জুতোবিদ্যা ক্যালসিয়োলজি
জুতো সম্পর্কে ঢের জ্ঞান প্রজ্ঞার কথা যিনি বলতে পারেন, নিশ্চয় তাকে জুতোবিজ্ঞানী বা ক্যালসিয়োলজিস্ট বলা যাবে। গ্রিক ও রোমান উভয় সভ্যতাই পায়ের যথেষ্ট কদর করেছে এবং পাদুকা ফ্যাশনপ্রিয় একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর ভরসা করলে এবং এখন থেকে ১৩৬ বছর আগে তাঁর লেখা জুতো আবিষ্কারকে স্বীকার করে নিলে ক্যালসিয়োলজির সূচনা যে রাজা হবুচন্দ্রের আমলে এ নিয়ে আর সন্দেহ থাকে না-
কহিলা হবু শুন গো গোবুরায়
কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র,
মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়।
ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র।
রাজা হবুচন্দ্র প্রকৃত সমস্যাটি ধরতে পেরেছিলেন :
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি
রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি!
অশ্রুসিক্ত পাকা দাড়ি নিয়ে উজির গবুচন্দ্র হবুর পাদপদ্মে বিনীত নিবেদন রাখলেন-
'যদি ধুলা না লাগিবে তব পায়ে
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে।
এটাও বিবেচ্য। রাজ্যের সব জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত একটি রাজকীয় সমাধান দিলেন: পঞ্চকে ধূলির ছোঁয়া থেকে রক্ষা করতে চামড়া দিয়ে পৃথিবী মুড়ে দেওয়ার পরামর্শটিই সবচেয়ে গুরুত্ব পেল, তবে সে ক্ষেত্রে দক্ষ চর্মকার পাওয়াটা নিশ্চিত করতে হবে। বৃদ্ধ চর্মকার প-িতদের সব পরামর্শ নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন :
নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।
এই সহজ সমাধানের পর হবুচন্দ্র প-িতদের যখন শুলে চড়াতে নির্দেশ দিলেন, গবুচন্দ্র বললেন, এটা তো তার মনেও ছিল, কেমনে ব্যাটা পেরেছে তা জানতে। হবুচন্দ্রের জ্ঞান কোনোটা অনাবিষ্কৃত থাকলেও ক্যালসিয়োলজি চর্চা যে এখনো পূর্ণোদ্যমে চলছে, জুতো আবিষ্কার জুতোর নিত্যনতুন চেহারা নির্মাণ যে এখনো শেষ হয়নি, তা নিশ্চিত।
এই লেখাটিতে জুতোবিদ্যা নিয়ে নয় বরং জুতোর স্মৃতি নিয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ একত্রিত করা হয়েছে। এই কয়েকটি আবার ব্যক্তিগত জুতোস্মৃতি।
১৯৭৫ সালে দার্শনিক সাইদুর রহমানের (১৯০৯-৮৭) মুখে শোনা একটি জুতোকাহিনি লিখছি। আবারও বলছি অন্য কারও মুখে নয়, সরাসরি তাঁর মুখেই শুনেছি। তিনি সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর পিতৃপুরুষের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসুলপুর গ্রামে এলেন। স্ত্রীর অঙ্গে বিয়ের সাজ, পায়ে চামড়ার জুতো। বাড়ি না পৌঁছাতেই খানিকটা পথ হেঁটে আসায় এই দম্পতির পায়ের দিকে যাদের নজর পড়েছে, তাদের মধ্যে বিদ্বজ্জনেরা ততক্ষণে রটিয়ে দিয়েছেন সাইদুর রহমান তো একজন বাইজি বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন। সাইদুর রহমান নিজে তখন বর্ণনা করছিলেন, (এই রটনা ডালপালা মেলতে মেলতে ততক্ষণে)... রটনা কেবল বাইজিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বারবনিতা, বেশ্যা এসবও যোগ হয়ে গেছে। ভাগ্য, যৌনকর্মী কথাটা তখনো চালু হয়নি। নতুন বউ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে পারেন। সুতরাং সাইদুর রহমানকে পাশের গ্রাম থেকে একটি হারমোনিয়াম ধার করে আনতে হলো। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার পর ব্যাপারটা পুরোই নিশ্চিত হয়ে গেল। এ নারী বাইজি না হয়ে যায় না। যারা বলেছে ভুল বলেনি। পায়ে জুতো, আবার হারমোনিয়ামও বাজায়- এই নারী বাইজি না হওয়ার কারণ নেই!
