন্য বিয়ে করে শিবির ছেড়ে যাওয়াই এখন সবথেকে সহজ পথ। নারীদের মধ্যে তাই অনলাইনে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে অবস্থাপন্ন পুরুষদের বিয়ে করার চর্চা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
ক্যাম্পে অবস্থানকারী রাশিয়ার একজন নারী জানান, "নিজের জন্য স্বামী খুঁজছি কিনা, তা জানতে চাওয়া বিভিন্ন পুরুষের কাছ থেকে আমি প্রতিদিন টেক্সট পাই।"
"আমার আশেপাশের সবার বিয়ে হয়েছে। তবে, যারা এখনও আইএসকে সমর্থন করেন এবং বদলে যাওয়ার ভান করে থাকেন তারা এসব ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখান না," বলেন তিনি।
২০১৯ সালের মার্চে সিরিয়ায় আইসিসের ঘাঁটি ধ্বংস হওয়ার পর প্রায় ৬০ হাজার নারী ও শিশুকে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি বাহিনী এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত আল-হোল শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল বর্তমানে এসডিএফের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বন্দিশিবিরের নারীদের উদ্ধারে জিহাদি প্রচারণা
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আইএস সমর্থকরা নারীদের এই বন্দিদশার বিরুদ্ধে অনলাইনে সোচ্চার হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিয়ে করে নারীদের বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের জন্য এক নতুন জিহাদি প্রচারণার সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই অনলাইনে সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
আগ্রহী পুরুষদের অধিকাংশই বিভিন্ন মুসলিম দেশের বংশোদ্ভূত এবং বর্তমানে পূর্ব ইউরোপে বসবাস করছেন। ইউরোপে তারা আর্থিকভাবে অবস্থাপন্ন। সামাজিকভাবে নারীদের পাশে দাঁড়াতেই তারা এই পথ বেছে নিয়েছেন।
তবে, সবাই যে শিবির ছেড়ে চলে যান তা নয়। অনেকেই দূর থেকে সম্পর্ক রক্ষা করেন। শিবিরের নারীদের জন্য এই সম্পর্ক আয়ের নিশ্চিত পথ হয়ে উঠেছে। পাঠানো অর্থের মাধ্যমে শিবিরে তাদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও উন্নত হচ্ছে। দৈনন্দিন খাবার, ওষুধ, ন্যাপি, ফোনের অর্থ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি তারা অর্থের বিনিময়ে রান্না ও ঘরদোর পরিষ্কারের জন্য অন্যান্য নারীদের কাজে রাখছেন।
তবে, কতজন নারী শিবির ছেড়ে চলে গেছেন তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য নেই। তবে দুই বছর আগে আইএস পরিবারের সদস্যরা যখন এখানে আসেন তখন তাঁবুসহ বিভিন্ন জিনিসের সংকট ছিল।
বিদেশি সদস্যরা শিবির ছেড়ে অনেকে চলে যাওয়ায় বা অন্যান্য শিবিরে স্থানান্তরিত হওয়ায় এখন বহু বাসস্থান সম্পূর্ণ ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
বিয়ে পড়ানো
ফোনের মাধ্যমে এই বিয়েগুলো পড়ানো হয়ে থাকে। সাধারণত নারীদের ফোনে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। কোনো কাজীর মধ্যস্থতায় বিয়ে পড়ানোর পর বরকে পাত্রীর নতুন ওয়ালি বা অভিভাবক ঘোষণা করা হয়। নতুন কনে এসময় যৌতুক হিসেবে নগদ অর্থ বা নতুন মোবাইল ফোন উপহার পান।
ভার্চুয়াল এই সম্পর্কগুলো শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নয়। দ্য গার্ডিয়ানের হাতে আসা বহু ইঙ্গিতপূর্ণ ম্যাসেজ এবং ছবি থেকে দেখা গেছে যে সম্পর্কগুলো অনেকক্ষেত্রেই প্রেম কিংবা যৌনতাপূর্ণ।
গতমাসে ইদলিব প্রদেশের একজন যোদ্ধা নিহত হওয়ার পর তার ফোন থেকে আল-হোলে অবস্থানরত একাধিক নারীর সাথে যৌনতাপূর্ণ ম্যাসেজ ও ছবি চালাচালির প্রমাণ পাওয়া যায়।
নারীদের অনেকের প্রকৃত স্বামী এখনো জীবিত অবস্থায় এসডিএফের হাতে আটক আছেন। তবে, এই নারীদের দাবি, তাদের নতুন করে বিয়ে করার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে, কেননা তারা জানেন না যে তাদের স্বামী এখনো মুসলিম আছেন কিনা।
নতুন স্বামী প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হলে অনেকে নতুন করে পুনরায় বিয়েতে বসবেন বলেও মন্তব্য করেছেন।
তবে, সশরীরে নতুন স্বামীর সাথে মিলিত হতে পারাটাই সবথেকে কঠিন বিষয়। আল-হোল থেকে বের হয়ে আসতে ১৫ হাজার ডলারের বেশি খরচ হতে পারে। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই পাচারের পদ্ধতি, জাতীয়তা এবং সন্তানের সংখ্যার ওপর নির্ভর করছে।
সাধারণত ইদলিব প্রদেশের দালালরা পাচারের ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে সব কার্যক্রমই জাতীয়তা এবং ভাষা ভেদে ভিন্ন। যেমন, রাশিয়ার ভাষাভাষী দালালরা কেবল রাশিয়ান ভাষার নারীদের সাথেই চুক্তি করেন।
