‘ওমিক্রনেই কি মহামারির শেষের শুরু?’
করোনাভাইরাস মহামারির রেশ যেন কাটছেই না। কিছু দেশে সংক্রমণ কমে আসলেও, বিশ্বের অন্যান্য অনেক স্থানেই তা বেড়েছে। মহামারিকালে সব সময়ই আছে নতুন ভেরিয়েন্ট সৃষ্টির ঝুঁকি। ইতোমধ্যেই তার ভয়াবহতা প্রমাণ করেছে অতি-প্রাণঘাতী ডেল্টা ভেরিয়েন্ট।
দুনিয়াজুড়ে মৃত্যুর তাণ্ডব সৃষ্টি করে ডেল্টা। তারপরই সবচেয়ে উদ্বেগজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ওমিক্রন। সার্স কোভ-২ করোনাভাইরাসের সংক্রামক ধরনটি নিয়ে বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও সরকারসমূহের উদ্বেগের শেষ নেই। তবে প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা অনেকটাই বদলেছে।
মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। উন্নত দেশগুলো সবার আগে টিকাদান শুরু করে অনেক জীবন রক্ষা করতে পেরেছে। ধীরে ধীরে টিকাদান বেড়েছে উন্নয়নশীল দেশেও। টিকা নিয়ে সংক্রমিতদের অনেকে গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু থেকে রক্ষা পান। আমাদের চারপাশে এমন পরিচিতদের অভাব নেই।
তবে একইসাথে ভাইরাসের নিত্যনতুন ধরনগুলোও অভিযোজিত হচ্ছিল, টিকার দেওয়া সুরক্ষা কবচ ফাঁকি দেওয়ার শক্তি অর্জন করছিল।
যুক্তরাজ্য সবার আগে করোনার টিকাদান শুরু করে। অধিকাংশ নাগরিককে টিকাদানের পরও এখন দেশটিতে ওমিক্রন বিস্তারের তীব্রতা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য টিকার কল্যাণে বেশিরভাগ মানুষের সংক্রমণই মৃদু। সেরেও উঠছেন রোগীরা।
ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানেও এমন পরিস্থিতির কথা জানা যাচ্ছে। খুব দ্রুত সংক্রমণের ঘটনা বাড়লেও; সে তুলনায় মৃত্যুহার বেড়েছে ধীরে ধীরে। এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, আগের ধরনগুলোর চেয়ে ওমিক্রন বেশি সংক্রামক হলেও গুরুতর অসুস্থ করে না।
এনিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অবশ্য সুযোগ নেই। কয়েকটি দেশে ওমিক্রনের প্রাথমিক বিস্তারের তথ্য বেশ উদ্বেগজনক। তুলনামূলক কম প্রাণঘাতী ভেরিয়েন্টও মৃত্যুর তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারে।
এই ধরনটি সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু জানার বাকি। সংক্রমণের প্রাথমিক তথ্যে রয়েছে অপষ্টতা। আপাতত করোনা মহামারির ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেবে তা নিশ্চিত নয়।
এমন হতে পারে, ওমিক্রন বিস্তারের কারণে কয়েক মাস ধরে আমাদের জীবনযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হবে, তারপর একসময় দুর্বল হয়ে পড়বে এটি। আবার এর বিপরীতে হাসপাতালে রোগী ভর্তির নাটকীয় সংখ্যা বৃদ্ধিও দেখতে পারি, আর তার সাথে মৃত্যুর মিছিল।
বাজি ধরেই বলা যায়, ওমিক্রন বা করোনাভাইরাসের আরও পরবর্তী বংশজগুলো যেপথেই যাক, সামাজিক পর্যায়ে মহামারির অবসান লক্ষ্য করতে চলেছি আমরা।
সংক্রমণ বন্ধে সরকারিভাবে আরোপিত সর্বাত্নক লকডাউন সেরা নাকি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই যথেষ্ট- এনিয়ে মহামারির শুরু থেকেই বিতর্ক চলে আসছে। একদল জীবন বাঁচাতে কঠোর পদক্ষেপ চেয়েছেন, আরেকদল জীবনজীবিকায় এমন বিধি-নিষেধের পরিণতি ও আর্থিক ক্ষতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
সে বিতর্ক আজো দূর হয়নি।
সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে চলায় উন্নত দেশের বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদেরা ফের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ করছেন। তবে আগের মতো তারা বড় পরিসরে লকডাউন ও শাটডাউনের পক্ষে মত দেওয়া থেকে বিরত আছেন। সামগ্রিক অর্থনীতির কথা ভেবেই হয়তো এমন মতামত। যার আরেক অর্থ দাঁড়ায়, সংক্রমণ রেখার ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধ থেকে আমরা পুরোপুরি সরে আসছি। বরং গুরুত্ব পাচ্ছে রোগীর সুচিকিৎসার দিকটি।
যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক নীতি এ পরিবর্তনেরই ইঙ্গিতই দেয়।
প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কোভিড-১৯ রোগীর বাড়তি সংখ্যা মোকাবিলায় হাসপাতালে সেনা মোতায়েনকে পরিকল্পনায় রেখেছে হোয়াইট হাউস। যেসব চিকিৎসা কেন্দ্রে বাড়তি ভেন্টিলেটর বা কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র সবচেয়ে বেশি দরকার, সেখানে তা পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া, যুদ্ধকালীন আইন কার্যকর করে বাড়ানো হবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা কোভিড টেস্টের সংখ্যা। আগামী মাস থেকে বিনামুল্যে টেস্ট করার সুবিধাসহ টিকাদান কেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়তে চলেছে।
