ভারতবর্ষের প্রথম পত্রিকা হিকি সাহেবের ‘বেঙ্গল গেজেট’
২৯ জানুয়ারি ১৭৮০। অগাস্টাস হিকির প্রিন্টিং অফিস।
'দল-মতনির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত, কিন্তু কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়।' এই স্লোগান নিয়ে আজই যাত্রা শুরু করেছে ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র, হিকি'স বেঙ্গল গেজেট; অর ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার। কলকাতার জন্মের পরে পেরিয়ে গেছে ৯০টি বছর। এত দিনেও কেউ একটি পত্রিকা বের করতে পারেনি।
এখন সময় হয়েছে। অগাস্টাস হিকি সাহস করে কাজ করে ফেলেছেন। প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক হিকি'স বেঙ্গল গেজেট-এর প্রথম সংখ্যা। সাড়া পড়ে গেছে পুরো কলকাতাজুড়ে। কেউ শখের বশে পড়ছেন, কেউ পড়ছেন স্রেফ কৌতূহলে। কেউ আবার পত্রিকা কিনছেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। নিজের প্রভাব ধরে রাখার একটা বিষয়ও আছে। পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, আড্ডায় এ নিয়ে কথা ওঠে। আবার কেউ চিঠি পাঠালে এখন আর কষ্ট করে কোনো রাজনৈতিক ঘটনা বিস্তারিত লেখে না। পত্রিকার নাম বলে দেয়, ওতে ছাপা হয়েছে। সেই পত্রিকা না পড়লে চলবে?
আইরিশ বংশোদ্ভূত জেমস অগাস্টাস হিকি পত্রিকার সম্পাদক। স্লোগানটি তিনি শুধু কথার কথা হিসেবে লেখেননি। মন থেকে এটাই তিনি বিশ্বাস করেন।
তখনো কেউ জানত না, দুই বছর পরে বন্ধ হয়ে যাবে হিকি'স বেঙ্গল গেজেট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রোষানলে পড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ভারত ছাড়তে বাধ্য হবেন হিকি। কিন্তু তার পদচিহ্ন রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। এ চিহ্ন মোছার সাধ্য কারও নেই।
দুই
১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রথম প্রকাশিত হয় হিকি'স বেঙ্গল গেজেট। খবরের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেয় সামাজিক সমস্যাগুলোকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রাস্তাঘাট, বিভিন্ন স্থাপনা, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং ময়লা-নর্দমার সঠিক ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি। তাঁর পত্রিকায় আলাদা পাতা ছিল রাজনীতি, বিশ্ব সংবাদ এবং ভারতের খবর নিয়ে। সাধারণ পাঠককে চিঠি থেকে কবিতা, সব ধরনের লেখা পাঠাতেই উৎসাহ দেন হিকি।
মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এত দিন প্রত্যেককে নিজের মতো করে সামাজিক সমস্যাগুলোর কথা বলতে হতো। এখন তাদের একটা মুখপাত্র হয়েছে। তারা নিজে থেকে তো বলেই, পাশাপাশি চিঠি লিখলেও প্রকাশ করে। আরেকটা সুবিধা হয়েছে, দূরের কাউকে চিঠি পাঠালে ওতে স্থানীয় রাজনৈতিক কোনো ঘটনা বিস্তারিত লিখে জানাতে হয় না। পত্রিকার কথা বললেই হলো। কিংবা এর কপি সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই হয়ে যায়।
হিকিও ঠিক ঠিক জানতেন, কীভাবে পত্রিকা চালাতে হয়। তাঁর পত্রিকার অন্যতম বড় হাতিয়ার ছিল বিদ্রুপ বা স্যাটায়ার ও লেখার রম্যভঙ্গি। শহরের রঙিন চরিত্রদের ডাকনামও দিতে শুরু করে তাঁর পত্রিকা। যেমন কলকাতা শহরের জনকল্যাণ বিভাগের প্রধান এডওয়ার্ড টিরেটার ডাকনাম দেন 'নোসি জার্গন'। নোসি মানে, যে অন্যের ব্যাপারে অযথা নাক গলায়। আর জার্গন মানে, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের পরিভাষা। প্রথমাংশটা আক্ষরিক অর্থে বললেও দ্বিতীয়াংশ দেওয়া হয়েছে বিদ্রুপ করে। কারণ, ইতালি থেকে আসা টেরেটা সাহেব ইংরেজি, ফ্রে , পর্তুগিজ ও হিন্দি ভাষা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি উদ্ভট এক ভাষায় কথা বলতেন। শুনে মনে হতো, বিভিন্ন কঠিন পরিভাষা বলে যাচ্ছেন টানা। এ রকম ডাকনাম ও বিদ্রুপ বেঙ্গল গেজেটকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে।
প্রমাণ ছাড়া কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা বিতর্কিত জিনিস ছাপাতেন না তিনি পত্রিকায়। খুব ভালোভাবে খেয়াল রাখতেন এদিকে। কারণ, রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলে তাঁর পত্রিকা। ওতে একবিন্দু এদিক-ওদিক হলেও বিশাল ঝামেলা। পত্রিকা এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে সে জন্য পত্রিকার দ্বার বন্ধ করে দেননি তিনি। বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন ধরনের মানুষের লেখা ও চিঠি প্রকাশ করেছেন। এমনকি তাঁর নিজের মতের বিরুদ্ধে যায়, এ রকম নারীদের চিঠিও প্রকাশ করেছেন তিনি। 'নারী' শব্দে জোর দেওয়ার কারণ, সে সময়ের কলকাতার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, এ বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এমনই এক নারীর কথা জানা যায় ইতিহাস থেকে, যিনি 'ওল্ড নেল' নামে পরিচিত। হিকির পত্রিকার পুরুষ লেখকেরা (হিকি নিজেও) পুরুষতন্ত্র-ঘেঁষা ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। নারীদের চলাচল থেকে সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁরা লিখতেন। কিন্তু ওল্ড নেল তার বিরুদ্ধে যখন লেখেন, সে লেখাও প্রকাশ করেন হিকি। মেয়েদের যৌন অধিকার থেকে শুরু করে ধর্ম বা বর্ণের কারণে সৃষ্ট দলাদলির সমস্যা নিয়েও লেখা প্রকাশিত হয়েছে হিকি'স বেঙ্গল গেজেটে। কিন্তু অযথা বিতর্ক উসকে দেয়, এ রকম কিছু ছাপানো হতো না। যেমন ধর্মীয় দলাদলি উসকে দেবে, এমন চিঠি পেয়ে হিকি ছাপাতে রাজি হননি বলে জানা যায় ইতিহাস থেকে।
এভাবেই প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হচ্ছে 'হিকি'স বেঙ্গল গেজেট'। বিক্রি হচ্ছে ১ রুপিতে। যতই জনপ্রিয় হোক, টাকা দিয়ে পত্রিকা কেনার সামর্থ্য তখনো খুব বেশি মানুষের ছিল না। কাজেই, হিকি'স বেঙ্গল গেজেট-এর ৪০০-৫০০ কপির মতো বিক্রি হতো সে সময়। কিংবা আরেকটু বেশি।
সব ঠিকই চলছিল। কিন্তু যুগে যুগে বারবার বাক্স্বাধীনতার গলা টিপে ধরতে চেয়েছে ক্ষমতালিপ্সু, অন্যায়কারী সরকার ও প্রভাবশালীরা। হিকি'স বেঙ্গল গেজেট-এর গলাও টিপে ধরা হলো। শুরু হলো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
তিন
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমালোচনা করে একের পর এক কলাম ও সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে হিকি'স বেঙ্গল গেজেট-এ। সমাধানের উপায় কী? উপায়, আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করা। ভারতবর্ষের দ্বিতীয় ছাপা পত্রিকা হিসেবে যাত্রা শুরু করল দ্য ইন্ডিয়া গেজেট; অর ক্যালকাটা পাবলিক অ্যাডভার্টাইজার।
দ্য ইন্ডিয়া গেজেট প্রকাশ শুরু হওয়ার আগেই জানতে পারেন হিকি। এ সময় কিছু একটা সমস্যা হয় তাঁর ভারতের গভর্নর জেনারেল বা প্রশাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী মেরিয়েন হেস্টিংসের সঙ্গে। সিমেয়ন ড্রোজ নামে কোম্পানির এক কর্মচারী ও মেরিয়েন কোনো কারণে হিকির কাছে ঘুষ চেয়েছিলেন। হিকি অভিযোগ করে পত্রিকায় লেখেন, এই ঘুষ না দেওয়ায় কোম্পানি 'দ্য ইন্ডিয়া গেজেট'কে সমর্থন ও সর্বাত্মক সাহায্য করছেন। এর মাধ্যমে বদলে গেল হিকির অরাজনৈতিক দৃষ্টি। এত দিন তিনি ও তাঁর পত্রিকা শুধু গণমানুষের মুখপাত্র হিসেবে কোম্পানির নানা কাজের সমালোচনা করেছে। এবারে বিষয়টি পরিণত হলো ব্যক্তিগত শত্রুতায়।
১৭৮০ সালের ১৮ নভেম্বর প্রকাশিত হয় দ্য ইন্ডিয়া গেজেট-এর প্রথম সংখ্যা। সেদিনই হিকি তাঁর পত্রিকার নাম বদলে রাখেন হিকি'স বেঙ্গল গেজেট; অর দ্য অরিজিনাল ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার।
এদিকে স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশের শাস্তি হিসেবে হেস্টিংসের সুপ্রিম কাউন্সিল, মানে কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তারা হিকির নিবন্ধিত পাঠকদের কাছে পত্রিকা ডাকে পাঠানো নিষিদ্ধ করেন। এবারে হিকি ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লেখেন, হেস্টিংস তাঁর বাক্স্বাধীনতা খর্ব করছেন। পাশাপাশি, দুর্নীতি, শোষণের অভিযোগ থেকে শুরু করে হেস্টিংসকে ব্যক্তিগত পর্যায়েও আক্রমণ করেন তিনি। বিলেতি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি পদাধীকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনেন হিকি। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে কর্মরত প্রধান বিচারপতি এলিজাহ ইম্পের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ করেন তিনি। এই অভিযোগ কতটা সত্য, তা এ লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। তবে বাংলায় কোম্পানির দুঃশাসনের কথা সবাই জানেন নিশ্চয়ই।
হেস্টিংস ও কোম্পানির অন্যান্য বড় কর্মকর্তা এ সময় মামলা করে দেন হিকির বিরুদ্ধে। চার দফা শুনানির পর ১৭৮১ সালের জুনে হিকিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। জেল হয় তাঁর।
হিকি কিন্তু দমলেন না। জেলে বসেই প্রকাশ করতে লাগলেন পত্রিকা। লেখার ভাষাতেও এল না কোনো পরিবর্তন। একের পর এক অভিযোগ প্রকাশিত হতে লাগল হেস্টিংস ও কোম্পানির অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। আবার হিকির বিরুদ্ধে মামলা করলেন হেস্টিংস। এবারে হিকির পত্রিকা প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল আদালত।
১৭৮২ সালের ৩০ মার্চ বন্ধ হয়ে গেল হিকি'স বেঙ্গল গেজেট। পত্রিকা প্রকাশের সব যন্ত্রপাতি, টাইপিং যন্ত্র ইত্যাদি জব্দ করল সরকার। পরের সপ্তাহে নিলাম ডাকা হলো সেগুলো বিক্রির জন্য। নিলামে এসব যন্ত্র কিনে নেয় 'দ্য ইন্ডিয়া গেজেট'। এর মাধ্যমে বিলুপ্তি ঘটে ভারতবর্ষের প্রথম পত্রিকার।
চার
হিকি'স বেঙ্গল গেজেট শুধু ভারতবর্ষেই নয়, আলোড়ন তুলেছিল ইউরোপ-আমেরিকাতেও। নানা রকম সামাজিক সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি হিকি অবস্থান নিয়েছিলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে শুধু ভারত বা তৎকালীন বাংলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল না। যুদ্ধে মারা যাচ্ছিল অসংখ্য ইংরেজ যোদ্ধাও। ১৭৮০ সালে পলিলুরের যুদ্ধে মহীশুরের রাজা, টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলী ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে ফাঁদ পাতেন ইংরেজ বাহিনীর জন্য। তিন হাজার থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সেনার ইংরেজ বাহিনী পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এ যুদ্ধে।
এমনিতে হিকি ভাবতেন, ব্রিটিশদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না। স্বাভাবিক। ইংরেজরা তখন বিশ্বের নানা প্রান্তে কলোনি বিস্তার করছে। সেই বাহিনী যখন এভাবে পরাস্ত হলো, হিকি বুঝলেন, ইংরেজরা অজেয় নয়। পাশাপাশি, ইংরেজরা ভালো, বাংলার বিদ্রোহীরা খারাপ—এ রকম একটি ধারণা ছিল তাঁর। সেই ধারণাও ভেঙে যায়। তবে রিপোর্ট লেখার সময় দুই পক্ষের কারও পক্ষে লেখেননি হিকি। লিখেছেন খাঁটি সাংবাদিকের মতো, যুদ্ধের বিপক্ষে।
তাঁর রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে রিপোর্ট করে ইউরোপের লন্ডন কোর্যান্ট, লন্ডন ক্রোনিকল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি গেজেট-এর মতো পত্রিকা। ফ্রান্স, জার্মানিসহ নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে হিকি'স বেঙ্গল গেজেট-এর খ্যাতি। অল্প কিছুদিনের ভেতরেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর পত্রিকাটি।
কিন্তু কোম্পানির কালো হাত থামিয়ে দেয় ভারতবর্ষের প্রথম এই পত্রিকাটির যাত্রা। হিকি'স বেঙ্গল গেজেট হারিয়ে যায় ইতিহাসের কোলে।
পাঁচ
কোম্পানির অন্যায়ে কথা যখন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে পৌঁছে, তিনি ডেকে নেন কোম্পানির বড় কর্মকর্তাদের। তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করে সামান্য শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। গুরু কোনো দণ্ড দেওয়া হয়নি।
১৭৮৪ সালে হেস্টিংস যখন বিলেতে ফিরে যান, তখন জেল থেকে মুক্তি পান হিকি। তাঁর এর পরের জীবন নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। শুধু জানা যায়, জেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন হিকি। সম্পদ হারিয়ে তাঁর পরের জীবন কাটে প্রচণ্ড দারিদ্র্যে।
১৮০২ সালের অক্টোবরে নৌপথে চীনে যাওয়ার সময় মারা যান জেমস অগাস্টাস হিকি। তত দিনে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম লেখা হয়ে গেছে স্থায়ীভাবে, ভারতবর্ষের প্রথম পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে।