সিলেবাস থেকে টিপু সুলতানের অধ্যায় বাদ দিতে চায় বিজেপি
কর্ণাটকের সপ্তম শ্রেণির সিলেবাস থেকে টিপু সুলতানকে বাদ দেয়া সিদ্ধান্ত পরামর্শ দিয়েছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। এতে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। কংগ্রেস বলছে, রাজনৈতিক আদর্শের কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। তবে বিজেপির দাবি, করোনার কারণে সিলেবাস ছোট করার প্রয়োজনে এই অধ্যায় বাদ দেয়া হয়েছে। মুঘল ও রাজপুতদের কে কেন্দ্র করে অধ্যায়, 'জিশুখ্রিস্ট এবং মহম্মদের শিক্ষা' কেন্দ্রিক অধ্যায়টিকেও অনেকাংশেই ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের চাপে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে টিপু সুলতানকে ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখল কর্নাটক সরকার। আপাতত বাদ পড়ছে না যিশু খ্রিস্ট ও মহানবী (সা) জীবন আলেখ্যও।
বুধবার বিকেলে রাজ্যের মাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রী সুরেশ কুমার জানিয়েছেন, পাঠ্যক্রম ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত এখন কার্যকর হচ্ছে না। তিনি বলেন, 'বর্তমান শিক্ষাবর্ষে শেষ পর্যন্ত কতগুলি দিন পাওয়া যাবে তা-ই জানি না। এই অবস্থায় কী করে পাঠ্যক্রম চূড়ান্ত করব?'
তিনি জানিয়েছেন, আপাতত নতুন পাঠ্যক্রম প্রত্যাহার করার জন্য নিজ মন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছেন।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, সপ্তম শ্রেণির সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে মহীশূরের রাজা হায়দার আলি ও টিপু সুলতান, মহীশূরের ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা এবং প্রশাসনিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত বিষয় বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। চলতি শিক্ষাবর্ষে টানা বেশ কিছু মাস সঠিক নিয়মে পড়াশোনা হয়নি। যার জন্যে দায়ি করোনা সংক্রমণ। এই জন্যেই পাঠ্যক্রম ছোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্ণাটকের শিক্ষাদফতর। স্বাভাবিক সময়ে সপ্তম শ্রেণীর যে সিলেবাস থাকে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা শেষ করা যাবে না। এই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই প্রায় ৩০ শতাংশ সিলেবাদ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০০৫ সালে স্কুলের সিলেবাস চূড়ান্ত করার জন্যে যে পাঠ্য পুস্তক রিভিউ কমিটি তৈরি হয়েছিল, তার চেয়ারম্যান বড়গুরু রামচন্দ্রপ্পা জানান, 'সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার অন্তত টেক্সট বুক রিভিউ প্যানেলের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারত। সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যক্রম থেকে টিপু সুলতানের সেই অধ্যায় সরিয়ে দেওয়া হল যেখানে তাঁর সম্পর্কে অনেক তথ্য ছিল। যদি একান্তই তাঁর উপর কোনও অধ্যায় বাদ দেওয়ার হত, তাহলে ষষ্ঠ শ্রেণীর বই থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারত।'
হাম্পি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক টি আর চন্দ্রশেখর জানিয়েছেন, 'কোভিড সংকটকে শিখণ্ডি দাঁড় করিয়ে সরকার সেই অধ্যায়টিই বাদ দিল পাঠ্যক্রম থেকে যা এতদিন ধরে বাদ দিতে চেয়েছে তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এই বাসনা তাদের মিটত না। তাই করোনা সংকটের দোহাই দিয়ে স্বার্থ চরিতার্থ করছে।' কেপিসিসি প্রেসিডেন্ট ডি কে শিবকুমার জানিয়েছেন, 'টিপু জয়ন্তী উদযাপন করা হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে। কিন্তু স্কুলের সিলেবাসে ইতিহাসকে এইভাবে বিকৃত করার অধিকার সরকারের নেই। এটা আমরা হতে দেব না।'
কর্ণাটক বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাসে বিশদে হায়দার আলি এবং টিপু সুলতানের মহীশূর সাম্রাজ্যের কথা ছিল। আঠারো শতকে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজা ছিলেন টিপু। কখনও ইংরেজদের কাছে নতজানু হননি তিনি। বস্তুত, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বিতর্কের জেরেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যেতে হয় মহীশূর সাম্রাজ্যকে। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই চালায় টিপুর সেনা। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতে হয়। রণক্ষেত্রেই মৃত্যু হয় তার।
