জাতীয় দলের প্রধান কোচ হওয়ার মতো দেশি কেউ নেই কেন?
গর্ডন গ্রিনিজ, এডি বার্লো, ট্রেভর চ্যাপেল, মহসিন কামাল-আলী জিয়া, ডেভ হোয়াটমোর, জেমি সিডন্স, স্টুয়ার্ট ল, রিচার্ড পাইবাস, শেন জার্গেনসেন, চান্দিকা হাথুরুসিংহে, স্টিভ রোডস এবং রাসেল ডমিঙ্গো। বাংলাদেশ ক্রিকেটের খোঁজ রাখেন, এমন মানুষদের কাছে নামগুলো অতি চেনা, কারও কারও মুখস্থ। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। তালিকাটা লম্বা হলেও এখানে নেই কোনো বাংলাদেশি নাম।
বাংলাদেশ দলের সঙ্গে দেশি কোনো কোচের নাম নেই বা সম্পৃক্ততাই ছিল না, ব্যাপারটা অবশ্য তেমন নয়। অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের প্রধান কোচের ভূমিকায় থাকা সারওয়ার ইমরান বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের সহকারী কোচ এবং ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ফিল্ডিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন। সিরিজে প্রধান কোচ হয়েছেন খালেদ মাহমুদ সুজন। স্পিন ও ফিল্ডিং কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন সোহেল ইসলাম।
তবে দীর্ঘমেয়াদে প্রধান কোচের দায়িত্ব পাননি কেউই। দেশি কেউ জাতীয় দলের প্রধান কোচ হতে আবেদন করেছেন, এমন দৃষ্টান্তও নেই। নিকট ভবিষ্যতে দেশি কোনো কোচ জাতীয় দলের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, এমন সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে। প্রধান কোচের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য বাংলাদেশি কোনো কোচ আছেন কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন।
বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে সব কোচই বিদেশি। জাতীয় দলের প্রধান কোচ দক্ষিণ আফ্রিকার রাসেল ডমিঙ্গো, ব্যাটিং কোচ অস্ট্রেলিয়ার জেমি সিডন্স, পেস বোলিং কোচ দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যালান ডোনাল্ড, স্পিন বোলিং কোচ শ্রীলঙ্কার রঙ্গনা হেরাথ ও ফিল্ডিং কোচ অস্ট্রেলিয়ার শেন ম্যাকডারমট। অন্যান্য পর্যায়েও ভরসা রাখা হয়েছে বিদেশি কোচে। হাই পারফরম্যান্স দলের কোচ ইংল্যান্ডের টবি র্যাডফোর্ড, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রধান কোচ হয়ে আসছেন অস্ট্রেলিয়ান স্টুয়ার্ট ল। ব্যাটিং কোচের দায়িত্বে থাকবেন ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান ওয়াসিম জাফর।
কয়েক মাস আগে গঠন করা বাংলাদেশ টাইগার্সের দায়িত্বে কেবল দেশি কোচদের দেখা যায়। এ ছাড়া কোনো পর্যায়েই দেশি কোচদের প্রধান চেয়ারে বসানোর সাহস দেখায়নি বিসিবি। এখন পর্যন্ত দেশি কোচদের সামর্থ্যে বিসিবির বিশ্বাস না আসার কারণেই এমন হয়েছে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ স্থানীয় দুই কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। বর্তমানে বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব নিতে পারেন, এমন কাউকেও দেখেন না এই দুই কোচ।