এখানে মূল বিষয়টি জুতো। বাংলায় কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে জুতো পরতেন না। স্যান্ডেল চালু ছিল। পুকুরে গোসল করতে আসা পতিতাদের মধ্যে জুতোর প্রচলন ছিল। পুরোনো দিনের ঢাকার একটি বিবরণীতে পড়েছি, জুতো পরা নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নগরের সুধীজন উদ্বিগ্ন।
শুধু বাংলাতেই নয় ইউরোপেও বিশেষ ধরনের হাই হিল জুতো 'হুকার শু' বা বারবনিতার জুতো নামে পরিচিত হয়েছে। এসব জুতোর গোড়ালিকে 'হুকার হিল' বলা হয়। মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্টে সংরক্ষিত কিছু 'প্লেজার শু' আদিম পেশার নারীরা ও নৃত্যশিল্পীরা এ ধরনের জুতো ব্যবহার করেছেন। ১৯৭০ দশকের টেলিভিশন সিরিয়াল দ্য ডিউস-এর কস্টিউম ডিজাইনার আদ্রা টেরাজা বলেছিলেন: এ যুগে ফ্যাশন হলিউড থেকে আসছে না। আসছে হুকার্স মার্কেট থেকে। অন্তত লেডিস জুতো এবং চামড়ার স্বল্পদীর্ঘ জ্যাকেট তার সাক্ষ্য দেবে। লন্ডনের সোহো স্ট্রিট, নিউইয়র্কের ফর্টি সিক্সস অ্যাভিনিউ নতুন ডিজাইনের জুতোর সুতিকাগৃহ।
সুইসাইড বোমার আর স্যুইসাইড বোমার
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু পাদুকাঘাতের ঘটনা থাকলেও ১৪ ডিসেম্বর ২০০৮ সাংবাদিক মুনতাধার আল-জাইদি প্রেসিডেন্ট বুশকে জুতো নিক্ষেপ করেছিলেন, তাই তিনি পরিণত করে স্যুইসাইড বম্বারে (Shoeicide bomber)। মুনতাধারের নিক্ষিপ্ত জুতো টার্গেট ছুতে ব্যর্থ হলেও ইংরেজি অভিধান একটি নতুন শব্দ লাভ করেছে।
ইরাকের রাজধানী বাগদাদে এক সংবাদ সম্মেলনে কায়রোভিত্তিক বাগদাদিয়া টেলিভিশনের সাংবাদিক মুনতাধার আল-জাইদি রাজনৈতিকভাবে অশুদ্ধ এক আচরণের আশ্রয় নিয়ে তাঁর নিজের এক পাটি জুতো প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে ছুড়ে মারলেন এবং বললেন, 'হে কুকুর, জনগণের পক্ষ থেকে আপনার জন্য এটাই আমাদের উপহার।'
মুনতাধার যে ভালো শু-সুটার নন, তা প্রমাণিত হয়ে গেল। সাধারণত পরপর দুটি আক্রমণ হয়ে থাকে, বুশ এটা ভালো জানতেন। দ্বিতীয় পাটি জুতোকে ডজ দিয়ে জর্জ বুশ মাথা বাঁচিয়ে নিলেন। ব্যর্থতার পরও স্যুইসাইড বম্বার মুনতাধার আল জায়িদি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। জুতোপর্ব শেষ হলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জর্জ বুশ বলেন, ওটা দশ নম্বর জুতো। স্যুভেনির এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টদের প্রাপ্য বিবেচনা করে বুশ সাহেব জুতোজোড়া হোয়াইট হাউসে 'শোকেইসড' করেছেন বলে নিন্দুকেরা হাস্যরস করেন। তবে এটা বাস্তব, কিছুদিন জেল খেটে নগ্নপদে বের হওয়া মুনতাধারকে এক জোড়া জুতো যৌতুক দিয়ে বিয়ে করার জন্য আরব কন্যাদের লাইন পড়েছিল।
গ্লোরিয়া স্টেইনেমের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে: জুতো যদি পায়ে না লাগে, তাহলে পা বদলে ফেল। এই কথা অনুসরণ করে আমেরিকানরা বলল, জুতো যদি প্রেসিডেন্টের গায়ে না লাগে, তা হলে প্রেসিডেন্ট বদলে ফেল। তাই হলো, বুশের পওে প্রেসিডেন্ট হলেন বারাক ওবামা।
হাশ পাপি
সাধ করে বাটার এক জোড়া পাপি শু কিনলাম। হাশ পাপির দাম একটু বেশি তাই সব জায়গায় পরি না। আ পরলেও জুতোকে মসজিদে হোক, জানাজা বা কুলখানি কিংবা অন্য কোনো মিলাদে হোক, মাহফিলে হোক, জুতোজোড়া অনেকটা বগলদাবা করে কাছে কাছেই রাখতাম। দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। আফটার অল নতুন জুতো। ছয়-সাত মাস লাগাতার ব্যবহারের পর এর ঝকমকে কালো ভাবটা কমে এল, চোখে চোখে রাখার তাগাদাও কমল। তারও কিছুকাল আগে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মৃত্যুবরণ করে আমার বন্ধু খন্দকার আবদুস সামি। সেদিন বাদ আসর তার জানাজা সেরে বহু খোঁজাখুজি করেও আমার প্রায় নতুন সান্ডেল হাশ পাপি শু-জোড়া আর খুঁজে পেলাম না। যিনি ভুলবশত আমার শু-জোড়া নিয়েছে, নিশ্চয়ই তার জোড়াটা আমার জন্য রেখে যাবেনÑকিন্তু অবশিষ্ট কিছুই রইল না। আমার অবস্থা দেখে সামির আত্মীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরুল ইসলাম সহানুভূতি জানিয়ে বললেন, মসজিদে জুতো চুরি এমন নতুন কিছু নয়।
সে সময় জানাজায় অংশ নিতে আসা আমার বন্ধু আকতার আহমেদ তার গাড়িতে থাকা এক জোড়া চপ্পল দিয়ে খালি পায়ে বাড়ি ফেরার বিড়ম্বনা থেকে আমাকে রক্ষা করলেন।
আরেক জোড়া হাশ পাপির গল্প। ১৭ অক্টোবর ২০০৯, শনিবার, আমার বন্ধু শহীদ খোন্দকার টুকুর মায়ের কুলখানি। তিনি তখনকার সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ প্রধান জিয়াউল হক খোন্দকারের মা এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য রেজিস্টার শামসুল হক খোন্দকার সাহেবের স্ত্রী। মিলাদ ও মোনাজাতের সময় আমি যাদের পাশে ছিলাম, তাদের একজন আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ এ সারোয়ার, অপরজন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা।
আমাদের পাদুকাজোড়া আমাদের ঠিক পেছনেই। মিষ্টান্নপর্ব শেষ হওয়ার পরও আমি রয়ে যাই। যখন আমার যাওয়ার সময় হয়েছে বলে মনে করে জুতোর কাছে আসি, এক জোড়া পাই বটে, কিন্তু আমার জুতোজোড়া নেই। যে জোড়া পাই, তার নাম হাশ পাপি, বয়সও মাস দুয়েকের বেশি হওয়ার নয়-অবশ্যই গুণেমানে অর্থমূল্যে আমার জোড়ার চেয়ে অধিক সম্মানের এই হাশ পাপি। কেউ যে ফিরে এসে এ জোড়া ফিরিয়ে নেবেন এবং আমার জোড়া ফেরত দেবেন, সে সম্ভাবনাও নেই। আমি জিয়াউল হক খোন্দকারকে বিষয়টি জানাই, তিনি রায় দেন পায়ে ফিট হলে এটাই তোমার জুতো। পায়ে যে ফিট হবে আমি নিশ্চিত। আজও অন্ধকারে আমার পুরোনো জোড়াকে যিনি নিজের মনে করে পরে নিয়েছেন এবং তার পায়ে ফিট হয়েছে, এ জোড়া তো তারই। কাজেই আমরা উভয়েই যে সমপদী, তাতে সন্দেহ নেই।
অপেক্ষাকৃত নতুন এবং আমার জোড়ার চেয়ে বেশি দামি হাশ পাপি হওয়ায় জুতোজোড়া পায়ে লাগিয়ে একটি অপরাধবোধ নিয়ে বাড়ি ফিরি। পরদিন সেই জোড়া নিয়ে যখন বের হই, কেবলই মনে হয়, আশেপাশের সবাই আমার জুতোর দিকেই তাকাচ্ছেন এবং সম্ভবত এটাও বলছেন, তলে তলে আপনিও জুতোচোর!
