রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি কি বৈশ্বিক জ্বালানি মানচিত্রকে নতুন রূপ দেবে?
তেল ও গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজারে আলজেরিয়া মধ্যম-মানের এক খেলোয়াড়। কিন্তু ইউরোপে জ্বালানি সংকট উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির গুরুত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
ভূমধ্যসাগরের তলদেশে প্রায় অব্যবহৃত একটি পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে আলজেরিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ ৪০ শতাংশ বাড়ানোর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে কয়েক সপ্তাহ আগে আলজিয়ার্সে পাড়ি জমান ইতালির প্র্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি।
অ্যাঙ্গোলা, নাইজেরিয়া বা কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মতো অন্যান্য তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক যারা আগে বৈশ্বিক জ্বালানির আলোচনায় খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তারাও ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় দেশগুলোও রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমাতে বেশি দামে কাতার কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো অপেক্ষাকৃত বিশ্বস্ত দেশগুলো কাছ থেকে জ্বালানি নিতে তাড়াহুড়ো শুরু করেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে সৃষ্ট জ্বালানি সংকটেরই প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। রুবলে অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেট ভ্লাদিমির পুতিন বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে পশ্চিমাদের একহাত দেখে নিয়েছেন। জার্মানি ও ইতালিসহ রাশিয়ার গ্যাসের অন্যান্য বৃহৎ গ্রাহকরা তাদের নাগরিকদের আশ্বস্ত করছে যে, জ্বালানি সরবরাহ কমানো নিয়ে পুতিনের হুমকি দীর্ঘমেয়াদে বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও তারা সমাধান খুঁজছে।
তবে এতকিছুর পরেও আগামী ১৮ মাস ইউরোপের জন্য কঠিন একটি সময় হতে চলেছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব বিশ্বজুড়ে পড়তে শুরু করেছে। কারখানায় জ্বালানি সরবরাহ থেকে শুরু করে ঘর গরম রাখা এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে লড়াই করছে বিভিন্ন দেশ। রাশিয়া সরবরাহ বন্ধ করে দিলে আসন্ন শীতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকানোর মতো বিকল্প কারও হাতেই নেই। চলতি মাসেই জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করেছে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে দেশটির অর্থনীতি ২ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্বালানি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড চাউ বলেন, "বেশ বিপজ্জনক এক খেলা চলছে। জানি না এটা কীভাবে শেষ হবে। মনে হচ্ছে শেষটা পশ্চিম ইউরোপ ও রাশিয়া উভয়ের জন্যই খারাপ হবে।"
"সরকার যতই হিসেব কষুক না কেন, কেউই আরও দ্রুত তরল প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে সক্ষম হবে না," বলেন তিনি।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল ইয়ারগিন বলেন, রাশিয়া আকস্মিকভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় হঠাৎ করেই বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের পুনর্বিন্যাস ঘটছে।
ইউরোপকে এখন জোড়াতালি দিয়ে গ্যাস সংগ্রহ করতে হবে। ইতালি আলজেরিয়া থেকে, বুলগেরিয়া গ্রিস থেকে এবং পোল্যান্ড নরওয়ে থেকে দীর্ঘপরিকল্পিত পাইপলাইন সম্প্রসারণের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহের দিকে ঝুঁকবে।
"বিশ্ব জ্বালানি বাজারের অপ্রত্যাশিত ও নাটকীয় পুনর্বিন্যাস ঘটবে। দুই মাস আগেও ইউরোপীয়রা রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনি। আর এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নই হলো আর কতদিন জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ থাকবে? আর পুরো বিষয়টিই ঘটছে খুব দ্রুত গতিতে। বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়া ২২ বছর ধরে যে জায়গা করে নিয়েছে, তা পুতিন ৮ সপ্তাহের মাথায় নষ্ট করেছেন," বলেন ইয়ারগিন।
ইউরোপের অর্থনীতির চালিকাশক্তি জার্মানি এরকম একটি সময়ের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিল না। ইউক্রেন আক্রমণের আগে জার্মানির অর্ধেকের বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস রাশিয়া থেকে আসত।
বর্তমানে জার্মানি তা ৩৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া পুরোপুরি চলার মতো অবস্থা জার্মানির নেই। তরলীকৃত গ্যাস আমদানির জন্য দেশটির অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এছাড়া পারমাণবিক শক্তিবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে জার্মানিতে মাত্র তিনটি পারমানবিক চুল্লি সক্রিয় রয়েছে। ২০১১ সালে জাপানের ফুলুশিমা পারমানবিক কমপ্লেক্সে সুনামি আঘাত হানার পর বাকি ১৪টি চুল্লি বন্ধ করা হয়।
এদিকে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানিও ৩৫ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে জার্মানি।
রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার পরিবর্তে ইউরোপকে এখন বেশি দামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে, যেখানে সাত বছর আগেও গ্যাস রপ্তানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। . মেক্সিকো উপসাগর থেকে ইউরোপে গ্যাস ট্যাঙ্কার আনতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে প্রতি হাজার ঘনফুটের জন্য বাড়তি দেড় ডলার দিতে হবে, যা গ্যাসের মূল দামের প্রায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। এরপর সব মিলিয়ে ২৪ দিনের ট্রানজিট শেষে খালি জাহাজ নিয়ে ফিরতে হবে।
বিকল্প খুঁজতে ইউরোপীয় দেশগুলো ভিন্ন ভিন্ন উৎসের দ্বারস্থ হলেও জ্বালানি উৎপাদকরা চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পাছে না। এরকম পরিস্থিতিতে অন্তত দুই থেকে চার বছর সময় প্রয়োজন হয়। একইসঙ্গে বিনিয়োগকারীরা নতুন কারও সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে যেতেও ভয় পাচ্ছে, কেননা সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো শীঘ্রই পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে জোর দেওয়ার কথা ভাবছে। সৌর ও বায়ুর মতো নবায়নযোগ্য শক্তিগুলো বর্তমান সংকটের সময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সরবরাহ চেইন সংক্রান্ত জটিলতা ও পরিবেশগত বিভিন্ন বিতর্কের কারণে তা দীর্ঘমেয়াদী আলোচনায় রূপ নেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
দুই দশক ধরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মূল্য কমলেও গত বছর তা বেড়েছে। এছাড়া ইউরোপে এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহারের খুব বেশি ক্ষেত্রও তৈরি হয়নি।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রয়ে সমঝোতাকারী প্রতিষ্ঠান লেভেলটেন এনার্জির ইউরোপীয় অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্লেমিং সোরেনসন বলেন, "সমস্যা হলো কোনো সরবরাহ অবশিষ্ট নেই। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য খুব কম চুক্তিই অবশিষ্ট আছে যেগুলো ২০২৪ সালের আগে স্বাক্ষর বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।"
এদিকে ইউরোপ আমেরিকার প্রাকৃতিক গ্যাস চাইলে যুক্তরাষ্ট্র গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
তবে একটি জিনিস জ্বালানি ভোক্তা দেশগুলোর চাপ কিছুটা কমাতে পারে। আর তা হলো বিশ্ব অর্থনীতির মন্থরতা। চীনে করোনা ভাইরাস ঠেকাতে আরোপিত নতুন লকডাউনে বিশ্বে তেলের চাহিদা এক মিলিয়ন ব্যারেল কমার কথা অনুমান করেছে এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল। ফলে চীন যে রাশিয়াকে সাহায্য করবে সেই সুযোগও কমে গেছে। আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশ কৌশলগতভাবে প্রতিদিন ১.৩ মিলিয়ন ব্যারেল মজুদ কমাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অনুমান অনুযায়ী চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির গতি ৩.৬ শতাংশ পর্যন্ত কমবে।
বছরের সেই সময় এসে গেছে যখন ইউরোপের গ্যাস মজুদ তৈরির কথা। গত বছর রাশিয়া সরবরাহ কমিয়ে আনলে শীতে জ্বালানি ঘাটতি দেখা দেয়। রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় থাকবে জার্মানি, ইতালি ও হাঙ্গেরি যাদের গ্যাস মজুদ বর্তমানে যথাক্রমে মাত্র ৩৩.৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ১৯.৪ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে।
পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নির্ভর করছে ক্রেমলিনের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। রাশিয়া গ্যাস ও তেলের রাজস্বের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। ইউরোপের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করলে রাশিয়া নিজেই অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। দেশটির ইউরোপীয় ক্রেতারা ইতোমধ্যে ২০২৭ সালের ভেতর রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইউরোপের বিরুদ্ধে রাশিয়া জ্বালানি চাহিদার যে অস্ত্র রাশিয়া ব্যবহার করছে, তার ক্ষমতা দিন দিন কমছে।
সবমিলিয়ে এখন আলজেরিয়াসহ অন্যান্য আফ্রিকান দেশের জন্যই সামনে সম্ভাবনাময় দিন অপেক্ষা করছে।
"কিন্তু প্রধান যে বিষয়টি আলজেরিয়াসহ অন্যান্য আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তা হলো, রাশিয়ার সস্তা ও সহজলভ্য গ্যাসের প্রতি ইউরোপের দুর্বলতা," বলেন ক্যালিফোর্নিয়ার ব্রেকথ্রু ইনস্টিটিউটের আফ্রিকান জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিজয়া রামচন্দ্রন। "এমনকি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাওয়ার আগ অবধি ইউরোপ রাশিয়াকেই জ্বালানির সহজ উৎস হিসেবে দেখছিল, কেননা এর জন্য নতুন কোনো পাইপলাইন, অবকাঠামো বা বিনিয়োগেরও প্রয়োজন পড়বে না।
"আফ্রিকা দীর্ঘসময় ধরেই প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নে আগ্রহী। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা বরাবর বলে আসছে যে এটা বেশ দূরের, অনেক কঠিন ও ব্যয়বহুল কাজ হবে। কিন্তু হিসাব বদলে গেছে। ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা এখন মজুদ থাকা দেশগুলো নিয়ে বেশ আগ্রহী। আফ্রিকার সুযোগ এখনই," বলেন তিনি।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট