ইউক্রেনে পুতিন তার লক্ষ্য জানেন, সেভাবেই লড়ছে রুশ বাহিনী
২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের কাছে স্পষ্ট ভাষায় 'যুদ্ধের অন্ত কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে' জিজ্ঞেস করেছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস।
কোনো সামরিক অভিযানের আগে তার রাজনৈতিক, কৌশলগত লক্ষ্য সম্পর্কে জানা সমর নেতাদের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। বুশ যে উত্তর দিতে পারেননি, তা কিন্তু পুতিন দিয়েছেন। ইউক্রেনের দুর্ভাগ্য সেখানেই।
পুতিন স্পষ্টভাবে তার জেনারেলদের জানিয়েছেন, ইউক্রেনে তাদের কোন কৌশলগত ও রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলি অর্জন করতে হবে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণাকে পুতিন নাম দেন 'বিশেষ অভিযান'। বলেন, ইউক্রেনকে অসামরিকীকরণ ও নাৎসিমুক্ত করতে আমাদের একাগ্র চেষ্টা করতে হবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ইউক্রেনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির তাগিদ দেন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের ভৌগলিক সীমানাকেও মানেন না পুতিন, যার অর্থ পুরো দেশটির নিয়ন্ত্রণ চান তিনি।
ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর অভিযানে শুরু হওয়ার পর এপর্যন্ত পুতিন ঘোষিত কৌশলগত লক্ষ্য পরিবর্তন হয়েছে- এমন কোনো ইঙ্গিত পাননি বিশ্লেষকরা।
পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিকদের অপসারণ, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের বিলুপ্তি- ক্রেমলিনের লক্ষ্য। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির ভাষায়, "ওরা আমাদের স্বাধীন জাতিসত্ত্বা মুছে দিতে চায়।"
এপর্যায়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক- মস্কো কীভাবে তার লক্ষ্যগুলো পূরণ করবে? উত্তর দিয়ে গেছেন, ১৯ শতকের সমর কৌশলবিদ কার্ল ভন ক্লউসউইৎজ। তিনি বলছেন, "শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত হেনে, জয়ের জন্য সর্বস্ব বাজি ধরার দুঃসাহস দেখিয়েই শত্রুকে পরাজিত করা যায়।"
ইউক্রেনে সে কেন্দ্র হয়ে উঠেছেন ভলোদমির জেলেনস্কি। রাশিয়া বিরোধী বক্তব্য রেখে, প্রতিরক্ষার নির্দেশ দিয়ে—তিনি মস্কোর লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছেন। তিনি রুশ বাহিনীর হাতে বন্দী বা নিহত হলে- ইউক্রেনীয়দের মনোবল অনেকটাই দুর্বল হবে।
রাশিয়ার ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্সের শক্তি, সক্ষমতা সুবিশাল- যার পুরোটাই এখন জেলেনস্কির অবস্থান শনাক্তে ব্যবহৃত হবে। যুদ্ধের শুরুতেই তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে গুপ্ত কম্যান্ডো বাহিনী পাঠিয়েছে মস্কো। প্রেসিডেন্টের একান্ত অনুচরদের ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য জানতে গত কয়েক মাস ধরেই রুশ গুপ্তচররা চেষ্টা করছে।
চেষ্টাটি এপর্যন্ত সফল হয়নি। তবে গুপ্তচর, বিশেষ বাহিনী ও ইলেকট্রনিক শক্তির জাদুকরি কাজে না দিলে, দিনশেষে বিমান ও গোলন্দাজ ইউনিটের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে জেলেনস্কির আত্মগোপনে থাকার সম্ভাব্য সব আশ্রয় গুঁড়িয়ে দেবে রাশিয়া।
পুতিনের দ্বিতীয় লক্ষ্য 'বেসামরিকীকরণ' সম্পর্কে ক্লউসউইৎজ বলেছেন, "শত্রুর ক্ষমতার কেন্দ্র ধবংস শুরুর সেরা উপায়—তার হয়ে লড়াই করা যোদ্ধাদের পরাজিত ও ধবংস করা।" রুশ বাহিনী এখন সে চেষ্টাই করছে।
ইউক্রেনে আমেরিকা বা ন্যাটো জোট হামলা করলে তাদের কোনো পদাধিক সেনা দেশটির মাটিতে পা রাখার আগেই সমস্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ধবংস করে দেওয়া হতো। গুঁড়িয়ে দেওয়া হতো বিমান বাহিনী। তারপর স্থলবাহিনী এসে শত্রুর বাদবাকী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার কাজটি শেষ করতো।
রাশিয়া এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। কিছুটা করলেও তাতে তেমন সফলতা পায়নি। ব্যর্থতাটি হতে পারে পরিকল্পনার অভাব, অদক্ষতা বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফসল। কিন্তু, ভুলে গেলে চলবে না, ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ এখনও আছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে রুশ জেনারেলরা শিখছেন, রণ-পরিকল্পনার নিয়মই এমন। তাদের সামনে নির্ধারিত লক্ষ্য থাকায় তারা এই ত্রুটিগুলো কাটিয়েও হয়তো উঠবেন।
- সূত্র: দ্য কনভারসেশন অবলম্বনে