কয়েক দিন পর নিশ্চিত হলাম একজন উদারপন্থী জুতোমালিকের ঈষৎ ভুলে আমিই হাশ পাপির নব্য আধিকারিক। কিন্তু জনে জনে রুচিরও কিছু হেরফের ঘটে থাকে। জুতোর ওপরে ডানে ও বাঁয়ে সোনালি পাতে হাশ পাপি লেখা। কিন্তু সোনালি পাত যে আমার ভালো লাগছে নাÑসুতরাং টেনে পাত দুটো তুলে ফেললাম- এ অবস্থায় দেখলে মূল মালিকও তার জুতো চিহ্নিত করতে পারবেন না। প্রাক্-মৃত্যু কনফেশনের মতো আমিও জানিয়ে যেতে চাই, মসজিদে কিংবা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে জুতোজোড়া চুরি হলে ভুলতে তেমন সময় লাগে না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেখান থেকে অনুপার্জিত ভালোকিছু পেয়ে গেলে এক ধরনের অপরাধবোধ খোঁচা দিতেই থাকে। সেই হাশ পাপি এত দিনে জীবাশ্ম হয়ে গেছে, কিন্তু আমার জন্য, একটি খোঁচা রয়েই গেছে-'জুতোজোড়া কিন্তু তোমার নয়।'
একপাটি পাম্প শু?
শ্রীকান্ত যাদের পড়া আছে, হুট করেই ধরে ফেলবেন কলকাতার বাবুটির কথা: ডাঙার রুচিকর হাওয়ায় বাবুর ক্ষুধার উদ্রেক হইল এবং দেখিতে দেখিতে সে ক্ষুধুা অবিশ্রান্ত বকুনির চোটে একেবারে ভীষণ হইয়া উঠিল...রাত্রি যখন এগারোটা বাবু কাবু হইয়া বলিলেন, হ্যাঁ, রে ইন্দ্র, এদিকে খোট্টামোট্টার বস্তিটস্তি নেই? মুড়িটুরি পাওয়া যায় না?
রিক্তহস্তে ইন্দ্র ও শ্রীকান্ত যখন ফিরে এল, এই নতুন দাদাটির কোনো হদিস আর পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুজির পর, অশ্রুত পূর্ব 'ঠুনঠুন পেয়ালা' সংগীত শুনে, অদৃষ্টপূর্ব বাবুগিরির পোশাকের বাবুটিকে তাড়া করে গেঁয়ো কুকুরগুলো তাকে নদীতে ফেলে তুষারশীতল জলে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখেছে বলা যায়- জীবন বাজি রেখে দুই কিশোর যখন তাদের শহুরে দাদাটিকে টেনেহিঁচড়ে ডাঙায় তুলল- 'কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে বাবু ডাঙ্গায় উঠিয়াই প্রথম কথা কহিলেন, আমার একপাটি পাম্প?' পাম্প বলে নতুনদা ভুল করেননি। পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপীয় পুরুষেরা ফ্ল্যাট প্লিমসোলের ফিতে বাঁধার ঝামেলাহীন চীনা জুতোগুলোকে পাম্পই বলত।
হেমিংওয়ের কথিত বিশ্বের খুদে গল্প। গল্পটি হেমিংওয়ের কিনা বিতর্ক আছে।
For sale: baby shoes, never used.
ছয় শব্দের এই গল্পটি ভীষণ কষ্টের একটি গল্প।
জুতোবিদ্যার বয়স
১৫ হাজার বছর আগের স্প্যানিশ গুহাচিত্রে পায়ে বুট পরা মানুষের স্পষ্ট আভাষ পাওয়া যায়। তবে জুতোর ব্যবহার শুরুর সময়টা এখন থেকে অন্তত ২৬০০০ বছর আগে। ৪০০০০ বছরও হতে পারে। ক্যালসিয়োলজির উদ্ভব তখনই।