বের হয়ে আসার সবথেকে ব্যয়বহুল পদ্ধতি হলো ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার। এসডিএফ এবং ইসলামিস্ট চেকপোস্টগুলোতে ঘুষ প্রদানের পর প্রথমে নারীদের ইদলিবের নিরাপদ কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয় আরেকটি উপায় হলো, পানির ট্যাংক, বাস বা অন্য কোনো যানবাহন শিবিরে প্রবেশ করলে ড্রাইভারের সাথে চুক্তি করে সেখানে লুকিয়ে বের হয়ে আসা।
সবথেকে, কম খরচে পালানোর উপায় হলো দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসা কিংবা রাতে গোপনের পালানোর চেষ্টা করা।
এসডিএফ পালিয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে পুরোপুরি অবগত। ঘুষের বিনিময়ে ক্যাম্পের নিরাপত্তারক্ষী বা কর্মীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করার বিষয়টিও তারা জানে।
এসডিএফ মুখপাত্র কিনো গ্যাব্রিয়েল জানান, "আইসিসের পূর্বকার পাচারকারী নেটওয়ার্কের কয়েকটি এখনও সক্রিয় আছে। তবে আল-হোলের কর্মীদের অধিকাংশই সুযোগসন্ধানী হয়ে এসব কাজ করেন। তারা অর্থের লোভে বা হুমকির কারণে এসব করে থাকে।"
তিনি আরও জানান, "পানি নিয়ে আসা ট্রাক ড্রাইভারদের একজন অস্ত্র পাচারের সাথে যুক্ত ছিলেন। খুব সম্ভবত তিনি ধরা পড়েন বা ব্যর্থ হন, যা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে কিছুদিন পর তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।"
যেভাবে চলে লেনদেন
বন্দি শিবিরে অবস্থানকারীদের সাহায্য করার সবথেকে সহজ উপায় হলো নগদ অর্থ পাঠানো। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আইসিস সমর্থক এবং শিবিরে অবস্থানকারীদের পরিবার তারযোগে শিবিরে অর্থ পাঠিয়ে থাকেন।
অধিকাংশ পরিবার ছেলের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের মৌলবাদী চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করতে এসডিএফ পরিচালিত 'ডির্যাডিকালাইজেশন সেন্টারে' পাঠানো হয়। এসব কেন্দ্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃতপক্ষে জেলখানার মতো। ছেলে সন্তানদের বাঁচাতে তাই মায়েরা নিরাপত্তারক্ষীদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে শিবিরের বাইরে পাঠাতে চান।
তবে, আয়ের সবথেকে সহজ ও নিশ্চিন্ত মাধ্যম হলো স্বামীর অনুসন্ধান করা।
প্রতিটি বিয়ের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। প্রথমে শিবিরের নারীরা ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে সিংহ বা অন্য কোনো আইসিস সম্পর্কিত প্রতীকী ছবি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে, মুসলিম উম্মাহকে আহ্বান জানানো হয় তাদের উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসতে।
তবে, আইসিসের কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে তারা ফেসবুক বা ইন্সটার বদলে টেলিগ্রাম বেছে নেন। এনক্রিপ্টেড পদ্ধতি থাকায় এখান থেকে জঙ্গি কার্যক্রমের আলোচনা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
নির্বাচিত স্বামীরা প্রথমে সরাসরি তুরস্কে তারযোগে অর্থ পাঠান। চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে পশ্চিমা দেশ থেকে প্রথমে দ্বিতীয় কোনো দেশে অর্থ পাঠানো হয়। সেখান থেকে অর্থ তুরস্কে যায়, এরপর নগদ আকারে সীমান্ত পার করে অথবা হাওয়ালার মাধ্যমে সরাসরি সিরিয়ায় তারযোগে অর্থ পাঠানো হয়।
আল-হোল পরবর্তী জীবন
আল-হোল ছেড়ে যাওয়া প্রায় প্রত্যেকেই প্রথমে ইদলিব প্রদেশে যান। অনেকেই পুনরায় 'খেলাফত' স্থাপনের স্বার্থে সেখানেই অবস্থান করেন। নতুন করে আইসিসের গোপন ঘাঁটিতে ফেরার চেষ্টাও করেন অনেকে।
ইদলিবের অধিকাংশ অঞ্চল বর্তমানে বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) অধীনে। যেসব নারীরা ইদলিবে থেকে যান তারা অনেকেই এইচটিএস যোদ্ধাদের বিয়ে করেন। আইসিস নারীরের চিন্তাধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এইচটিএসের বহু যোদ্ধা আল-হোলে অর্থ পাঠান।
ইদলিবের সাথে তুরস্কের সীমান্ত রয়েছে। যারা নিজেদের দেশে ফিরতে চান বা নতুন স্বামীর কাছে যেতে চান, তারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন। জাল পাসপোর্ট তৈরির মাধ্যমে এই কাজ করা হয়।
তবে, সিরিয়ার বাইরে পালিয়ে যেতে সক্ষম নারীরা বর্তমানে কী অবস্থায় আছেন তা স্পষ্ট নয়। দ্য গার্ডিয়ানের সাথে কথা হওয়া পালিয়ে আসা এক নারী জানান, তিনি বর্তমানে নতুন স্বামীর সাথে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অঞ্চলে বসবাস করছেন।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান