“১০ মিনিট সময় দিন”: গাজায় মিডিয়া টাওয়ারে ইসরায়েলি হামলার নেপথ্যে
ইয়ুমনা আল-সাঈদের নিরাপদে সরে আসার জন্য হাতে এক ঘণ্টারও কম সময় ছিল।
কিন্তু আল-জালা টাওয়ারের শুধু একটি এলেভেটরই কাজ করছিল। গাজা শহরের ১১ তলার ভবনটিতে আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক, দ্য এসোসিয়েটেড প্রেস, আল-সাঈদসহ বেশ কিছু অফিস ছিল, আবাসিক এপার্টমেন্ট ছিল ৬০টি। ভবনটির প্রায় সবাই সিড়ির দিকে ছুটছিলেন।
ফিলিস্তিনি এক সাংবাদিকের ভাষ্যে, "বয়স্ক ও শিশুদের জন্য এলিভেটর ছেড়ে দিয়ে সিড়ি দিয়ে দৌঁড়ে নিচে নামছিলাম। যারাই পারছিলেন, শিশুদের নিরাপদে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আমি নিজেই দুজন শিশুকে নিচে নামিয়ে আনি, সবাই তাড়াহুড়োর মধ্যে দ্রুত দৌঁড়ে নিচে নামছিলেন,"
এ ঘটনার কিছু সময় আগে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কল করে জানায় তাদের ফাইটার জেটের হামলার আগে ভবনটির বাসিন্দাদের ভবনটি খালি করার জন্য এক ঘণ্টা সময় আছে।
আল জাজিরার সাফওয়াত আল-কাহলোতকে দ্রুত সরে যেতে হয়। তিনি ও তার সহকর্মীরা যতো দ্রুত পারছিলেন, যতো বেশি সম্ভব সরঞ্জাম, বিশেষ করে ক্যামেরা, নিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আরও বেশি সময় দরকার ছিল।
টেলিফোনে এপি'র একজন সাংবাদিক ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স অফিসারকে বলছিলেন, "আর ১৫ মিনিট সময় দিন। ক্যামেরাসহ আমাদের অনেক যন্ত্রপাতি আছে,"
ভবনটির মালিক জাওয়াদ মাহদিও আরও কিছু সময় চেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
তিনি ইসরায়েলি অফিসারকে বলছিলেন, "আমি শুধু চাইছি চার জন মানুষ ভেতরে গিয়ে তাদের ক্যামেরা নিয়ে আসবেন। আমরা আপনাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করি, অনুমতি না দিলে আমরা এ কাজ করবো না। কিন্তু, ১০ মিনিট সময় দিন,"
উত্তরে সেই ইসরায়েলি অফিসার বলেন, "আর কোনো ১০ মিনিট সময় দেওয়া হবে না। ভবনের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই কারো। ভবনটি খালি করতে আমরা ইতোমধ্যে এক ঘণ্টা সময় দিয়েছি,"
অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের পর জাওয়াদ বলেন, "আপনারা আমাদের কাজ, স্মৃতি, জীবন- সবকিছুই ধ্বংস করেছেন। আমি ফোন রেখে দিচ্ছি, আপনাদের যা ইচ্ছা করুন। সৃষ্টিকর্তা আছেন,"
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, হামাস ইন্টেলিজেন্স ভবনটি ব্যবহার করে। গাজার ভবনগুলোতে বোমা হামলা চালানোর সময়ও একই সাফাই গাওয়া হয়। সাংবাদিকদের 'রক্ষাবর্ম' হিসেবে ব্যবহার করে ওই অঞ্চলে হামাসের কর্ম তৎপরতা চালানোর অভিযোগও এনেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তবে তাদের এই দাবির পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি তারা।
আল-কাহলোত বলেন, "আমি ১০ বছর ধরে এই ভবনে কাজ করছি এবং কখনোই সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি আমার,"
"আমি এমনকি আমার সহকর্মীদেরও প্রশ্ন করি তারা এমন কিছু দেখেছেন কিনা। তারা সবাই আমাকে নিশ্চিত করেছেন, তারাও কখনো এখানে কোনো সামরিক ব্যক্তিত্ব বা যোদ্ধাদের উপস্থিতি দেখেননি। এমন কাউকেই কখনো ভবনটিতে আসা-যাওয়া করতে দেখেননি কেউ," বলেন তিনি।
"ভবনটিতে অনেকগুলো পরিবারের বাস, তারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে থাকছেন। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তাদের চিনি আমরা। অফিসে আসা-যাওয়ার সময়ও প্রায় প্রতিদিনই তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়," ভবনটির সার্বিক চিত্রের ব্যাপারে এসব জানান আল-জাজিরার এই সাংবাদিক।
এপি'র প্রেসিডেন্ট ও প্রধান কার্য নির্বাহী গ্যারি প্রুট বলেন, "প্রায় ১৫ বছর ধরে এই ভবনে কাজ করেছি আমরা। নিশ্চিতভাবেই এখানে হামাসের সংশ্লিষ্টতা আছে এমন কিছু মনে হয়নি,"
এপি'র সাংবাদিক ফারেস আকরাম জানান, এর আগের দিন রাতে সারারাত তার রিপোর্টিংয়ের কাজ শেষ করে অফিসে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। তার সহকর্মীদের চিৎকারে ঘুম ভাঙে তার।
'ইভাকুয়েশন', 'ইভাকুয়েশন'- অর্থাৎ ভবনটি খালি করার জন্য সবাইকে সতর্ক করতে ডাকছিলেন তারা। ঘুম ভাঙার পরই ফারেস আকরাম তার ল্যাপটপসহ যা কিছু সম্ভব হাতে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। হামলার পর এ নিয়ে একটি লেখাও প্রকাশ করেন তিনি।
গাড়িতে করে ভবনটি থেকে কিছু দূর আসার পরই গাড়ি থামিয়ে ভবনটির দিকে তাকান তিনি। তিনি জানান, ড্রোন ও তিনটি শক্তিশালী এফ-১৬ এসে ভবনটিতে হামলার দৃশ্য দেখেন তিনি।
"প্রথমে দেখে মনে হচ্ছিল, কয়েক স্তরের কোনো বস্তু ধসে পড়ে যাচ্ছে। বাটিভর্তি আলুর চিপসে সবেগে আঘাত করলে যা হতে পারে অনেকটা সেরকম বলেই মনে হলো আমার। তারপরই ধোঁয়া আর ধূলায় চারপাশ আচ্ছাদিত হয়ে যায়। অনেক মানুষের বাসস্থান, কারো কর্মক্ষেত্র- নিমিষেই ধূলোয় মিলিয়ে গেলো," লিখেন তিনি।
আল-জাজিরায় ইসরায়েলের বোমা হামলা ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক আল-সাঈদ এর আগে এপি-তে কাজ করতেন। তিনি বলেন, কিছু পরিবারের বাসস্থান, আইনজীবী, চিকিৎসক ও গণমাধ্যম কর্মীদের কর্মক্ষেত্র কীভাবে হুমকির কারণ হতে পারে তাই বুঝতে পারেননি তিনি।
"এখানে ঝুঁকি কোথায়? এ ভবনে হামাস বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর সদস্যরা থেকে থাকলে কোথায় তারা?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
"এখানকার মানুষ, বাসিন্দারা- আমরা সবাই সবাইকে চিনি। ভবনটির প্রথম পাঁচ তলার অফিসগুলো বন্ধ ছিল। অর্থাৎ আল জাজিরা ও এপি'র অফিস ও ভবনের বাসিন্দারাই ছিলেন শুধু,"
তারপরও, সেদিন বেলা ৩টা ১২ মিনিটে প্রথম আঘাত আসে। পাঁচ মিনিট পরই তিনটি মিসাইলের আঘাতে মাটিতে ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় ভবনটি। এ ঘটনায় তৎক্ষণাৎ কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
আল কাহলোতের ভাষ্যে, "কয়েক বছরের স্মৃতি, কাজ, হঠাৎ করেই সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। একেবারে উধাও,"
ওই ভবনে কর্মরত আইনজীবী ইসলাম আজ-জাঈম সেসময় তার বাসায় ছিলেন। ধূলিস্মাৎ হয়ে যাওয়া আরেকটি ভবনের মালিক এসে তাকে জানান যে, আল-জালা টাওয়ারেও হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা হবে।
"আমি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে দেখলাম ভবনটির বাসিন্দা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সবাই নিচে জড়ো হয়েছেন,"
"আমি ভবনটির ভেতরে গেলাম, বিদ্যুৎ না থাকায় সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠা শুরু করলাম। হিস্টিরিয়াসগ্রস্ত হয়ে বারবার চিৎকার করছিলাম, কাঁদছিলাম। অন্ধকারে উপরে উঠতে গিয়ে ওই অবস্থায় বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়েও যাই," এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এই আইনজীবী।
তিনি জানান, তার ফ্লোরে নয় জন আইনি সহযোগী ও চার জন ইন্টার্ন কাজ করতেন। ভবনটি ধসে পড়ার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে বের হতে পেরেছিলেন তারা।
"এমনকি ভবনটি গুড়ো হয়ে যাওয়ার পরও আমি চিৎকার করে বলছিলাম আমি অফিসের দরজা আটকাতে ভুলে গিয়েছি। কী অবস্থা কল্পনা করুন একবার,"
১৯৯০'র দশকে তৈরি ভবনটি গাজা শহরের সবচেয়ে পুরনো সুউচ্চ ভবন।
মায়াদীন মিডিয়া গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ফারেস আল-ঘোউল জানান, তার কোম্পানির অফিস ছিল শোরোক ভবনে। ইসরায়েলি মিসাইলের আঘাতে ওই ভবনটিও ধ্বংস হয়ে গেছে।
"২০১৪ সালের যুদ্ধে শোরোক ভবনের উপর তলাকে টার্গেট করা হয়। ২০১৯ সালে আল-জালা টাওয়ারে নিরাপদ ভেবে এখানে নিজেদের অফিস স্থানান্তর করি আমরা, কারণ অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় ছিল ভবনটিতে,"
"এখন দুটি ভবনই ধ্বংস হয়ে গেছে," বলেন তিনি।
সাংবাদিকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে আল-জালা টাওয়ারে ইসরায়েলের বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে বলেছে আন্তর্জাতিক মহলে এ ঘটনা নিয়ে নিন্দা জানানো হচ্ছে। ঈদ-উল-ফিতরের দিন শাতি শরণার্থী ক্যাম্পে ইসরায়েলের বিমান হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই এই হামলার ঘটনা ঘটে। শাতি ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় আটজন শিশু ও দুজন নারীসহ একই পরিবারের ১০জন মারা যান।
সোমবার থেকে এ পর্যন্ত ৩৯ জন শিশুসহ অন্তত ১৪৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৯৫০ জন।
অধিকৃত পশ্চিম জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর উচ্ছেদের ইসরায়েলি পরিকল্পনার জের ধরেই বিগত দিনগুলোর এ সহিংসতার সূত্রপাত। আল-আকসা মসজিদে হামলার ঘটনায় জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও ইজরায়েলের ভেতরও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। হামাস জানিয়েছে, ইসরায়েলের ক্র্যাকডাউনের জবাবেই রকেট নিক্ষেপ করে পাল্টা জবাব দিয়েছে তারা। ইসরায়েলেও অন্তত নয় জন মানুষ নিহত হয়েছেন।
সন্ধ্যা নেমে আসতেই আল-জালা টাওয়ারে ফিরে যান সাংবাদিক ও বাসিন্দারা, উদ্দেশ্য ধ্বংসস্তূপ থেকে যদি নিজেদের কোনো জিনিস উদ্ধার করা যায়।
"একজন মানুষ ফিরে এসে তার মেয়ের আঁকা কিছু ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তার মেয়ের স্মৃতি থাকায় ছবিগুলো তার জন্য অনেক গুরূত্বপূর্ণ ছিল," বলেন কাহলোত।
ধ্বংস্তুপের পাশে দাঁড়িয়েও সংবাদ প্রচারের কাজ করছিলেন কাহলোত নামের এই সাংবাদিক।
"আমরা বেরিয়ে এসে রিপোর্টিংয়ে আমাদের জরুরি মুহূর্তের পরিকল্পনা কাজে লাগাচ্ছি। আমরা নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছি। গাজার কোনও জায়গাই তো আসলে নিরাপদ নয়, তাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আমরা।"
অন্যদিকে, নিরাপদে সংবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে আল-শিফা হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দেন আল-সাঈদ।
"এসব পরিবারের কী হবে? যারা তাদের বাসস্থান হারিয়েছেন? যারা তাদের সব সহায় সম্বল একত্র করে অ্যাপার্টমেন্টে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন? গাজায় অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আর এখন, মুহূর্তের মধ্যেই তারা সব হারিয়ে ফেললেন," বলেন তিনি।
"এই বিধ্বস্ত অবস্থার বর্ণণা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মানুষের ট্রাজেডি বলে বোঝানো সম্ভব না।"
- আল জাজিরা অবলম্বনে