হেস্টিংস বনাম হিকি: ভারতের প্রথম খবরের কাগজের মালিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা
অ্যান্ড্রু অটিস তার সাম্প্রতিক গ্রন্থে ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে বেরোনো ভারতের প্রথম প্রধান খবরের কাগজ 'হিকি'স বেঙ্গল গেজেট' পত্রিকার যাত্রাপথ তুলে ধরেছেন। জেমস অগাস্টাস নামে জনৈক দরিদ্র আইরিশ ভদ্রলোকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া পত্রিকাটি প্রতি শনিবার ১ রুপিতে বিকোত। গোড়ার দিকের ব্রিটিশ সরকারের গুমোর ফাঁস করে অল্প দিনেই এটি 'স্পর্শকাতর' হয়ে দাঁড়ায়, লিখেছেন অটিস।
'হিকি'স বেঙ্গল গেজেট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব ইন্ডিয়া'স ফার্স্ট নিউজপেপার' গ্রন্থে অটিস হিকির পটভূমি এবং প্রেরণার কথা তুলে ধরে পত্রিকাটির বিভিন্ন দিক বর্ণনা করেছেন: এটিতে কী কী থাকত, কীভাবে এটি ব্রিটিশ কলকাতার ধনী ও প্রভাবশালীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। তিনি লিখেছেন, পত্রিকাটি 'পৃষ্ঠপোষকতা এবং সম্মান রহিত সমাজের নিচু কাতারের মানুষগুলোর জীবন তুলে ধরে তাদের কণ্ঠস্বর হতে চেয়েছিল। পত্রিকার প্রভাব বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ক্রমে এটি রাজনৈতিক চেহারা নেয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতি ফাঁস করার পাশাপাশি তখনকার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের 'ব্যক্তিগত বিজয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে' সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধ চালানোর সমালোচনা চালিয়ে যায়।
অচিরেই হেস্টিংস পত্রিকার প্রচার বন্ধ করার পদক্ষেপ নেন। পোস্ট অফিস মারফত হিকির পত্রিকা বিলি নিষিদ্ধ করেন তিনি। পোস্টমাস্টার জেনারেলকে পত্রিকা বহন করছে সন্দেহে যেকোনো চিঠি তল্লাশি করার ক্ষমতা দেন। কিন্তু লিখেছেন অটিস, হিকি 'কোনো নিপীড়নের মুখেই নতিস্বীকার, ভয় বা দ্বিধা' করেননি। তিনি উল্টো পত্রিকাকে প্ল্যাটফর্ম এবং ভাষাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে 'স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতিবিরোধী এবং স্বাধীনতাপন্থী আন্দোলন' শুরু করেন। ১৭৮১ সালের জুনে হিকিকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। চার-চারটা মামলার মোকাবিলা করতে হয় তাকে। অটিস আদালতের যুদ্ধ, পত্রিকা বন্ধের প্রয়াস এবং পাল্টা লড়তে গিয়ে অটিসের বুদ্ধিদীপ্ত কায়দার কথা তুলে ধরেছেন। নিচে বইটির নির্বাচিত অংশে অটিস হিকির প্রথম বিচারের কথা লিখেছেন। এখানে 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিল।'
২৬ জুন, মঙ্গলবার, সুপ্রিম কোর্ট ভবন, কলকাতা
হিকি'স বেঙ্গল গেজেট এক্সট্রাঅর্ডিনারির দুই পৃষ্ঠার বিশেষ সংস্করণের একটা বান্ডিল হাতে আদালত প্রাঙ্গণের ভাঙাচোরা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে একজন হকার। পুঁতি গন্ধময় বিরাট পুকুর ঘেঁষে বাইরের বাদামি নোংরা আঙিনা পেরিয়ে আদালত ভবনের শীতল, অন্ধকার খিলান-পথে ঢুকতে পেরে স্বস্তি বোধ করছে লোকজন। ছ্যাতলা পড়া রঙের আস্তরণ খসে পড়া খুঁটির নিচে আগের দিন ছাপানো পত্রিকা পড়ছে তারা।
কলকাতা, সোমবার, ২৫ জুন ১৭৮১
আগামীকাল মিস্টার জেমস হিকির অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলাটি কলকাতার আদালত ভবনে উঠতে যাচ্ছে। এর ফলাফলের ওপরই সংবাদপত্রের অমূল্য স্বাধীনতা, সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং বিশ্বের এই অংশে ব্রিটিশ প্রজাদের কথিত স্বাধীনতার ভাগ্য নির্ভর করছে...