শুধু কর্ণাটক নয়, গোটা ভারতেই টিপু সুলতানের ইতিহাস পড়ানো হয়। তাকে বাদ দিয়ে মহীশূর সাম্রাজ্যের ইতিহাস বোঝা অসম্ভব। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরেই বিজেপি এবং আরএসএস এর দাবি টিপু সুলতানের যে গৌরবের ইতিহাস পড়ানো হয়, তা ঠিক নয়। স্থানীয় মানুষদের উপর প্রবল অত্যাচার চালিয়েছেন তিনি। বহু মানুষকে হত্যা করেছেন। এমনকী, জোর করে ধর্মান্তরিতও করা হয়েছে তাঁর আমলে। এই কারণেই টিপু সুলতানের ইতিহাস বদলের দাবি দীর্ঘ দিন ধরে করে আসছে বিজেপি।
তবে দেশের বিশিষ্ট ঐতিহাসিকরা কখনওই সেই দাবিকে খুব গুরুত্ব দেননি। তারা বলেছেন, কাউকে ছোট করা বা বড় করা ইতিহাসের কাজ নয়। ইতিহাস সময়ের কথা বলে। সেখানে টিপুর অত্যাচারের কথাও যেমন বলা হয়েছে, বীরত্বের কথাও বলা হয়েছে। সব মিলিয়েই মহীশূর সাম্রাজ্য। এবং ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত জরুরি সময়।
বিজেপি অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষ সেই ইতিহাসকে মানতে নারাজ। এবং সে কারণেই সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস পাঠ্যক্রম থেকে টিপুকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অনেকের বক্তব্য। এর আগে তারা টিপু সুলতান দিবস পালনের বিরোধিতা করেছে।
এসমস্ত বিরোধিতার মুখে কর্ণাটক প্রশাসন অবশ্য জানিয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণি এবং দশম শ্রেণির সিলেবাসে এখনও টিপুর উল্লেখ আছে।
কর্ণাটকের টেক্সট বুক সোসাইটির প্রধান জানিয়েছেন যে পাঠ্যক্রম ছোট করার উদ্দেশ্যেই সপ্তম শ্রেণীতে টিপু সুলতানের অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সপ্তম শ্রেণীর পড়ুয়ারা ষষ্ঠ শ্রেণীতে ইতিমধ্যেই টিপু সুলতানের সম্পর্কে পড়েছে খানিকটা এবং দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে আবার পড়বে, তাই এই অংশটুকু বাদ দিলে তাদের কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া এই অধ্যায়টিকে অ্যাসাইনমেন্টের আওতায় রাখা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, উল্লেখ থাকা আর বিশদে ইতিহাস পড়ার মধ্যে তফাত আছে। সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রমেই টিপু এবং হায়দার আলিকে নিয়ে বিশদে বলা ছিল। সিলেবাস থেকে তা বাদ দিয়ে দেওয়ায় দশম শ্রেণিতে গিয়ে টিপুর উল্লেখ খাপছাড়া বলে মনে হবে ছাত্রছাত্রীদের।
কর্ণাটকের কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু করে।
তাদের বক্তব্য, এর আগে টিপুর জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান বন্ধ করেছিল বিজেপি। এবার টিপুকে সিলেবাসের বাইরে বার করে দিয়ে জনমন থেকে তাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি রাজনৈতিক চক্রান্ত।
বিজেপির এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কংগ্রেস বোর্ড তৈরি করছে। সেখানে ইতিহাসবিদদেরও রাখা হচ্ছে। তারাই যুক্তি দিয়ে এই কাজের বিরোধিতা করবেন।
দিল্লিতেও কেন্দ্রীয় বোর্ডের সিলেবাস কমানোর নাম করে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। তা নিয়েও প্রচুর হইচই হচ্ছে। এখানেও একই যুক্তি দেয়া হয়েছে। করোনার কারণে সিলেবাস ছোট করা হয়েছে। ভবিষ্যতে পুরোটাই পড়ানো হবে। কিন্তু তাই বলে বেছে বেছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন বাদ দেওয়া হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
টিপু সুলতানই প্রথম নয়। এর আগে স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে মোগলদের সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল বিজেপি। মোগল ইতিহাসকে অন্ধকার সময়ের ইতিহাস বলে দাবি করা হয়েছিল। তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এখনই এই ঘটনার উপযুক্ত প্রতিবাদ না করলে ভবিষ্যতে আরো এমন কাজ করবে বিজেপির সরকার।