জুতো যখন নারীর শেকল
জুতোর কতই না শক্তি!
মানবসভ্যতার ইতিহাসের দিকে যদি পেছন ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, জুতোর সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে ক্ষমতায়নের।
বিভিন্ন উপকথা ও রূপকথার গল্প তো আরও এক কাঠি সরেস। সেখানে জুতোর 'জীবন বদলে দেওয়া' জাদুকরি বা ঐশ্বরিক শক্তি নিছকই উপমা নয়, পুরোপুরি বাস্তব।
যদি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করতে যাওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে সাহিত্যে জুতোর এ ধরনের অনন্যসাধারণ উপস্থাপনের মূল ভিত্তি শুধু এটিই নয়, অনেক জুতো হয়ে থাকে চুনি বা রত্নখচিত, পাশাপাশি এটিও যে জুতো হলো সেই বর্ম, যার সাহায্যে নারীরা পা রাখে পৃথিবীর রুক্ষ-কঠিন জমিনে এবং সেই সুবাদে বদলে যায় তাদের জীবন, ভালো অথবা মন্দের দিকে।
'দ্য ওয়্যারিং অ্যান্ড শেডিং অব এনচান্টেড শুজ' প্রবন্ধে ইসাবেল কার্ডিগোস লিখেছেন, 'জুতো হলো একধরনের প্যারাডক্সিকাল বস্তু। কারণ, এটি হয়তো মানুষের দুই পাকে আবৃত করে দেয়, কিন্তু আবার মানুষকে স্বাধীনতা দেয় বিপুল দূরত্ব অতিক্রমের।'
কল্পকাহিনির জুতোও একই ধরনের বৈপরীত্যে ভরপুর। আপাতদৃষ্টে দেখা যায়, তারা নারীদের জীবনে 'ইতিবাচক' রূপান্তর ঘটাচ্ছে। অথচ সেই 'হ্যাপিলি এভার আফটার' কিন্তু মূলত সীমাবদ্ধ থাকছে কেবলই চিরাচরিত কিছু জেন্ডার নর্ম ও স্টেরিওটাইপে।
এই আলোচনায় সর্বাগ্রে চলে আসে রূপকথার যে কাহিনিটির কথা, সেটি অবশ্যই 'সিন্ডারেলা'। এটি হলো এমনই একটি কাহিনি, যেখানে আমরা দেখতে পাই জুতোর অভাবনীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এক নারী কীভাবে তার 'পুরুষ মানুষটির' বাহুবন্দী হয়ে সমাজের সিঁড়ি ভেঙে উচ্চতর পর্যায়ে আরোহণ করছে।
সিন্ডারেলার আখ্যানের অসংখ্য পশ্চিমা সংস্করণ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ১৮৫০-এর দশকে গ্রিম ভাইদের লেখা সংস্করণটি। সেখানে জুতোকে দুবার দেখা যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে।
প্রথমবার আমরা দেখতে পাই, চোখের পলকে সিন্ডারেলার পরনের মনোমুগ্ধকর জামাকাপড় সব উধাও হয়ে যাচ্ছে এবং সেগুলোর বদলি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে শতচ্ছিন্ন পোশাক ও কাঠের জুতো। এভাবে পরনের পোশাক ও জুতোর মাধ্যমে নির্দেশিত হচ্ছে সিন্ডারেলার দুরবস্থা এবং সেই দুরবস্থা আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠছে, যখন সিন্ডারেলার সৎমা ও বোনেরা তাকে নির্দেশ দিচ্ছে ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম একা হাতে সামলাতে
কিন্তু পরে আবার দেখা যায়, একটি জাদুর পাখির কাছ থেকে সিন্ডারেলা উপহার পাচ্ছে চমৎকার গাউন ও একজোড়া এমব্রয়ডারি করা রেশমি হিলের জুতো। ফলে সিন্ডারেলা ফিরে পাচ্ছে তার দৃষ্টিনন্দন রূপ। অর্জন করছে যুবরাজের বধূ-নির্বাচন আয়োজনে অংশ নেওয়ার সামর্থ্য। রেশমি হিলের জুতো পরেই সিন্ডারেলা ধাবিত হচ্ছে এক করুণ জীবন থেকে তার স্বপ্নীল, সুখময় জীবনের পানে।
জাদুকরি জুতো আরও অনেক কাল্পনিক নারী চরিত্রকেও তাদের প্রকৃত স্থানে ফিরে যেতে সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু তা সব সময় রাজকীয় জীবনে নয়। অন্তত একটি ক্ষেত্রে, এক নারী ফেরে তার আপন বাড়িতে, ক্যানসাসের এক ফার্মে।
ফ্র্যাঙ্ক বমের দ্য ওয়ান্ডারফুল উইজার্ড অব ওজ এবং পরবর্তী সময়ে জুডি গারল্যান্ড অভিনীত ১৯৩৯ সালের চলচ্চিত্রে ডরোথি নামের এক কিশোরী তার খালা-খালুর সঙ্গে বাস করে একটি ফার্মে। যদিও ডরোথির পথের সাথি হিসেবে রয়েছে কাকতাড়–য়া, টিন ম্যান, কাওয়ার্ডলি লায়ন এবং তার ছোট্ট কুকুরছানাটি, তারপরও তার সবচেয়ে মূল্যবান সঙ্গী অবশ্যই তার রুবি স্লিপার (যদিও এটি দেখা যায় চলচ্চিত্রে, বইয়ের জুতোজোড়া ছিল রুপার)।
একদিন যখন বাড়িতে ডরোথি ও তার কুকুরছানা টোটো বাদে আর কেউ ছিল না, তখন এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এসে তাদের বাড়িটাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কোনো অদ্ভুত দেশে। নিজের অজান্তেই ডরোথি মেরে ফেলে ওজ নামের সেই দেশের দুষ্ট জাদুকরকে এবং তার পায়ে চলে আসে নিজের পুরোনো কালো জুতোর বদলে উইকেড উইচ অব দ্য ইস্টের রুবি স্লিপার।
ডরোথি জানতে পারে, তাকে ক্যানসাসে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কেবলই উইজার্ড অব ওজ। তাই সে হলুদ ইট বিছানো রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে থাকে ওজের জাদুকরের উদ্দেশে। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ডরোথি সমর্থ হয় ওজের জাদুকরের কাছে পৌঁছাতে। জাদুকর তাকে জানায় যে বাড়ি ফেরার উপায় সব সময় ডরোথির পায়েই ছিল। ফার্মে ফিরে যেতে ডরোথিকে কেবল জাদুকরি রুবি স্লিপারের হিলে তিনবার ক্লিক করতে হতো।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, ডরোথির সঙ্গে তার জাদুকরি জুতোর সম্পর্ক সিন্ডারেলার কাহিনির চেয়ে একেবারেই আলাদা। সিন্ডারেলা চেয়েছে তার বর্তমান অবর্ণনীয় দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পেতে, রাজপ্রাসাদে যেতে, যেখানে সে নিজের ইচ্ছেমতো অভিজাত জামা-জুতো পরতে পারবে।
অন্যদিকে ডরোথি চায়নি রত্নখচিত জুতো। সে চেয়েছে তার নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে, যেখানে তাকে পরতে হবে পুরনো ফার্ম ফুটওয়্যার, কিন্তু সে পাবে তার প্রিয়জনদের সান্নিধ্য।
শেষমেশ সিন্ডারেলা ও ডরোথি দুজনেই পেয়েছে তাদের নিজ নিজ 'হ্যাপিলি এভার আফটার', তাদের ৭ নম্বর সাইজের জুতোর কল্যাণে।
কিন্তু জুতো সব সময়ই যে এতটা বন্ধুভাবাপন্ন পথের সাথি হয়, তা-ও কিন্তু না। নতুন জুতো পায়ে দিয়ে সারা দিন অস্বস্তিতে থাকা কিংবা পায়ে ফোসকা পড়ার অভিজ্ঞতা প্রায় সব মানুষেরই জীবনে এক-আধবার হয়েছে। তখন আর জুতোকে বন্ধু নয়, মনে হয় যেন সাক্ষাৎ শত্রু!
জাদুর জুতোও মাঝেমধ্যে অত্যন্ত নিষ্ঠুর, পুরুষতান্ত্রিক পৈশাচিক হতে পারে, যা পাপমোচনের নাম করে নারীদের দিয়ে কঠিন কঠিন সব কাজ করিয়ে নেয়।
নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, লোহার তৈরি জুতো অনেক সময় ব্যবহৃত হয় কঠোর অধ্যবসায় ও আত্মবিসর্জনের রূপক হিসেবে। এ ধরনের জুতোই নারীদের কাছে আসে পরীক্ষা নিতে, যেন সেই পরীক্ষায় পাসের পর তারা যুবরাজ, রাজা কিংবা নিছকই তথাকথিত পুরুষসিংহের অনুগ্রহ লাভ করে 'ধন্য' হয়।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় ডিসএনচান্টেড হাসব্যান্ড নামের একটি বুলগেরিয়ান আখ্যানের কথা। সেই গল্পে নায়িকাকে তার বাবা বিয়ে দিয়ে দেয় একটি ঘোড়ার সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলা ঘোড়ার আস্তাবলে ঘোড়াটি রূপান্তরিত হয় একজন দারুণ সুদর্শন পুরুষে। তারপর বুঝতেই পারছেন, নববিবাহিত দম্পতির প্রণয় শুরু হয়। তবে ঘোড়া-বরটি তার বউকে নিষেধ করে দেয় কারও কাছে এই সত্য ফাঁস করতে যে সে রাতের বেলা মানুষে রূপান্তরিত হয়। 'কেন, বললে কী হবে?' হবে এই যে নায়িকাকে তখন বাধ্য করা হবে লোহার জুতো পরতে এবং সমগ্র রাজ্যজুড়ে বরের খোঁজ করে বেড়াতে। অর্থাৎ যদিও এখানে বরটি অর্ধেক ঘোড়া অর্ধেক মানুষ, তবু এই সম্পর্কের নাটাই তারই হাতে।
তো, বিয়ের মাত্র দুদিনের মধ্যেই নায়িকা গোপন কথাটি মুখ ফসকে বলে ফেলে তার বোনদের কাছে। তাই পূর্বনির্ধারিত শর্ত অনুসারে, তার বর তাকে বাধ্য করে লোহার জুতো পরতে। এরপর বরটি উড়াল দেয় তার রাক্ষুসী মায়ের কাছে। পরের দশটি বছর ধরে নায়িকাকে পায়ে লোহার জুতো পরে বরের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে মরতে হয় রাজ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। অবশেষে সে হদিস পায় তার বরের। কিন্তু তাতেই শেষ হয় না নায়িকার অগ্নিপরীক্ষা। ঘোড়া-বরটি এবার জানায়, তার বউকে অবশ্যই চোখের জল দিয়ে পূর্ণ করতে হবে একটি পাত্র। নইলে রাক্ষুসী মা খেয়ে ফেলবে তাকে।
কী ভয়ঙ্কর কাহিনি, তাই না? অথচ আজকের দিনেও পৃথিবীর নানা দেশে, বিশেষত আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে, কতই না প্রাসঙ্গিক। বর যেমনই হোক, তবু বউয়ের চেয়ে সব সময়ই তার অবস্থান ওপরে। ফলে বরের কথার অবাধ্য হলেই বউয়ের ওপর নেমে আসবে নরকযন্ত্রণা। আর শাশুড়ি? কোথাও কোথাও সে সাক্ষাৎ ডাইনি, যে 'খেয়ে ফেলবে' পুত্রবধূকে!
তবে সব রূপকথার গল্পে আবার বিয়ের ব্যাপারটিও জরুরি না। নায়িকাকে জুতো পরে শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে তাদের অন্যান্য গৎবাঁধা নারীসুলভ 'পাপের' ফল হিসেবেও।
হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের দ্য রেড শুজ কাহিনিতে ক্যারেন নামের এক অনাথ যুবতী একজোড়া চমৎকার লাল জুতো পায় এক বৃদ্ধ নারীর কাছ থেকে, যে ক্যারেনের মায়ের মৃত্যুর পর তাকে আশ্রয় দিয়েছিল।
সারা জীবন অভাব-অনটনকে সঙ্গী করে বাস করা ক্যারেনের জন্য ওই লাল জুতো ছিল এক অসামান্য সম্পদ। তাই সে আনন্দে বিমোহিত হয়ে পড়ে। শয়নে-স্বপনে কেবলই ওই জুতোর কথাই ভাবতে থাকে সে।
অবস্থা এতটাই চরম আকার ধারণ করে যে এক রবিবার সকালে চার্চে গিয়েও সে হারিয়ে যায় লাল জুতোর চিন্তায়। তখন জুতোরা লাভ করে তাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি এবং হঠাৎ করেই ক্যারেন উন্মাদের মতো নাচতে আরম্ভ করে। তার সেই উন্মত্ত নৃত্য এতটাই চরম পর্যায়ে চলে যায় যে সে হাজির হয় শহরের জল্লাদের কাছে। তাকে অনুরোধ করে লাল জুতোসহ তার দুই পা যেন কেটে নেওয়া হয়। পাশাপাশি সে জুতো নিয়ে নিজের অহমিকার মতো পাপের কথাও স্বীকার করে।
কিন্তু ক্যারেনের শাস্তি এত সহজে শেষ হওয়ার নয়। দুই পা কেটে নেওয়ার পরও তার কর্তিত পা ও জুতোরা গির্জার বাইরে নেচে চলা অব্যাহত রাখে এবং ক্যারেনকে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করে যেন সে তার পাপের আরও প্রায়শ্চিত্ত করে। একজন দেবদূতের সহায়তায় সে চার্চ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং সেখানে গিয়ে কৃতজ্ঞতায় তার হৃদয় এতটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে যে সে মৃত্যুবরণ করে।
বস্তুত নারীদের জুতো আসলে তাদের সামাজিক অবস্থানের চিহ্ন হিসেবে কাজ করত। দ্য রেড শুজ-এ তার খানিকটা ছাপ আমরা দেখতে পেয়েছি। ক্যারেনের দুই পা কেটে ফেলার পর জল্লাদ সেখানে পরিয়ে দেয় কাঠের পা ও জুতো। এভাবে ক্যারেন ফিরে যায় তার চিরন্তন গরিবি হালতে। ওদিকে সিন্ডারেলার জীবনেও জুতো সূক্ষ্মভাবে এমন কিছুরই নির্দেশ করে। কাঠের জুতো পরে সিন্ডারেলাকে গৃহস্থালির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ করতে হতো। কিন্তু সেখান থেকে জাদুকরি জুতোপ্রাপ্তি তার জীবনযাত্রার মানে আকাশপাতাল ব্যবধান গড়ে দেয়।
একই ধরনের দর্শন বিদ্যমান পাস ইন বুটস-এর কাহিনিতেও। স্ত্রাপারোলা ও বাসিলের বর্ণনায় বিড়ালটি থাকে নারী এবং তার বুটসহ যাবতীয় পোশাক-পরিচ্ছদই হলো তার সামাজিক অবস্থানের চিহ্ন। বিড়ালটি তার বুদ্ধি ও বুটের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সৌভাগ্য অর্জন করে এবং আশা করতে থাকে যে এবার একজন 'পুরুষ' এসে তার দেখভাল করবে। অর্থাৎ বিড়ালটি যত বুদ্ধিদীপ্তই হোক না কেন, দিনশেষে তার অবস্থান থাকবে ঠিকই নিজের বুটের সমপর্যায়ে, অর্থাৎ পুরুষের অধীনে।
বোঝাই যায়, জুতোকে যতটা ক্ষমতায়নের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, প্রকৃতপক্ষে সে তা নয়। রূপকথার গল্পে সে নারীর স্বাধীনতার নয়, নিছকই শৃঙ্খলতার প্রতীক।
আর কে না জানে, রূপকথার গল্পও যতটা না কল্পনা, তারচেয়ে বেশি বাস্তবতারই প্রতিফলন!