বলে রাখা ভালো, মানহানির মামলায় বিবাদীর বিরুদ্ধে আনা লেখা বা ছাপার মাধ্যমে বিদ্বেষপ্রসূত মানহানির অভিযোগে অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়। সুতরাং জুরির কাছে এই বর্ণনা খাপ খাচ্ছে না মনে হলে অভিযুক্তকে অবশ্যই বেকুসর খালাস দিতে হয়।
এক্সট্রাঅর্ডিনারি গেজেট হিকির তরফ থেকে সতর্কবাণী উচ্চরণ করে এ-ও লিখেছে, তার মামলাটি কেবল একটি পত্রিকার প্রশ্ন নয়, বরং খোদ বাক্স্বাধীনতাই বিচারের মুখে দাঁড়িয়েছে। তার পরাস্ত হওয়ার মানে কেবল একটি পত্রিকার পরাজয় নয়, বরং সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরই রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। তাদের শেষ রক্ষাকর্তা হারিয়ে যাবে। 'আমাদের অবস্থা হবে তখন ভেড়ার পালের মতো...আমাদের পোষা কুকুর, আমাদের অভিভাবক না থাকলে আমাদের ঘুমন্ত অবস্থায় বাড়িতে ডাকাত পড়বে,' লিখেছে গেজেট।
হিকি তাকে অভিযুক্তকারী গ্র্যান্ড জুরির একটা ফর্দ দিয়েছেন। এভাবে তাদের পরিচয় প্রকাশ করে দেন তিনি। তিনি পাঠকদের দেখাতে চেয়েছেন যে তার শত্রুদের নিয়ে জুরি বাছাই করে শুরুর আগেই তার বিচারে কারচুপি ঘটানো হয়েছে। গ্র্যান্ড জুরির সদস্যরা হয় কোম্পানির কমিটির সদস্য, কন্ট্রাক্টর, বিদেশি দরবারের বাসিন্দা, কিংবা হেস্টিংসের সাথে সম্পর্কিত কেউ। এমনকি পোস্টমাস্টার জেনারেলও ছিলেন গ্র্যান্ড জুরিতে। তেমনি বাই লর কর সংগ্রহকারী এবং সেনাবাহিনীর কন্ট্রাক্টর চার্লস 'চার্লি বুলক' ক্রফটেসও।
সকাল ৯:০৮, আদালত ভবনের অভ্যন্তর
রুদ্ধশ্বাস নীরবতায় আদালতের কাজ শুরুর মুহূর্তে বিচারকদের সামনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন হিকি। ইম্পের বিচারিক আসনে বসার বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে গোলমাল বাধাতে তৈরি তিনি।
'বিচারের কাজ শুরুর আগেই আপত্তি তুলে ধরতে চাই। আমার প্রতিপক্ষ জানিয়েছেন, কিছু কিছু খবরে আমি লর্ড প্রধান বিচারপতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছি। এই ধরনের অপরাধ সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল নই, মহামান্য লর্ডের ক্ষমতা এবং একান্ত চরিত্র সম্পর্কে আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রয়েছে। তবু ওই সব প্রকাশনা থেকে কিছু বিদ্বেষ তৈরি হয়ে থাকতে পারে, তাই স্যার এলাইজাহ ইম্পের আমার বিচারকাজে অংশগ্রহণে আপত্তি জানাচ্ছি।'
এ কথায় মহাক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ইম্পে। তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি জানেন, সাধারণ মানুষের বিদ্বেষের মুখে কখনোই নতিস্বীকার করবেন না। 'একে গুরুতর আপত্তি বলা যাবে না। বিচার কাজ চলুক,' বললেন ইম্পে।
'মিস্টার হিকি নিশ্চয়ই জানেন, এই আপত্তি তোলার অধিকার তার নেই,' সুর মেলান বিচারপতি হাইড।
ইম্পে এবং হিকির এটাই প্রথম মোকাবিলা ছিল না। ইংল্যান্ডের ওয়েস্টার্ন সার্কিটে হিকি কেরানি এবং ইম্পে ওকালতি করার সময় থেকেই পরস্পরকে চিনতেন তারা। 'সাধারণ মানুষের হট্টগোল কখনোই আমার দায়িত্বে অবহেলার কারণ হতে পারবে না। নিজেকে আমি হুমকিতে প্রভাবিত না হওয়ার মতো মানুষ বলেই মনে করি। আমার আচরণ পক্ষপাতিত্ব না থাকার মতো যথেষ্ট সৎ,' আদালতকে জানালেন ইম্পে।
হিকির আপত্তি বাতিল করা হলো। কিন্তু হিকির আস্তিনে আরও আপত্তি ছিল। আদালত জুরি নির্বাচনের কাজে হাত দিতেই জুরির আসনে কোম্পানির কারও উপস্থিতির বিরুদ্ধে আপত্তি তুললেন তিনি। তারাও গ্র্যান্ড জুরির মতোই পক্ষপাতদুষ্ট হবেন বলেই তার বিশ্বাস।
হিকি এবং হেস্টিংসের আইনজ্ঞ হেনরি ডেভিসকে জুরির সংখ্যা বারো না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো জুরির বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার অনুমতি দিয়ে আপসপ্রস্তাব দিলেন ইম্পে। এভাবে যথেষ্ট জুরি না পাওয়া গেলে প্রত্যাখ্যাতদের ভেতর থেকে ফের বাছাই করা হবে।
আপসরফার পর আদালত জুরিদের শপথ করান। হেনরি ডেভিস বিচারকাজের সূচনা ঘটান। আজ আদালতের উদ্দেশে বলেন তিনি, হেস্টিংসের তিনটি অভিযোগের প্রথমটি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবেন তিনি, যেখানে হিকির লেখক হেস্টিংসকে ক্লাইভের 'শোচনীয় উত্তরসূরি' আখ্যা দিয়েছেন।
আদালতের সামনে নিবন্ধটি পড়ে শোনান ডেভিস। তার হাতে সোজাটাসাপটা মামলা আছে বলেই ধরে নিয়েছিলেন তিনি। নজির ছিল তার পক্ষে। তাকে শুধু প্রমাণ করতে হতো যে হিকি পত্রিকা ছাপিয়েছেন এবং হেস্টিংসেরই মানহানি ঘটেছে। 'বিবেচনার জন্যে আপনাদের সামনে দুটি বিষয় রয়েছে। মিস্টার হিকি এই পত্রিকা প্রকাশ করেছেন কি না এবং লর্ড ক্লাইভের উত্তরসূরি মানে মিস্টার হেস্টিংস কি না,' জুরির উদ্দেশে বলেন তিনি।
এর পেছনের কারণ হচ্ছে, আঠারো শতকে মানহানির সংজ্ঞা ছিল শান্তি নষ্ট করার মতো বিষয়বস্তু ছাপানো। যেকোনো কারণেই মুদ্রকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দেওয়া যেত। এ ছাড়া লেখকদের লেখার জন্যেও মুদ্রকেরা দায়ী ছিলেন, যার মানে বিষয়বস্তু চোখে না দেখলেও নিবন্ধ ছাপানোর দায়েই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেত।
সবচেয়ে বড় কথা, জুরি নয়, বিচারকই মানহানির বিষয়টি স্থির করতেন। জুরির একমাত্র কাজ ছিল কে নিবন্ধ ছাপিয়েছে, কার মানহানি ঘটেছে, স্থির করা। জুরিবৃন্দ এই দুটো বিষয় স্থির করার পর বিচারকেরা স্থির করতেন সেখানে বিদ্বেষ ছিল কি না। বিদ্বেষ থাকলেই মুদ্রক মানহানির দায়ে দোষী।
এভাবে হিকিকে অপরাধী প্রমাণ করতে ডেভিসকে কেবল জুরিদের বিশ্বাস করাতে হতো যে হিকি নিবন্ধটি ছাপিয়েছেন এবং 'শোচনীয় উত্তরসূরি' বলে হেস্টিংসকে বোঝানো হয়েছে।
'"শোচনীয় উত্তরসূরি"র চেয়ে অবজ্ঞাপূর্ণ আর কী হতে পারে?' জুরির উদ্দেশে প্রশ্ন করেন ডেভিস। তারপর হিকির দিকে ফিরে যোগ করেন, 'তিনি আরও বলেছেন যে মিস্টার হেস্টিংস ব্রিটনদের নামকে "গালাগালি এবং বিদ্রুপের" পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন।'
এরপর জুরির সামনে হিকির ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্য তুলে ধরেন ডেভিস। 'সবচেয়ে নিম্নস্তরের মানুষকে পক্ষে টানতে ইংল্যান্ডে কাজে লাগানো নিচ এবং তুচ্ছ কায়দা কলকাতার ভদ্রলোকদের নিয়ে গঠিত জুরিকে পক্ষপাতের দিকে ঠেলে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিস্টার হিকির পত্রিকায় গ্র্যান্ড জুরিদের ক্রীতদাস, ট্রেনের কুলি, ব্যাঙ-খোর এবং স্তাবক হিসেবে বর্ণনা করা খিস্তি দেখে আপনারা ভীত হবেন...'
বেলা ১১:০৫
বক্তব্য শুরু করলেন হিকির অ্যাটর্নি অ্যান্টর্নি ফে। হেস্টিংসের সাক্ষীদের জেরার ভেতর দিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। ওই নিবন্ধটি হেস্টিংস নয়, যুক্তি দেখান তিনি, মেদনিপুরের মিলিটারি কমান্ডার মেজর অ্যালেন ম্যাকফারসনের কথাও বুঝিয়ে থাকতে পারে। 'আপনার কি মনে হয় না যে, "শোচনীয় উত্তরসূরি" কথাটা মেদনিপুরের কমান্ডে থাকা সামরিক কর্মকর্তাকেও বুঝিয়ে থাকতে পারে?' পুলিশ প্রধান টমাস মোটেকে জিজ্ঞেস করেন তিনি।
নিবন্ধটি যে কাউকেই ক্লাইভের শোচনীয় উত্তরসূরি বুঝিয়ে থাকতে পারে প্রমাণ করাই ফের পরিকল্পনা ছিল। নিবন্ধটি কার কথা বুঝিয়েছে, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি করা গেলে জুরিবৃন্দ সন্দেহাতীতভাবে 'শোচনীয় উত্তরসূরি' কথাগুলো হেস্টিংসকে বুঝিয়েছে প্রমাণ করতে পারবেন না। এবং হিকি খালাস পেয়ে যাবেন।
কিন্তু মোটের মনে সন্দেহ ছিল না। 'শোচনীয় উত্তরসূরি' দিয়ে কেবল গভর্নর জেনারেল হিসেবে ক্লাইভের পদে আসীন ব্যক্তিকেই বোঝাতে পারে এবং তিনি হেস্টিংস। 'কথাটা মেদনিপুরের সামরিক কমান্ডারকে বুঝিয়েছে বলে মনে হয় না। উত্তরসূরি বলতে অবশ্যই লর্ড ক্লাইভের পদে আসীন মানুষটিকেই বোঝায়, কারণ, তিনি বর্তমান কাল বোঝাতে আসন কলঙ্কিত করেছেন কথাগুলো ব্যবহার করছেন,' জবাব দিলেন মোটে।
এবার পরের সাক্ষী কোম্পানির মুদ্রাকর চার্লস উইলকিন্সকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন ফে। 'লর্ড ক্লাইভ ছাড়া আর কাউকে চেনেন যার সাথে "অমর ক্লাইভের"র বর্ণনা মিলতে পারে?'