সন্দেহ নেই, এসব বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। কিন্তু জলবায়ু বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা যায়, আমরা এখন 'অভিযোজনশীলতা' তৈরির দিকে ঝুঁকছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য: সংক্রমিতের বাড়তি সংখ্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি। আসল উৎস বা সংক্রমণ বিস্তার রোধ নয়।
এই কৌশল আগামী সপ্তাহ বা মাসগুলোর বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হতে পারে। এসময়ে যদি হাজার হাজার ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করে, তাহলে স্বাস্থ্যখাত আবারো বিপর্যস্ত হওয়ার দুয়ারে পৌঁছে যাবে। তখন সাধারণ নাগরিক ও সরকার উভয় পক্ষেই প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।
তবে আগে লক্ষ্য ছিল; এমন অবস্থা হতেই না দেওয়া। এখন কেবল গুরুতর সংকটের ক্ষেত্রেই শাটডাউন আরোপের ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে।
মহামারি কখন শেষ হবে- তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া রয়েছে। তবে তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক সামাজিক-বৈজ্ঞানিক আচরণ । সমাজ যখন নির্দিষ্ট কোনো ভাইরাসের বিস্তারের মধ্যেই তার সাথে তাল মিলিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করে- তখনই এমন আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেয়।
এই সংজ্ঞা অনুসারে, উন্নত দেশগুলোয় ওমিক্রন সংক্রমণ বাড়ার পরও সরকারগুলোর সংযত প্রস্তুতি মহামারি শেষের শুরুকে নির্দেশ করছে।
প্রশ্ন জাগা সঙ্গত- মহামারিই কী নয়া স্বাভাবিকতা? তার অর্থ কি- এই রোগের ঝুঁকি কমেছে? নাকি প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে চললেও, আমরা কোভিডকে আর গ্রাহ্য করব না?
প্রথম প্রশ্নের 'হ্যাঁ' জবাব অনুমানের পেছনে আছে বেশকিছু বাস্তব কারণ। যে ভাইরাসের সাথে জনসংখ্যার সংস্পর্শ ঘটেনি, সেটি যখন প্রথম বিস্তার লাভ করে ক্ষতি তখনই বেশি হয়। এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা না থাকায় দলে দলে মানুষের মৃত্যু ঘটতে থাকে। তবে মহামারির এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে।
যার অর্থ দাঁড়ায়- ওমিক্রন সংক্রমণ খুব গুরুতর নাহলে; আগামী কয়েক মাসে আমরা করোনার ভবিষ্যৎ ধরনগুলির বিরুদ্ধে সুরক্ষা অর্জন করব। কারণ এ সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ এটির সংস্পর্শে আসবে। একবার যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ এর সংস্পর্শে আসলে; আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও নতুন হুমকির সাথে পরিচিত হবে। ফলে মৃত্যু সংখ্যা সীমিত রেখেই ভবিষ্যৎ ভেরিয়েন্টগুলি মোকাবিলার সুযোগ পাবে মানব জাতি।
একে চূড়ান্ত উপসংহার মনে করার কারণ নেই। তবু আশা করা যায়, যারা ওমিক্রনে আক্রান্ত হবে, তাদের দেহে অন্য ভেরিয়েন্টগুলির বিরুদ্ধে দুর্বল বা সাময়িক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হবে।
আর ভাগ্য খারাপ হলে, আগামীতেও ওমিক্রনের মতো অতি-সংক্রামক বা ডেল্টার মতো প্রাণঘাতী ভেরিয়েন্ট হানা দিবে।
মানবজাতি ভয়াবহ সব বিপদ মাথায় করে বাঁচতে শিখেছে হাজার হাজার বছর ধরে। যুদ্ধ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ বার বার ভেঙেছে গড়েছে আমাদের তৈরি সভ্যতা। ইতিহাসের সব সময়েই মানুষ এসবের মধ্যে দিয়ে গেছে। আর নতুন রোগের প্রাদুর্ভাবও ছিল নিত্য ঝুঁকি। তখন আজকের মতো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিল না।
তাই গত ২৪ মাসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর বিশ্ববাসীর এব্যাপারেও একথা আরোপ করাই যায়।
মহামারির ঝুঁকি মাথায় করে বেঁচে থাকা ও সামাজিকতা রক্ষার এই চেষ্টা কী নিতান্ত বোকামি? নাকি তা অনুপ্রেরণাদায়ী? উত্তর আমার জানা নেই। ভালো হোক বা মন্দ- এই পরিস্থিতি সহসাই বদলানোর নয়। তবু দৃঢ় সংকল্পে এগিয়ে চলাই মানবতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
হয়তো ২০২০ সালকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক নজিরবিহীন সময় হিসেবে মনে রাখব আমরা। যখন পুরো পৃথিবীকে অচল করে দিয়েছিল লকডাউন। কিন্তু, কয়েক মাস চলার পর এই ব্যবস্থা যে স্থায়ী সমাধান নয়, সেটাও সকলে বুঝতে পারে।
তাই আগামীতে ওমিক্রন যে তাণ্ডবই চালাক না কেন- আমরা হয়তো মহামারির আগের সময়ের মতো জীবনযাপন চালিয়ে যাব।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক