টিকাবিরোধীদের দঙ্গলে :একটি ছোটো প্রতিবেদন
অসুস্থতা মানবজীবনের এক মৌলিক নাট্যপ্রবাহ। ভয়, ব্যথা, অনিশ্চয়তা। আমাদের নশ্বর অস্তিত্বের এক সবিনয় সতর্কীকরণ। যখন 'অসুখের ভার' এই দুই শব্দ নিয়ে ভাবি, চিন্তা হয়, ব্যথার ঘনত্ব নিয়ে, আমরা কতোই না ক্লান্ত হয়ে পড়ি ভারবহন করতে! সমূহ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকা কতোই না দ্বিধা আর সংশয়ের, কতো দুর্বল, অন্যের যত্ন বিষয়ে কতোই না নির্মম আমাদের যাপন! সুস্থ সজীব মানুষের কাছে অসুস্থ হয়ে পড়া পরম আত্মীয়টিও এক দুর্বহ ভার। ভারী, কঠিন আর অসহ্য ৷
অসুখের শারীরিক চেহারাটা অশান্ত করে তোলে তাকে কেন্দ্র করে ঘিরে থাকা মানুষের মন৷ আধুনিক প্রযুক্তিতে চিকিৎসা ব্যবস্থার অগ্রগতি আমাদের এই উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যেই পরিচালিত হওয়ার কথা। আমরা জানি, একদিন নিজের বা পরিবারের কারোর অসুস্থতাজনিত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হবে কিন্তু আমরা প্রায়শই অপ্রস্তুত থাকি৷
ভ্যাকসিনেশনের গল্পটা মূলত তৈরি হয় স্বাস্থ্যসেবা দাতাদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, আইনের সাথে আমাদের সহযোগিতা কিংবা অসহযোগিতামূলক সম্পর্ক, স্বাস্থ্য আর অসুস্থতা নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। আমাদের পরিবারগুলো কিংবা স্বাস্থ্য সেবাদাতারা কেমন করে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসার ব্যাপার নথিভুক্ত করে রাখেন তার উপরও নির্ভর করে কোনো সুনির্দিষ্ট অসুখ থেকে মুক্তির জন্যে পরিচালিত ভ্যাকসিনের ইতিহাস ও ভুগোল।
মার্চ ১৮৮৫, শিকাগো থেকে একটা ট্রেন মন্ট্রিলের বোনাভেঞ্চার স্টেশনে এক বিপজ্জনক যাত্রীকে নিয়ে আসে: স্মলপক্স৷ এটি একটি অঞ্চলের ইতিহাসকে অল্প সময়ের মধ্যে বদলে দেবে৷ জর্জ লংলে, ট্রেন কনডাক্টার, জ্বর আর প্রচন্ড গা গরম অবস্থায় হোটেল ডিউতে আশ্রয় নিয়ে সেবাগ্রহণ করেন৷ তিনি সেরে ওঠেন কিন্তু হোটেলের লন্ড্রির এক নারী কর্মী, পেলাজিয়ে রবিচাউড লংলে সাহেবের সংক্রামিত লিনেনের কাপড় থেকে রোগ আহরণ করেন৷ এপ্রিলের দুই তারিখ পেলাজিয়ে মারা যান৷
তারপরই পেলাজিয়ের বোন সহোদরার পথ অনুসরণ করেন৷ শেষ গ্রীষ্মে স্মল পক্স মন্ট্রিলের সর্বত্র ছড়ায়৷ নভেম্বরে, মহামারির সর্বশেষ বিস্ফারকালে, মন্ট্রিলের মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশ মানুষ মারা যান৷ অসংখ্য মানুষের শরীরে ক্ষত তৈরি হয়, অনেকে অন্ধত্ব বরণ করেন৷ বেশিরভাগ ছিলো শিশু৷ স্মলপক্সের ভ্যাকসিন ততোদিনে একশো বছরের পুরনো।
এডওয়ার্ড জেনের ১৭৯৬ সালেই তো আবিষ্কার করেছেন স্মল পক্সের প্রতিষেধক। তাহলে প্রতিরোধের অস্ত্র থাকবার পরেও এতো মারণক্ষমতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো কেন স্মলপক্স? ভ্যাকসিনবিরোধী যারা গুজব ছড়ায় ডানপন্থী, বিজ্ঞানচিন্তাহীন, যুক্তিহীন, কুযুক্তির ধ্বজাধারীরাই তার কারণ৷ 'দ্য অ্যান্টি ভ্যাক্সিনেটর' - পত্রিকার সম্পাদক ডক্টর আলেকজান্ডার এম রস বলে বসেন,' ভ্যাকসিন নেওয়াটা অকার্যকর আর বিপদজনক', এমনকি তিনি প্যাম্পলেট বিলি করেন ভ্যাকসিন না নেওয়ার ব্যাপারে জনগণকে 'সচেতন' করতে। মজার বিষয়, রস নিজেই সে বছর ভ্যাকসিন নেন৷ এই ধরণের লোকেরা সুযোগসন্ধানী, অল্পেই বিখ্যাত (আজকালকার ভাষায় ভাইরাল ভাই) হতে এসব করে।
স্টিফেন কারাঞ্জা এমন আরেক বিজ্ঞানবিরোধী মানুষ৷ কেনিয়ার ক্যাথলিক ডক্টর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলেন কট্টর ভ্যাকসিনবিরোধী। গরম ভাপ নেওয়া আর হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেটের প্রচারক ছিলেন যুক্তিসঙ্গত ভ্যাকসিনের বদলে। এহেন মানুষটি নিজের কর্মগুণেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান৷ ভ্যাকসিন অকার্যকর - তার এই প্রচারকে কেনিয়ার বিশপ সমিতির কনফারেন্সে পাত্তা দেয়া হয়নি বরং তারা ভ্যাক্সিন নেয়ার পক্ষে কথা বলেছেন৷ ভাগ্যিস বলেছেন, নইলে আমরা হয়তো আরেকটি মন্ট্রিল দেখতাম৷
মাইকেল ইডন ফাইজার ইনকর্পোরেটেডের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। যিনি নিজেও সফল বায়োটেক প্রতিষ্ঠানের সহযোগী নির্মাতা। অকস্মাৎ হয়ে পড়লেন ভ্যাকসিনবিরোধীতার অন্যতম প্রধান মুখ। গত বছরের শেষের দিকে তিনি অনেকের সাথে মিলে ইউরোপের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় একটা যৌথ পিটিশন দেন, কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল থামাতে। তাঁরা কোনো প্রমাণ দেখানো ছাড়াই দাবি করেন, নারীরা উর্বরাশক্তি হারাবে এই ভ্যাকসিন নিলে।
ডকুমেন্টটি জার্মান ওয়েবসাইটে পয়লা ডিসেম্বরে দেখা যাওয়ার পর অন্যান্য বিজ্ঞানীরা, ঔষধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেউই পাত্তা দেননি। সপ্তাহখানেক পর, ইউরোপিয়ান ঔষধ এজেন্সি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রথম কোভিড নাইন্টিন ভ্যাক্সিন শটের অনুমতি দিয়ে দিলো যার সহযোগী ছিলো ফাইজার কিন্তু ততক্ষণে প্রায় কেয়ামত নেমে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর অনুর্বরতার মিথ্যে তথ্য ভাইরাল হয়ে গেলো। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই, ব্রিটেনের ডাক্তার ও নার্সেরা নারীদের এই বিষয়ক প্রশ্নে অস্থির হয়ে গেলেন। ফাইজার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন, একটি অলাভজনক সংস্থা জানাচ্ছে, আমেরিকার শতকরা ১৩ ভাগ টিকার আওতায় না আসা মানুষের মাথায় এই নারীর অনুর্বরতার প্রশ্নটি এসেছে।
ষাট বছরের মাইকেল ইডন কিন্তু যেমন তেমন গবেষক নন। ফাইজারের এই সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ১৬ বছর গবেষণা করেছেন এলার্জি আর শ্বাসযন্ত্র নিয়ে। পরে ফাইজারের তিন সহকর্মীর সাথে জিয়ার্কো নামে যে বায়োটেক ফার্ম তৈরি করেন তা সুইস ঔষধ কোম্পানি নোভার্টিস ৩২৫ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের অল্প কয়েকজন গ্রহীতার মধ্যে রক্তজমাট বাধা ও অস্বাভাবিক রক্তপাত ভ্যাকসিনবিরোধীদের পালে হাওয়া লাগিয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আর আক্রান্ত রোগীর অবস্থার মধ্যে কার্যকর কোনো কারণ আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন।
রসায়নে নোবেল বিজয়ী মাইকেল লেভিট বারবার আশা করছেন মহামারি দীর্ঘায়িত হবে না। লুক মন্টেগনিয়ের আরেকজন নোবেল লরিয়েট, মনেই করেন ভাইরাসটি চৈনিক ল্যাবে নির্মিত। ইডন যে ভ্যাকসিন গ্রহণের ফলে নারীর অনুর্বরতাসহ নানা অবৈজ্ঞানিক গুজব তৈরি করছেন তার এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হওয়ার পেছনে আছে বিজ্ঞানী হিসেবে দীর্ঘদিনের অবস্থান।
স্টেরগিওস আ. মসকোস, ইডনের সাবেক সহকর্মী, মলিকিউলার বায়োলজি আর ফার্মাসিউটিকসে ডিগ্রি আছে। ডিসেম্বরে ইডন টুইটারে একটা হাস্যকর পোস্ট করেন যাতে বলা হয় 'মাস্ক ছুড়ে ফেলো (Ditch the mask)।' মসকোস ফিরতি টুইটে জানান, 'মাইক, কোন নরকে গেলে তুমি? তুমি কি মনোযোগ দিয়ে মানুষ মারতে বেরিয়ে পড়েছো? একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী কেন ভ্যাকসিনবিরোধী হলেন তা রহস্যময়। তিনি এমনকি গণহারে পরীক্ষা ও শনাক্তেরও বিরোধী।
এডওয়ার্ড জেনের যখন ১৭৯৬ সালে স্মলপক্স ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন তারপর থেকেই ভ্যাকসিন বিরোধীতা শুরু হয়েছে আমেরিকায়। ডক্টর পল অফিট জানাচ্ছেন, 'কাউপক্স থেকে বানানো ভ্যাকসিন দিলে আপনি গরুর বৈশিষ্ট্য ধারণ করবেন আপনার ল্যাজ, লটপট করা কান, বিশাল ফুটোবিশিষ্ট নাক গজাবে, ১৮০২ সালের দিকে এসবই ছিলো বিশ্বাস। পল অফিট ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেনস হাসপাতালের ভ্যাক্সিন শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের লোকজন বলছেন, ভ্যাক্সিন নিলে মানুষের উর্বরতা শক্তি কমা থেকে জিন পর্যন্ত বদলে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষের অন্য কারণে মৃত্যুকে কার্যকারণ তত্ত্বে ফেলেও কেউ কেউ ভ্যাকসিন নেওয়ার বিরোধীতা করছেন। অফিট বলছেন, 'ডি এন এ বদলে যাবার সম্ভাবনা আপনার স্পাইডারম্যান হবার সম্ভাবনার মতই অলীক জিনিস।'
আমাদের দেশেও ভ্যাকসিনবিরোধীদের উৎপাত দেখা গিয়েছে। তবে প্রথমেই তারা করোনা অতিমারিকেই উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন নিজেদের মহাত্মা করোনা জীবাণুর চেয়েও শক্তিশালী দাবি করে। শীর্ষ একজন নেতা কখনোই এ দেশে করোনা ছড়াবে না বলে, অত্যন্ত বেদনার যে, সেই করোনাতেই চলে গেলেন অনেকটা কেনিয়ার সেই ডাক্তারের মতো। পাশের দেশে থালা বাজিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনিতে করোনা বিতাড়নের কথা ভেবেছিলেন সেখানকার শীর্ষ নেতৃত্ব। গোমূত্র আর গোবরে অনুসন্ধান করেছেন আরোগ্যের উপায়। সুন্দরী ও মেধাবী এক বলিউড অভিনেত্রীও নানা অবৈজ্ঞানিক আলাপ টুইট করেছেন। আমাদের দেশে এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত বিশদভাবে করোনা জীবাণুদের সাথে আলাপচারিতার বিবরণ দিয়েছেন ভরা জলসায়, দিয়েছেন উদ্ভট 'বৈজ্ঞানিক' ফর্মূলা।
মাঝে এক হোমিও ডাক্তার ভাইরাল হয়েছিলেন, তার দাবি ছিলো মরণাপন্ন রোগী তিনটি ফোঁটা খেলেই আরোগ্য লাভ করবেন। সীমান্তের অন্য পারে করোনাসদৃশ দেবতার মূর্তি বানিয়ে বিপুল উৎসাহে আরাধনা করেছেন, ভোগের প্রসাদ বিতরিত হয়েছে। করোনার অতিমারি শুরুর কিছুদিন পর কেউ কেউ বাইরে স্যানিটাইজেশনের পাশাপাশি অন্দর তথা ভেতরের স্যানিটাইজেশনের প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেছেন।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট শুরুতে গুজব ছড়াতে নিষেধ করেন। অতিমারির অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। ফলে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থার ফল ভোগ করেছে সাধারণ মানুষ। এখন তিনিই ফাইজারের একশ মিলিয়ন, জনসন অ্যান্ড জনসনের ৩৮ মিলিয়ন আর মর্ডানার ১৩ মিলিয়ন ডোজ সংগ্রহের ব্যাপারে তৎপর। অথচ তিনি বলেছিলেন, মানুষের মুখ কুমিরের মতো হয়ে যাবে ভ্যাকসিন নিলে। তার এ মত বদলের পেছনে আছেন ব্রাজিলের ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবসায়ীরাই বলসোনারোকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন। এখন তারা অতিমারির বিপুল ক্ষতিতে পড়ে জনগণের মধ্যে ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচির সফল প্রয়োগ দেখার জন্যে প্রেসিডেন্টকে চাপ দিচ্ছেন। অন্যান্য দেশের টিকাদান কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার সূচক অনেকটাই নিম্নমুখী করেছে। নিজের ইমেজ ফেরাতে এখন তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে দেশ অতিমারি পরিস্থিতিতে যত বেশি অস্বীকার করেছে, জনস্বাস্থ্য নিয়ে যত অবহেলা (মতান্তরে দুর্নীতি) করেছে সে দেশের মানুষকে সবচেয় বেশি ভুগতে হয়েছে। সাম্প্রতিক অতিমারি ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে দেখতে পাচ্ছি যে দেশ সত্যতর অর্থে জনগণবান্ধব, দুর্যোগমুক্তির বিজ্ঞানভিত্তিক পথ খুঁজে নিয়েছেন সেই দেশ তার জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে ততটাই সফল। টিকা নিলেই টিকে থাকবার একটা সম্ভাবনা/পরিস্থিতি আছে/ থাকে, আরো একশ শতাংশ কার্যকর, টেকসই টিকাও একদিন আমাদের ট্যাক সই করে পড়বে বিজ্ঞানের নিয়মেই, ততোদিন বিজ্ঞানকে অস্বীকার ব্যক্তি পর্যায়ে, সামাজিক পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে না করলেই মঙ্গল।