বাংলাদেশি নয়, ভারতীয়: যেভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণের কঠিন লড়াইয়ে জিতলেন আসামের নারী
একটা সময় ছিল, যখন পুলিশ দেখলেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন শেফালি রানী দাশ।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কাছাড় জেলায় তার বাড়িতে হানা দিয়েছে পুলিশ। হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে নোটিস, যেখানে বলা হয়েছে ভারতীয় নাগরিক হওয়ার তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে হবে তাকে।
কিন্তু আর পুলিশ দেখলেই পালাতে হবে না ৪২ বছর বয়সী শেফালিকে। গেল জানুয়ারি মাসে, বহু বছর ধরে আদালতে শুনানির জন্য হাজিরা দেওয়ার পর, শেফালি ভারতের একজন বৈধ নাগরিক হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছেন।
কিন্তু এই স্বীকৃতি লাভের জন্য তাকে চড়া মূল্য চোকাতে হয়েছে। মামলা লড়ার জন্য প্রয়োজন পড়েছিল প্রচুর টাকার, যা নানা জায়গা থেকে ধার করে এনেছিল তার পরিবার। এখন দেনা শোধ করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে তারা।
তাছাড়া লড়াই তো পুরোপুরি শেষ হয়নি। শেফালি স্বীকৃতি পেয়েছেন বটে, কিন্তু এবার প্রমাণ করতে হবে—তার স্বামীও একজন ভারতীয় নাগরিক। আর কীভাবে সেটি প্রমাণ করবেন তারা? ঋণের পাহাড় বাড়িয়ে, আরও একটি কেস চালিয়ে!
"গত কয়েক বছর ধরে আমার পরিবার ও বাচ্চাদের যা সহ্য করতে হয়েছে, জীবনে মনে হয় না এরচেয়ে বড় কোনো যুদ্ধ থাকতে পারে," শেফালি বলেন।
কিন্তু এই লড়াই কোনোভাবেই শেফালি বা তার পরিবারের একার নয়। ভারতের আসামে গত কয়েক দশক ধরে আরও হাজার হাজার মানুষকে অবৈধ অভিবাসী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের সামনে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে নাগরিকত্ব প্রমাণের চ্যালেঞ্জ। সেই কঠিন চ্যালেঞ্জে যদি কেউ হেরে যায়, তবে তাকে আটক করা হবে, কিংবা নিজভূমি থেকে বিতাড়িত পর্যন্ত হবে সে।
আসামের খুবই বিতর্কিত একটি ইস্যু এটি। ১৯৫১ সালে রাজ্যটি জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-তে অধিবাসীদের বিস্তারিত তথ্য রেকর্ড করা শুরু করে। এর মাধ্যমে তারা জানতে চাইছিল কারা এ রাজ্যেই জন্ম গ্রহণ করেছে ও সেই সুবাদে ভারতীয়, এবং কারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে অভিবাসী হিসেবে এসেছে।
"আমি এখানে জন্মেছি, পড়াশোনাও করেছি এখানে। তাহলে হঠাৎ করে আমি কীভাবে বাংলাদেশি বনে গেলাম? এই প্রশ্ন সারাক্ষণই আমাকে তাড়া করে বেড়ায়," শেফালি বলেন।
১৯৮৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসামে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এক আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে যে ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে সে রাজ্যে প্রবেশ করেছে, তবে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে।
এদিকে ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের (যেদিন বাংলাদেশ পাকিস্তানের থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে) মধ্যে যারা রাজ্যে প্রবেশ করেছে, তাদেরকে সরকারের কাছে নিবন্ধন করতে হবে। আর যারা ২৪ মার্চের পর রাজ্যে প্রবেশ করেছে, তারা বিবেচিত হবে বিদেশী ও শরণার্থী হিসেবে।
১৯৮০-র দশকের শেষ দিক থেকে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালস নামের বিশেষ আদালতগুলো অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অভিযুক্তদের মামলার শুনানি গ্রহণ করে। সাধারণত সীমান্ত পুলিশের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আনা হয়।
২০১৯ সালে ইস্যুটি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। কেননা সে বছর এনআরসির হালনাগাদের মাধ্যমে ১৯ লক্ষ মানুষকে রাজ্যহীন করে ফেলা হয়, এবং তাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের হাতে। ট্রাইব্যুনালটি এ রাজ্যে আধা-বিচারিক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, এবং প্রায়ই এ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত বিচারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতা এবং অধারাবাহিকতার অভিযোগ আনা হয়।
ভিনদেশির তকমা
শেফালির অগ্নিপরীক্ষার শুরু হয় ২০১২ সালে, যখন নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে সন্দেহ পোষণের মাধ্যমে পুলিশ তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের কতে। যে আইনের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল, সে আইনটি অবশ্য এখন আর নেই। তবে সে যা-ই হোক, মামলার সত্যতা প্রমাণের দায়ভার ছিল পুলিশের উপরই। ফলে বারবার শেফালিদের বাড়ি এসে উৎপাত করত তারা।
শেফালি জানান, একবার দূর থেকে পুলিশ আসতে দেখে তিনি বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালান। নিজের গ্রাম থেকে অনেক দূড়ে এক মুসলিম পরিবারের বাড়িতে দিনভর লুকিয়ে থাকেন তিনি।
২০১৫ সালে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। তখন থেকে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় পড়ে অভিযুক্তের উপরেই।
একজন আইনজীবী শেফালির কাগজপত্র গুছিয়ে দিতে সাহায্য করেন। কিন্তু তারপরও অন্য এক শহরে গিয়ে শুনানিতে হাজির হওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল শেফালির।
শেফালির স্বামী স্কুলের অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে চাকরি থেকে ততদিনে অবসরগ্রহণ করেছেন। এরপর নিয়েছেন ইটবহনের কাজ। আর জীবিকার তাগিদে অন্যের বাড়ি পরিষ্কার ও গৃহস্থালীর কাজ করেন শেফালি। কিন্তু তারপরও অর্থনৈতিক দৈন্যদশা পিছু ছাড়ছিল না তাদের। এমন অনেকদিনও গেছে, যেদিন পরিবারের দুই উপার্জনশীল সদস্য এক টাকাও আয় করতে পারেননি।
নথিপত্র নিয়ে কয়েকটি শুনানিতে হাজির হন শেফালি। সেসব নথিতে দেখা যায়, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির কাট-অফ ডেটের আগে থেকেই আসামে বাস করতে তার ঠাকুরদা। অন্যান্য কাগজপত্রের মাধ্যমে তিনি যে আসলেই শেফালির আত্মীয়, তা-ও প্রমাণিত হয়।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই যাতায়াত ও আইনি ফি'র জন্য টাকা সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে শেফালির জন্য।
টাকার অভাবে ২০১৭ সালে কয়েকটি শুনানিতে উপস্থিত হতে পারেননি শেফালি। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনাল তাকে অবৈধ অভিবাসীর তকমা দিয়ে দেয়। তার নাম ভোটার লিস্ট থেকে মুছে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়, এবং ভারতে বসবাসের আর কোনো আইনি অধিকারই তার থাকে না।
যেদিন অফিশিয়াল নোটিস এলো যে শেফালি একজন ভিনদেশি, তার পরিবারের কেউই মুখে তুলতে পারেনি কিছু।
শেফালি এরপর দ্বারস্থ হন মহিতোষ দাশের। এই আইনজীবী শেফালির কেসের মতোই প্রায় ৫০টি কেস নিয়ে কাজ করছিলেন।
মহিতোষের সাহায্যে আদালত থেকে ২০১৭ সালে একটি স্টে-অর্ডার পান শেফালি। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে আটকের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পান তিনি।
এরপর দীর্ঘ বিরতির পর ২০২১ সালে আবার শুনানির জন্য আদালতে ওঠে মামলাটি। আদালত রায় দেন, শেফালির দিক থেকে কোনো "ইচ্ছাকৃত অবহেলা" ছিল না। তাই ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশ দেওয়া হয় "বাই ওয়ে অব ডিফল্টের পরিবর্তে মেরিটের ভিত্তিতে" মামলাটি ফের গ্রহণের।
গত কয়েক মাস ধরে আসামের উচ্চ আদালত এভাবেই ট্রাইব্যুনালের বেশ কিছু সিদ্ধান্তে পরিবর্তন এনেছেন, যেখানে আদালতে কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই তাকে "ভিনদেশি" ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে শেফালির মামলাটি পুনরায় শোনা হয়, এবং তার সকল কাগজপত্রও খতিয়ে দেখা হয়। এরপর তার উপর থেকে আগের আদেশটি প্রত্যাহার করা হয়। অবশেষে, ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি শেফালি ভারতীয় নাগরিকের মর্যাদা পান।
ক্ষমতাশীল বিজেপির স্থানীয় সাংসদ পরিমল শুক্লবৈদ্য বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য শেফালির লড়াই বিশেষভাবে প্রশংসনীয়, কেননা তিনি এমন প্রত্যন্ত একটি এলাকা থেকে এসেছেন, যেখানে টিকে থাকাটাই দুরূহ।
সংগ্রাম চলছে
নিজের পরিচয়ের প্রমাণ দিয়েছেন শেফালি। এবার তার মনোযোগ স্বামী প্রবোধ রঞ্জন দাশের নাগরিকত্ব প্রমাণে।
প্রবোধকে আখ্যায়িত করা হয়েছে একজন "স্ট্রিমলাইন ফরেনার" হিসেবে, অর্থাৎ যিনি আসামে এসেছেন ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে। স্ট্রিমলাইন ফরেনারদের আটক করা হয় না বা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয় না, কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব ১০ বছরের জন্য বাতিল করা হয়। ফলে ১০ বছরের জন্য প্রবোধ ভোটাধিকার বা অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
৬২ বছর বয়সী প্রবোধ বলেন, তার কাছে দলিল রয়েছে প্রমাণ করার জন্য যে তার পূর্বপুরুষরা ১৯৬৬ সালের আগেই আসামে এসেছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে তিনি মামলা চালিয়ে যেতে অপারগ।
শেফালি-প্রবোধদের হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামের আরও ১৫টি পরিবারের সদস্যরাই বর্তমানে নাগরিকত্ব মামলায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
দুইবারের রাজ্যমন্ত্রী শুক্লবৈদ্য বলেন, তিনি অবগত আছেন যে ট্রাইব্যুনালের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত "সম্পূর্ণ ভুল" হতে পারে।
তিনি জানান, তার দল ভুলভাবে অবৈধ ঘোষিত মানুষদের সাহায্যের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শুক্লবৈদ্য আরও দাবি করেন যে এই সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে সরকার নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) প্রয়োগ করতে শুরু করলে। সিএএ আইনের ফলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ভারতে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এনআরসি ও সিএএ আইন ব্যবহৃত হবে ভারতে মুসলিমদের কোণঠাসা করে দিতে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের সমস্যার সমাধান করবেন, এই আশায় বিজেপিতে ভোট দিয়েছিল শেফালির পরিবার। কিন্তু শেফালির সাত বছরের অক্লান্ত সংগ্রাম শেষে আজ তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
"এই দুর্বিষহ যন্ত্রণার কথা আমি আমার বাকি জীবনে ভুলতে পারব না," তিনি বলেন।
- সূত্র: বিবিসি হিন্দি