বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ কুয়েত কি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে?
আরব মরুর দেশগুলো তাদের বিশাল পেট্রোকেমিক্যাল সম্পদের জন্য সুপরিচিত। বিগত কয়েক দশকে তেল ও গ্যাস বিক্রির অর্থে বিশাল সব নগর-অট্টালিকা গড়ে উঠেছে পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী রাজতন্ত্রগুলোতে। মরুর প্রচণ্ড তাপকে সহনীয় রেখে নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক সব স্থাপনা। জীবাশ্ম জ্বালানি বেচে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী হওয়ায় এসব খরচ কখনো মাথাব্যথা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু, এত ব্যয়ের পরও মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে সম্পদশালী এমনই একটি দেশ কুয়েত।
দেশটির রাজধানী কুয়েত সিটির তাপমাত্রা পরিস্থিতিই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
যেমন মধ্য দুপুরের গণগণে সূর্য যখন মাথার উপর, কুয়েত সিটির মালিয়া বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করা দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে যাত্রীদের জন্য। গ্রীষ্মে যা আরো ভয়াবহ।
অথচ ব্যস্ত এই বাস স্টেশনটি শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ হাব, শহরের দুই-তৃতীয়াংশ বাস সার্ভিস এটি ব্যবহার করে। যানবাহনের থাকে তীব্র ভিড়। বাম্পারে বাম্পারে ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ির সাড়ি, তখন তাদের ইঞ্জিন নির্গত জ্বালানির ধোঁয়া চারপাশের তাপমাত্রাকে আরো অসহনীয় করে তোলে।
প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে যাত্রী ছাউনিতে গাদাগাদি করে কিছুটা স্বস্তি হয়তো মেলে। কিন্তু, বেশিরভাগ মানুষকেই জ্বলন্ত সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রোদ থেকে বাঁচতে তখন ছাতাই একমাত্র ভরসা।
তাপমাত্রার এই ভয়াল ঊর্ধ্বগতির কারণ অবশ্যই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ইতোমধ্যেই তার কবলে পড়েছে বিশ্বের অনেক অঞ্চল। কিন্তু, তার ফলে কুয়েত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্যতম উষ্ণ দেশ। আর ধীরে ধীরে দেশটি বাসযোগ্যতাও হারাচ্ছে।
বিগত কয়েক বছরের তাপ পরিস্থিতি দেয় সে ইঙ্গিত।
যেমন ২০১৬ সালে দেশটিতে ৫৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা ছিল পৃথিবীতে ৭৬ বছরের মধ্যে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ উষ্ণতা। আর গেল বছরের জুনে গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা পুরোপুরি আসার কয়েক সপ্তাহ আগেই তা মাপা হয়েছে ৫৩.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস, যা ছিল ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি উত্তাপের রেকর্ড।
কুয়েতের পরিবেশ কর্তৃপক্ষের তথ্যানুসারে, ২০৭১ সাল থেকে ২১০০ সাল নাগাদ কুয়েতের কোনো অঞ্চলে গড় উষ্ণতা সাড়ে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়বে। ফলে দেশটির একটি বিশাল অঞ্চলে মানুষের বসবাস হয়ে পড়বে অসম্ভব।
বন্য প্রাণীরা এরমধ্যেই তাপদাহে জেরবার, জীবনধারণের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশও এখন তাদের জন্য নিরাপদ নয়। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের সময় ছায়া ও পানির সন্ধান না পেয়ে মৃত পাখিদের পাওয়া যায় বাড়ির ছাদে। শহরের মালিকহীন বিড়ালগুলোকে মূমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসছেন অনেক সহৃদয় ব্যক্তি। শুকিয়ে যাচ্ছে মরুদ্যান ও মরুগুল্ম। সামান্য বৃষ্টির পানিও এত দ্রুত শুকিয়ে যায় যে কষ্টসহিষ্ণু মরু শেয়ালরা কুয়েত সিটির আশেপাশের কিছু সবুজ অঞ্চলে ভিড় করছে। কিন্তু সেখানে তাদের উৎপাত মনে করে মেরে ফেলা হচ্ছে।
কুয়েতি এক চিড়িয়াখানার পশু চিকিৎসক তামারা কাবাজার্ড বলেন, "এসব কারণে কুয়েতে আমরা দিন দিন বন্য প্রাণী কমতে দেখছি। তারা গ্রীষ্মের মৌসুম কাটিয়ে বেঁচে থাকতে পারছে না। গত বছরের জুলাইয়ের শেষদিকের টানা তিন-চার দিন ছিল প্রচণ্ড উষ্ণ ও আদ্র। তখন ঘরের বাইরে পা রাখায় ছিল দায়। আদ্রতার কারণে ছিল না বায়ু প্রবাহের ছিটেফোটা।। দমবন্ধ করা সেই যন্ত্রণায় মানুষ যতটা ভুগেছে পশুপাখিদের কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। অনেক প্রাণী গরমে হাসফাঁস করে মারা গেছে। তারা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভুগেছে।"
বাংলাদেশ থেকে সুদূর ব্রাজিল পৃথিবী আজ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের চরম পরিণতির শিকার। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে যান কাজের সন্ধানে। তাদের বেশিরভাগই স্বল্প দক্ষতার, এবং নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতা কর্মীর মতো কায়িক শ্রমে নিযুক্ত। শীতাতপহীন পরিবেশে কাজ করায় প্রচণ্ড গরমে শারীরিক সমস্যা হয় তাদের, যা আগামীতে বহুগুণ বাড়ার আভাস মিলছে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখনও বিপুল দারিদ্র্য থাকায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা অসহনীয় করছে গরমের উৎপাত। তাছাড়া, উন্নয়নশীল দেশে বাড়তি জনসংখ্যা, দ্রুত নগরায়ন, প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্রুত বিনষ্ট করায় তাপ পরিস্থিতিও অবনতিশীল।
কুয়েতের এসব সমস্যা নেই, প্রচণ্ড ধনী এই দেশটি ওপেক জোটভুক্ত চতুর্থ বৃহৎ জীবাশ্ম তেল রপ্তানিকারক। দেশটির আছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত উন্নয়ন তহবিল। স্থানীয় জনসংখ্যাও অনেক কম, মাত্র ৪৫ লাখ। ফলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে দরকারি তহবিলের কোনো অভাব না থাকলেও, রয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাব।
জাতিসংঘ-সহ বিশ্ব সংস্থাগুলো আরো উষ্ণায়ন ঠেকানোর পাশাপাশি যতটুকু উষ্ণতা বেড়েছে তা মোকাবিলায় টেকসই ও দূষণমুক্ত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের তাগিদ দিচ্ছে। এজন্য জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর ওপর প্রচ্ছন্ন চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এরমধ্যেই কুয়েতের প্রতিবেশী শীর্ষ জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশগুলো জোরালো পরিবেশগত পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। যেমন ২০৬০ সালের মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণ অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সৌদি আরব। সংযুক্ত আরব আমিরাত তা ২০৫০ সাল নাগাদ করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে।
উভয় দেশই প্রচলিত জ্বালানি রপ্তানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হলেও তারা নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যকরণের ঘোষণা দিয়েছে।
জাতিসংঘের পরবর্তী দুটি জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে মধ্যপ্রাচ্যেই- মিশর ও আরব আমিরাতে। ক্রমবর্ধমান তাপ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমূহ বিপদ অনুধাবন করে এ অঞ্চলের সরকারগুলো জলবায়ু নীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
সে তুলনায় গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ সম্মেলনে যোগ দিয়ে কুয়েত ২০৩৫ সাল নাগাদ মাত্র ৭.৪ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার দেয়। যা বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পর্যন্ত সীমিত রাখতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নির্ধারিত ৪৫ শতাংশ কর্তনের চেয়েও কম।
আবার কয়েতের ৭০ হাজার কোটি ডলারের সুবিশাল সার্বভৌম তহবিল জ্বালানি তেল খাতেই বেশি বিনিয়োগ করছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, টেকসই খাতে বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে প্রচলিত খাতে পুঁজি লগ্নী থেকে মুনাফা অর্জনকেই তারা গুরুত্ব দিচ্ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে চরম দুর্ভোগে থাকার পরও কুয়েত সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উদাসীন এমন অভিযোগও রয়েছে।
এব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসাগরীয় দেশগুলোর গবেষক মানাল শেহাবি বলেন, "বাদবাকি মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় জলবায়ু তৎপরতায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে কুয়েত। দেশটির জলবায়ু অঙ্গীকারও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম।" অথচ মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে প্রভাবিত অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন এ বিশেষজ্ঞ।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