প্রধান কোচ হিসেবে কেউ যোগ্য না হয়ে ওঠার কারণ, দেশি কোচ হওয়ার সুবিধা-অসুবিধা, বিসিবির দায়সহ দেশি কোচদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন নাজমুল আবেদীন ও মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।
জাতীয় দলে প্রধান কোচের পদে দেশি কাউকে ভাবার সময়:
নাজমুল আবেদীন ফাহিম: অবশ্যই ভাবা যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার জন্য খেলোয়াড় যেমন তৈরি করতে হয়, কোচও তৈরি করার একটা ব্যাপার আছে। অনেক ভালো কোচ কিন্তু ওই পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, ওই পর্যায়ে নিজের স্কিল প্রয়োগ করা, নিজের চিন্তা ভাবনা প্রয়োগ করা, এসব সহজ ব্যাপার নয়। কোচ তৈরি করতে হয়। ওই কাজটা আমরা তো করিনি। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দল, 'এ' দল, এইচপি আছে, কোথাও তো দেশি কোচ দেখি না। কয়েক বছর আগেও ছিল। তৈরি করার চিন্তা ভাবনা আমাদের নেই, করিও নাই। এটা না করলে হবে না। যতোই মেধাবী হোক না কেন, এসব জায়গায় কাজ না করলে এখানকার কাজের চ্যালেঞ্জ কী, তা বোঝা যাবে না।
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন: দেশি কোচ জাতীয় দলের জন্য ভাববেন, আর আগে যে ধাপগুলো আছে, সেই ধাপগুলো কি তাদেরকে দেওয়া হয়েছে? আপনি ১৯ দলে দেশি কাউকে প্রধান কোচ দিতে সাহস পান না, 'এ' দল বা এইচপিতে দিতে সাহস পান না। তাহলে তাদের হাতে কীভাবে জাতীয় দল দেত চাইবেন? একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে তো আসতে হবে। যখন দেখা যাবে কেউ একজন 'এ' দল ভালোভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন, তখন সাহস করা যাবে। জাতীয় দেশি দেওয়া হয়, কিন্তু সেটা সাপোর্ট স্টাফ। আমি কোচ বলব না। আমি সাপোর্ট স্টাফ বলবো, যারা একটু থ্রো করতে পারে, একটু ক্যাচিং করাতে পারে। কাউকে যে স্পেশালিস্ট বলা হচ্ছে, সেটা কীসের ভিত্তিতে? তার কোনো ডিগ্রি আছে? তাকে কোনো কোর্স করিয়েছেন আপনারা? ধরুন কেউ একজন খেলেছেন, পেসার ছিল বলে হয়তো তাকে বলা হচ্ছে পেস বোলিং স্পেশালিস্ট। কিন্তু তার ব্যাকগ্রাউন্ড কী, আলাদা পড়াশোনা, কোর্স বা এটায় প্রমাণিত কিনা; সেটার তো একটা প্রক্রিয়া থাকতে হবে। কোনো তো প্রক্রিয়া নেই। খেলোয়াড়দের ঘরোয়া, 'এ' দল বা এইচপিতে সুযোগ দিয়ে জাতীয় দলে নেওয়া হচ্ছে। কোচকেও তো তৈরি করে তারপর জাতীয় দলে দিতে হবে। সেটা তো দেওয়া হচ্ছে না। সব সময়ই সাপোর্টিং রোলে রাখা হয়। জাতীয় দলে কাউকে দেশি কোচ বানাতে হলে তাকে আগে অনূর্ধ-১৯, 'এ' দল , এইচপিতে প্রধান কোচ করতে হবে। তখন সে বোল্ডলি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সাপোর্টিং রোলে থাকলে সেটা পারবে না। সব কিছুর প্রক্রিয়া আছে, প্রক্রিয়া মানা হলে একটা সময়ে সেটা সম্ভব হবে।
প্রধান কোচ হিসেবে যোগ্য কেউ আছেন?
নাজমুল আবেদীন ফাহিম: সরাসরি এখনই দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না। আছে হয়তো, কিন্তু একজনের যখন অভিজ্ঞতা থাকে এ পর্যায়ে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার, তখন সুবিধা হয়। সারওয়ার ইমরান কিন্তু প্রথম টেস্টে কোচ ছিলেন। পরেও আমাদের যখন কোচ ছিল না, মাঝে মাঝে চালিয়েছেন। তো এসবে খেলোয়াড়দের যেমন আত্মবিশ্বাসের একটা ব্যাপার থাকে, কোচদেরও আত্মবিশ্বাসের ব্যাপার থাকে যে হ্যাঁ আমি অনেক দিন ধরে এই পর্যায়ে কাজ করছি, আমি সফল, আমাদের প্রতি সবার সম্মান আছে, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার আস্থা আছে, অন্য মানুষের আস্থা আছে সেটাও আমি জানি; এই বিষয়গুলো খুব জরুরি। ওই জায়গা তো আমি কাউকে দিইনি। আমরা মনে হয় সব সময় বোঝানোর চেষ্টা করেছি 'যে আমাদের কেউ নেই যার হাতে দায়িত্ব দেওয়া যায়।' যেটা আসলে সত্যি নয়। ওই কারণেই আজ যদি বলে কাল থেকে জাতীয় দলে বাংলাদেশের একজন কোচ হবে, সেটা সম্ভব হবে না। তার পেছনে সময় দিতেই হবে, তাকে তৈরি করতেই হবে। যারা এই মুহূর্তে ভালো আছে, তাদেরকে আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জাতীয় দলে নিয়ে আসতে পারি। যদি তাদের জন্য সেই জায়গাটা তৈরি করে দিতে পারি, যে অভিজ্ঞতাটা দরকার, সেই সুযোগটা যদি তাদের তৈরি করে দিতে পারি; তাহলে হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই চিন্তা ভাবনা করতে পারব। আমরা অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়েও বিদেশি কোচের ওপর নির্ভরশীল, সত্যি বলতে খুব কঠিন।
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন: কাকে দেবেন? আপনি তো প্রমাণ করেননি। কার মধ্যে কী আছে, সেটা প্রমাণ হয় ফলের ওপর। কেউ কোচিং করিয়ে চ্যাম্পিয়ন করালে বা পাঁচটা ছেলেকে উন্নত করালে তখন তাকে মাপা যায়। এরপর কোচকে সবাই মূল্যায়ন করবে। এই মুহূর্তে জাতীয় দলের প্রধান কোচ হওয়া আমাদের দেশি কোচদের জন্য খুব কঠিন। কারণ তারা সেভাবে সাহসীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। কারণ আপনি যখন জাতীয় দলের প্রধান কোচ হবেন, আপনাকে অনেক কিছু হ্যান্ডেল করতে হবে। শুধু দল চালাবেন তা তো নয়, আপনাকে কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মিডিয়া হ্যান্ডেল করতে হবে, তারকা ক্রিকেটারদের সামলাতে হবে। সাকিব, তামিমদের যদি আপনি কোচিং করান, তাদের আপনি ড্রপ দিতে পারবেন কিনা, সেই সাহস আপনার লাগবে। সব মিলিয়ে এসব অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তবে যদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসা হয়, তখন একজন কোচ অনেক কিছুই বুঝতে পারবেন। কিন্তু এখনই কাউকে দেওয়াটা খুব কঠিন।
যে কারণে তৈরি হয়নি কোচ:
নাজমুল আবেদীন ফাহিম: ভালো কোচ আসার দরজাটা আমরা খুলিনি। ভালো কোচ হতে গেলে একটা ভোলো খেলার ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার, শিক্ষা দরকার, নিবেদন দরকার। এখানে নিবেদিত, ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পন্ন লোকজন আছে কিন্তু শিক্ষার যে ব্যাপারটা, সেখানে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ঘাটতি থাকার কারণ হচ্ছে কোচ হিসেবে বোর্ড যাদের দায়িত্ব দেয়, তাদের বেতন এতো কম হয়, সেটা মোটেও তাদের স্ট্যাটাসের সঙ্গে যায় না। হয়তো একজন ক্রিকেটার প্রায় জাতীয় দলে খেলেছে বা প্রথম শ্রেণিতে ভালো খেলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করা একটা ছেলে; সে যে এখানে আসবে, তার য স্ট্যাটাস বা জায়গা দেওয়া দরকার, সেই জায়গাটা দেওয়ার কাছেও আসিনি। আমাদের কোচিং কমিউনিটিতে বড় একটা অংশ আছে, কোচ হিসেবে তাদের যা থাকা দরকার, সেটা তাদের নেই। এবং এতে তারা অল্পতেই সন্তুষ্ট। কর্তৃপক্ষও সন্তুষ্ট, কারণ অল্পতেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। ভালো কোচের জন্য একটা নিরাপত্তা দরকার, সম্মান দরকার এবং আর্থিক ভালো একটা প্রস্তাব দরকার। এ কারণে ওই মানের ক্রিকেটাররা এখানে আসে না। ২০-২৫ বা ৩০, ৪০ বছর আগে আমাদের ক্রিকেটাররা কিন্তু ভালো ভালো জায়গা থেকে পড়ালেখা করেছে। কিন্তু এখন বা গত ১০ বছর ধরে সেই জিনিসটা নেই। তো খুব কম মানুষ থাকে, যারা মোটামুটি ভালো পর্যায়ে খেলেছে, শিক্ষা আছে, কিন্তু তারা চাইলেও এখানে আসতে পারে না। অথচ উচিত লোভ দেখিয়ে তাদেরকেই এখানে টেনে নিয়ে আসা যে এখানে ক্যারিয়ার আছে। কিন্তু সেটা আমরা করি না। ভালো হবে, এমন কোচের সংখ্যা কিন্তু বেশি নেই। এবং সেটা ওই কারণেই।
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন: আমি সব সময় ঘাটতি দেখি। আমার মনে হয় টেকনিক্যালি বাইরের কোচদের সঙ্গে আমাদের কোচদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। এটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের অনেক ভালো ভালো কোচ আছেন, যারা অনেকদিন ধরে কাজ করছেন। যেমন সোহেল, সে স্পিন বোলিং অনেক ভালো বোঝে। সে খুব ভালো স্পিন বোলিং কোচ, স্পেশালিস্ট। কিন্তু কাউকে হেড কোচ হতে হলে আরও অনেক কিছু নিয়ে কাজ করে আসতে হবে। প্রধান কোচ হিসেবে শুধু টেকনিক্যাল বিষয় দেখাই নয়, আরও অনেক কিছু আছে। এসব জায়গায় নিজেদের উন্নত করার দিক থেকে আমাদের কোচের অনেক ঘাটতি আছে। কোচেস এডুকেশন সিস্টেমটা খুবই বাজে অবস্থায় আছে। আমরা চিন্তা করি একজন কোচকে উন্নত করার জন্য একটা ৫ দিনের কোর্স করিয়ে দিলেই হয়ে গেল। আসলে তো তা নয়। অনেক পড়াশোনা করতে হবে, সেমিনার করতে হবে, অ্যাডভান্স কোচিং করবে; তখন অনেক কিছু শিখতে পারবে। আমাদের এসব নেই বলেই আমরা কোচরা খুব বেশি এগোতে পারিনি। তবে নিজের ওপর অনেক কিছু থাকে। এমন না যে আপনি খেলোয়াড়, আপনার ভালো উইকেট লাগবে, সুযোগ সুবিধা লাগবে। নিজে থেকে অনেক সুযোগ আছে শেখার, নিজেকে উন্নত করার। সেটার জন্য নিজেরে আগ্রহটা খুব জরুরি।
দেশি কোচ হওয়ার সুবিধা:
নাজমুল আবেদীন ফাহিম: আমার মনেহয় আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি সব দেশের চেয়ে আলাদা। ভারত অনেক দিন ধরে ক্রিকেট খেলে, শ্রীলঙ্কা আছে। কিন্তু আমাদের ক্রিকেটের ধরনটা অন্যরকম। আমাদের ক্রিকেটে শৃঙ্খলার অনেক অভাব ছিল নিটক অতীতে। ১০-১২ বছর আগেও শৃঙ্খলার অভাব ছিল। ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের মানসিকতা, ক্লাব অফিসিয়াল, যারা খেলা পরিচালনা করে মানে ম্যানেজমেন্ট, অন্যান্যে দেশের যে সংস্কৃতি, আমাদের দেশে ভিন্ন। আমাদের ক্রিকেটার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া যেহেতু ভিন্ন, আমাদের মানসিকতা বিদেশি কোচরা কিন্তু অনেক সময় পরিষ্কার করে বোঝে না। দেশি কোচদের ক্ষেত্রে এটা প্লাস পয়েন্ট। কোচের সাথে ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় বলে আমি মনে কিরা না। এটা বোঝানো সম্ভব। কিন্তু মানসিকতা বোঝার যে ব্যাপারটা, সেটা বুঝতে বিদেশি একজন কোচের অনেক সময় লাগে। ওইটা বুঝতে বুঝতে অনেক সময় ক্ষতিও হয়ে যায়। কোচের চলে যাওয়ার সময়ও হয়ে যায়। এখানেই সম্ভবত সবচেয়ে বড় সাহায্য হয় একজন কোচ খেলোয়াড়ের ভেতরের ব্যাপারটা যখন বোঝেন। মানসিকতা কেমন, তারর রেসপন্স কেমন, সব কিছুতে কিভাবে রেসপন্ড করে; এসব ব্যাপারগুলো আমাদের কোচরা সবচেয়ে ভালো বুঝবেন। শুধু আমাদের নয়, যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই তাই। পাকিস্তানের অনেক দেশি কোচ থাকে। শ্রীলঙ্কায় সেটা আমরা দেখেছি, ভারতে আমরা দেখেছি। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সেটা বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশে শুধু এই জিনিসটার অভাব আছে। কোনো কোচই দেশীয় না, ১৯ দলেও না। এখানে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই।
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন: এখানে অনেক সুবিধা আছে। দেশি কেউ কোচ হলে সে আগে থেকেই ক্রিকেটারদের সম্পর্কে ধারণা নেওয়া থাকবে। কাকে কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে, কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, এখানকার ক্রিকেট সংস্কৃতি, ভাষা, পরিবেশ সবই তার জানা থাকবে। এ ব্যাপারগুলো ইতিবাচক, অবশ্যই সবিধা আছে।
দেশি কোচ হওয়ার অসুবিধা:
নাজমুল আবেদীন ফাহিম: দেশি কোচ হলে সে ম্যানেজমেন্টের সাপোর্ট পাবে না। দেশি কোচকে প্রতিটা পদে পদে প্রমাণ করতে হবে সে ভালো। তার ভুল করার কোনো সুযোগই থাকবে না। তাকে সব সময় ভীষণ সমালোচনার মুখে কাজ করতে হবে। তারকা ক্রিকেটারদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা দেখি না। একজন কোচের এটাই সবচেয়ে বড় গুণ। কোচ হচ্ছেন আর্কিটেক্ট, তিনিই সব সাজাবেন। এক্ষেত্রে দেশি কোচ হলে ভালো বুঝবেন আমাদের ক্রিকেটারদের মানসিকতা।
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন: আপনি কোচ হলে আপনি বিসিবির চাকুরিজীবি, তখন বোর্ড পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। চাকুরিজীবি হয়ে সব কথা বলা কঠিন, অনেক কিছুই বলতে পারবে না। বলবে ওকে খেলাও, খেলাতে হবে; কিছু করার থাকবে না, কারণ সে তো চাকুরীজীবি। তো এটা খুবই কঠিন পরিস্থিতি, ওই রকম গাটসওয়ালা মানুষ হওয়াও খুব কঠিন হবে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন একজন কোচ যখন ড্রেসিং রুমে ঢুকবেন, তার প্রতি পুরো দলের সম্মান আছে কিনা, বোর্ডের সম্মান আছে কিনা, সেটা কিন্তু বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের কেন কোচ করে না, বোর্ড মনে করে আমরা ওই জায়গার জন্য যোগ্য নই, আমরা কোনো কিছু প্রমাণ করিনি। এ কারণে দেয় না, এটা সোজা হিসাব। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে, এমনি চাইলে তো দেবে না। এ কারণে হয়তো তারা বিশ্বাসও করে না। আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় যে বাধা, সেটা হলো; সবার কাছ থেকে আমরা ওই সম্মান এখনও আদায় করতে পারিনি। এটা আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।
বিসিবির দায়
নাজমুল আবেদীন ফাহিম: এখানে শো অফ করার একটা ব্যাপার থাকে। আমরা ধরেই নিয়েছি আমাদের নামিদামি কোনো কোচ থাকবে। কোচ মানেই নামিদামি কেউ থাকতে হবে। সেটা যদি না হয়, তাহলে সেটা আমাদের জন্য একটু লজ্জার হয়ে যায়। এমন মনোভাব অনেকের মধ্যেই আছে। একজন ভালো কোচ মানে কী, তার কাছ থেকে আমরা কী চাই, এটাও আমরা পরিষ্কারভাবে জানি না। নামিদামি নন, আমাদের দলের জন্য উপযোগী হবে, এমন কাউকে নিতে হবে। আমাদের মানসিকতা, সংস্কৃতির জন্য আমাদের ভালো কোচের চাওয়ায় খুব ভিন্নতা। সব কোচ এসে ভালো করবে, তা নয় কিন্তু। যাকে ভালো মনে করছি না, সেও ভালো করতে পারে। আমরা পরিস্কার করে বুঝি না আমাদের প্রয়োজন ঠিক কী। আমরা ধরেই নিই একজন নাম করা বলেছে ও ভালো, তাকেই আমরা ভালো ধরে নিই। আমরা দেখেছি অনেক নামিদামি কোচ এখানে এসেছেন, সেটায় ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি হয়েছে।
মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন: আমরা এখানে অনেক ভালো জায়গায় যেতে পারতাম। শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান; তাদের অনেক কোচ বাইরে কোচিং করায়। সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনে, মালিঙ্গা আইপিএলে গিয়ে কোচিং করাচ্ছে। আমাদের কেউ অবসর নেওয়ার পর কাউকে আইপিএলে কোচ বানাতে পারবেন? তার মানে আমরা যে আমাদের ক্রিকেটারদের বড় করছি, তাদের আমরা সেই ক্রিকেটীয় জ্ঞান দিয়ে বড় করতে পারছি না। আমরা শুধু বলি শিখি আর শিখি। ১০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছি, তাও শেখাচ্ছি। আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি এমন যে আমাদের ছেলেরা দেরিতে সব কিছু ধরতে পারে। ১০-১২ বছর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলা ক্রিকেটারের ক্রিকেট জ্ঞানও ততোটা ভালো নয়, তাকেও অনেক কিছু শিখিয়ে দিতে হয়। ১৫ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা কেউ উইকেটে গিয়ে ২ বলের মধ্যে বলে দিতে পারবে আমাকে কোন লেংন্থে বল করতে হবে। ক্লাব ক্রিকেটে জাতীয় দলের ক্রিকেটারকেও আমাকে বলে দিতে হয়েছে, 'এই উইকেটে এই পেসে বল কর।' এটা হওয়া উচিত না। উল্টো সে আমাকে সাহায্য করবে 'স্যার এই উইকেটে এমন বোলার খেলাতে হবে।' আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি এমন যে তাদের আমরা ছোট বেলা থেকে সেভাবে শেখাতে পারি না। জাতীয় পর্যায়েও শেখানোর চেষ্টা করি। এটা অনেক ছোট বেলা থেকে এই শিক্ষাগুলো দেওয়া উচিত। ভালোভাবে শেখানো উচিত। তখন দেখা যাবে ১০-১২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললে সে আইপিএলের কোচ হচ্ছে।