'আমি লর্ড ক্লাইভ ছাড়া আর কারও সাথে অমর কথাটার মিল পাই না,' জবাব দেন উইলকিন্স।
'এই কথার সাথে মেলার মতো কেউ থাকতেও পারে, যদিও আপনার জ্ঞান সে পর্যন্ত না-ও যেতে পারে?'
'সবই সম্ভব, কিন্তু আমি আর কারও কথা জানি না,' বললেন উইলকিন্স।
'আপনি কেন আপত্তিকর "শোচনীয়" শব্দটি গভর্নর জেনারেলের ওপর আরোপ করছেন, মিস্টার হেস্টিংস?' উইলকিন্স অস্পষ্টতার কথা মেনে নেবেন আশা করে জানতে চান ফে।
'আমি আগেই শপথ করে "উত্তরসূরি" কথায় মিস্টার হেস্টিংসকে বুঝিয়ে বলেছি। "শোচনীয়"ও নিশ্চয়ই একই লোককে বোঝায়। উত্তরসূরি কথাটা মেদনিপুরের মিলিটারি কমান্ডারের বেলায় খাটে বলে মনে হয় না।'
ফে পরাস্ত হচ্ছিলেন। একজন সাক্ষীও "শোচনীয় উত্তরসূরি" দিয়ে হেস্টিংস ছাড়া আর কারও কথা বোঝাতে পারে বলে সাক্ষী দিচ্ছেন না। তবু নিজের কৌশল বজায় রাখলেন তিনি। 'আমি আপনাদের হস্তÍক্ষেপ না চেয়ে পারছি না,' জেরা থামিয়ে জুরিদের দিকে ফিরে বললেন তিনি। 'এই ধরনের কটাক্ষ সৃষ্টিতে অনন্য প্রতিভা থাকা দরকার। যেখানে কেউ মাথা ঘামায়নি, সেখানে মানহানির ব্যাপার থাকতে পারে না। এটা অনেকটা ফাঁকা গুলি ছোড়ার মতো, যেখানে কারও প্রাণ যায়নি। এটা অনেকটা কে প্রাণ হারিয়েছে না জেনেই খুনের দায়ে কাউকে সাজা দেওয়ার মতো। একমাত্র পরোক্ষে ছাড়া পত্রিকাটি মিস্টার হেস্টিংসকে বুঝিয়েছে বলে মনে হয় না।'
'আমি নিজেই আমার পক্ষে লড়তে চাই,' লাফিয়ে উঠে বললেন হিকি। 'আপনারা আমার আইনজ্ঞের কথা বুঝতে পারছেন না, মনে হচ্ছে,' ফের দিকে ফিরে বললেন তিনি। যথেষ্ট দেখা হয়েছে হিকির। এটা স্পষ্ট ছিল যে প্রশ্নটা ক্লাইভের শোচনীয় উত্তরসূরির নয়, বরং পত্রিকার স্বাধীনতা।
'সরকারি ডাকঘরে একতরফাভাবে আমার পত্রিকা আটকে দেওয়া হয়েছে। দুই শর বেশি কনস্টেবল আর পিওন আমাকে টেনেহিঁচড়ে চেবার আর খুনে ডাকাতদের সাথে দুর্গন্ধময় হাজতে নিয়ে গেছে,' বললেন তিনি।
এবার ইম্পের দিকে ফিরলেন তিনি। 'স্যার এলাইজাহ ইম্পে, সুপ্রিম কোর্টের লর্ড চিফ জাস্টিস এবং সদর দেওয়ানি আদালতের সুপারিটেনডেন্ট। সংবাদপত্রের সেরা নিরাপত্তা হচ্ছে সৎ এবং নিরপেক্ষ জুরি।'
তার আত্মপক্ষ সমর্থন সহজ হলেও ভিন্নধর্মী ছিল। নিজেকে তিনি স্বেচ্ছাচার ও একনায়কতন্ত্রে¿র শিকার হিসেবে উল্লেখ করেন। মানুষ বা কোম্পানির অধিকার নেই তার ছাপার অধিকার কেড়ে নেওয়ার। 'কেবল লেখা, ছাপানো এবং প্রকাশনাই অপরাধের প্রমাণ হতে পারে না। বিদ্বেষ বা আপত্তিকর কিছু থাকলে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। নইলে বিবাদীকে খালাস দিতে হবে। এখন কোনো ইংরেজও সত্যি কথা বললেই তার নামে মানহানির মামলা ঠুকে দেওয়া হয়,' বললেন তিনি।
তার লক্ষ্য ছিল জুরিবৃন্দকে এ কথা বোঝানো যে বিচারক নয়, বিদ্বেষ এবং মানহানির বিষয় প্রমাণ করার অধিকার তাদের। আত্মপক্ষ সমর্থনে বিখ্যাত দ্য কিং বনাম হেনরি স্যাম্পসন উডফলের নজির উল্লেখ করেন তিনি। উডফলের মামলার সাথে তার মামলার অদ্ভুত মিল রয়েছে। কিং খোদ ফিলিপ ফ্রান্সিসের (ছদ্মনামে) লেখা একটি চিঠি ছাপানোর দায়ে উডফলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই চিঠিতে আরেক সাংবাদিক জন উইলকিন্সকে জেল থেকে মুক্তি না দিলে বিক্ষোভের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সবাইকে অবাক করে জুরিবৃন্দ আইনি প্রক্রিয়ার শত বছরের নজির উপেক্ষা করে উডফলকে দোষী সাব্যস্ত করতে অস্বীকৃতি জানান। তারা উডফলকে কেবল 'মুদ্রণ ও প্রকাশনা'র দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করেন। উডফলকে 'কেবল' ছাপানোর কারণে দোষী সাব্যস্ত করে তারা বুঝিয়ে দেন যে উডফলের মনে বিদ্বেষ ছিল না। এভাবে বিদ্বেষের বিষয়টি ফয়সালা করে তারা মানহানি নির্ধারণে বিচারকদের ক্ষমতা কেড়ে নেন। মামলা খারিজ হয়ে যায়। উডফল মুক্ত হয়ে বেরিয়ে যান। তিনি পরিণত হন ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা সম্পাদকে।
উডফলের মামলাটি তার নিজের মামলার ক্ষেত্রে পূর্বনজির হওয়া উচিত বলে হিকি যুক্তি দেখান। এবং উডফলের মামলার জুরির মতো তার জুরিবৃন্দও বিদ্বেষ এবং মানহানির বিষয়টি স্থির করতে পারেন। ১৫৮৫ সালে ক্যাথলিক মতবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা জনৈক প্রটেস্ট্যান্ট যাজক প্যাট্রিক প্রিকের গল্প দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন হিকি। ক্যাথলিকদের হাতে প্রটেস্ট্যান্টদের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী স্বর্গীয় শাস্তির বয়ান করা ফক্সেস বুক অব মার্টায়ার থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করেন তিনি। স্বর্গীয় সাজাভোগী এক ক্যাথলিকের নাম ছিল মিস্টার গ্রিনউড। ফক্সের বয়ানে, গ্রিনউডের পাপের দায়ে তাকে সাজা দেন ঈশ্বর। গ্রিনউডের ওপর 'মহাপ্লেগ' নেমে আসে, তার 'ঈশ্বরের নিষ্ঠুর বিচারে তার শরীরের ভেতর থেকে নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে আসে,' বলেছেন প্যাাট্রিক।
অথচ ভাগ্যের অদ্ভুত পরিহাস, এই গ্রিনউডই প্যাট্রিকের বয়ানের সময় রীতিমতো সুস্থ শরীরে সেখানে হাজির ছিলেন। গ্রিনউড আসলে প্রটেস্ট্যান্ট ছিলেন। তাকে 'প্যাপিস্ট' বলায় প্যাট্রিকের নামে মানহানির মামলা করেন তিনি। বিস্ময়করভাবে মামলা আদালতে উঠলে আদালত প্যাট্রিককে নির্দোষ সাব্যস্ত করেন। তিনি কেবল অন্য কারও কথাই বর্ণনা করেছেন এবং সেটা বলার সময় তাতে বিদ্বেষ ছিল না।
হিকি যুক্তি দেখান, প্যাট্রিকের বিচার অন্য কারও লেখার পুনরাবৃত্তি মানহানিকর না হওয়ার পক্ষেই নজির খাড়া করে। সম্পাদক হিসেবে জুরিবৃন্দ তার অন্য একজনের চিঠি ছাপানোর বিষয়টি বুঝবেন বলে আশা করেন তিনি, সেখানে বিদ্বেষ ছিল না।
হঠাৎ থেমে জুরির হাতে নিজের ভাগ্য ছেড়ে বসে পড়েন হিকি। জুরিবৃন্দ তার বাক্স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করবেন বলে আশা ছিল তার।
বেলা ১:২২
মধ্যদুপুরের গা জ্বালানো গরমে জুরিবৃন্দের উদ্দেশে নির্দেশনা দিলেন ইম্পে। সোজাসুজি হিকিকে অপরাধী সাব্যস্ত এবং ডেভিসের আইনি ব্যাখ্যাকেই সঠিক হিসেবে গ্রহণের ইঙ্গিত ছিল তাতে: জুরির একমাত্র দায়িত্ব নিবন্ধে হেস্টিংসের কথা বোঝানো হয়েছে কি না, নিরূপণ করা। সেটা বিদ্বেষপ্রসূত কি না, মানহানিকর কি না, সেসব নিরূপণের অধিকার তার।
'বিবাদী হিকি বিদ্বেষপ্রসূত এবং মিথ্যা মানহানিকর বক্তব্যের জন্যে দোষী। দিনের এমন সময় এমনি ভীষণ গরমে আপনাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কষ্ট দেব না। পত্রিকা অভিযোগকারীর দাবি মোতাবেক অর্থ প্রকাশ না করে থাকলে আপনারা তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে পারবেন না। আপনাদের দেখতে হবে প্রচলিত অর্থে কথিত অর্থ খাটে কি না, এর কোনো আলাদা অর্থ থাকার সম্ভাবনা নয়। পত্রিকাটি অপরাধী কি না, মানহানিকর কি না, সেটা নির্ধারণের ভার আপনাদের নয়,' বলেন তিনি।
বেলা ২:৫৭
এই বক্তব্য শেষে মামলা জুরিদের হাতে চলে যায়। খাসকামরায় যাওয়ার সময় সবার চোখ ছিল তাদের ওপর। পনেরো মিনিট পর ফিরে আসেন জুরির ফোরম্যান। অচিরেই রায় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে বিচারকদের জানান তিনি। এ কথায় জুরি আরও আলোচনার জন্যে আদালত মুলতবি ঘোষণার জন্যে বিচারপতি হাইডকে অনুরোধ জানান। সারা বিকেল আলোচনা করলেন জুরিবৃন্দ। সারা রাত চলল আলোচনা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রইল, সামনে আলোর দিশাহীন।