‘আমার সামনে এখনও ১০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার’
১৯ বছর বয়সে যুব বিশ্বকাপ সফর, নিজের ক্রিকেট দর্শন নিয়ে ২০১৩ সালে একটি বই লেখেন উন্মুক্ত চাঁদ। বইয়ের নাম 'দ্য স্কাই ইজ দ্য লিমিট'- মাই জার্নি টু দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ'। নিজের বইয়ে সীমানার কথা বললেও ভারতীয় এই ক্রিকেটারের আকাশের কোনো সীমা ছিল না। উন্মুক্তের আকাশ ছিল উন্মুক্ত, অবারিত। যেখানে উড়ে বেড়াতো কতো না রঙিন স্বপ্ন। সেসব স্বপ্ন যতোটা না তার, ভারতীয় ক্রিকেটমোদীদের এরচেয়ে বেশি।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে রাতারাতি তারকা বনে যান উন্মুক্ত। উনিষেই তার জায়গা হয় খ্যাতির চূড়ায়। তার বাড়িতে লাইন পড়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ড কোম্পানির। ছয়টির সঙ্গে চুক্তিও হয়। যুব বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কোমল পানীয়র একটি বিজ্ঞাপনে স্ক্রিন ভাগাভাগি করেন বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে। নজরকাড়া পারফরম্যান্সে হইচই ফেলে দেওয়া ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানকে তখনই তুলনা করা হয় কোহলির সঙ্গে। বলা হয়, তিনিই আগামী শাসন করবেন।
রঞ্জি ট্রফিতে সুযোগ মেলে, ডাক পড়ে আইপিএল, ভারত 'এ' দল থেকে। কিন্তু বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে যে উন্মুক্তের ব্যাটে বিশ্ব জয়ের গল্প লেখে ভারত, সেই উন্মুক্ত হারিয়ে বসেন পথ। অপার সম্ভাবনাময় উন্মুক্তের আশার প্রদীপ নিভে যেতে থাকে। ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি হয়ে ওঠেন খসে পড়া তারা। যাকে নিয়ে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন, সেই উন্মুক্ত অন্যান্য ঘরোয়া ক্রিকেটসহ আইপিএলের কয়েকটি মৌসুমে নিস্প্রভ থাকার পর বাদ পড়েন দিল্লির দল থেকে। লম্বা রেসের ঘোড়া হওয়া তো দূরের কথা, ভারত দলে অভিষেকই থেকে গেছে স্বপ্ন হয়ে। ২০২১ সালে অবসরই নিয়ে নেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে।
পথ হারিয়ে দিগ্বিদিক ছোটা উন্মুক্ত দিশা পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে ঠিকানা গাড়া ভারতীয় এই ক্রিকেটার তিন বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায়। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে তিন বছর পূর্ণ হবে তার। এরপর দেশটির হয়ে খেলার উপযুক্ত হবেন উন্মুক্ত। মাঝের এই সময়টাতে বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া লিগে খেলে বেড়িয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ভারতের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিগ ব্যাশে খেলা উন্মুক্ত প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছেন বিপিএল।
যদিও অভিজ্ঞতাটা ভালো হয়নি, চার ইনিংসে ৩৭ রান করেছেন তিনি। হতাশার গল্প যেন পিছুই ছাড়ে না। অবশ্য এসব নিয়ে ভাবেন না যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটকে 'নেক্সট লেভেল'- এ নেবেন বলে ব্রত করা উন্মুক্ত। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ও বিপিএল অভিজ্ঞতা, যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো, দারুণ সম্ভাবনা থাকার পরও লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারা, ক্রিকেট নিয়ে বর্তমান লক্ষ্যসহ অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
টিবিএস: বিপিএল খেলে কেমন লাগলো, কতোটা উপভোগ করেছেন?
উন্মুক্ত চাঁদ: স্বাভাবিকভাবেই ভালো ছিল না। আমি অনেকগুলো ম্যাচ খেলতে পারিনি এবং আমার পছন্দের জায়গায় ব্যাটিং করতে পারিনি। আমি সাধারণত ওপেনিং কর অথবা তিন নম্বরে খেলি। দুর্ভাগ্যবশত, দলও খুব একটা ভালো করতে পারেনি। আমরা যদি আরও কয়েকটি ম্যাচ জিততাম এবং আমি আরও কয়েকটি ম্যাচ খেলতে পারতাম, তাহলে দারুণ হতো। কিন্তু এটা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট, আপনাকে এটা মেনে নিতে হবে।
টিবিএস: মানের দিক থেকে বিপিএলকে কেমন মনে হলো?
উন্মুক্ত: মানের দিক বিপিএল দারুণ ছিল, সেটা বলতেই হবে। আমরা খুব একটা ভালো খেলিনি, তবে আমি খেলাগুলো অনেক উপভোগ করেছি। বাকি দলগুলো সত্যিই ভালো কাজ করেছে। আমি আবার বিপিএলে আসতে চাই।
টিবিএস: আগেও বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন, এবার বিপিএল খেললেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোন দিকটাকে উল্লেক করার মতো মনে হয়?
উন্মুক্ত: ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) বাংলাদেশের অন্যতম সেরা টুর্নামেন্ট। বিপিএলও ভালো টুর্নামেন্ট। প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে, ক্রিকেটের মান চমৎকার ছিল। সব সময় উন্নতির জায়গা থাকে। আমি আশা করি পরের বছর এটা আরও জাকজমক হবে। আমি আবার বাংলাদেশে আসতে চাই। এখানকার খেলোয়াড়রা খুব হেল্পফুল এবং হাসিখুশি।
টিবিএস: আপনার বয়স চলছে ২৯, খুব বেশি নয়। গত এক দশকের ব্যর্থতা ভুলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনও দারুণ কিছু করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করেন?
উন্মুক্ত: কেন নয়? আমি ভারতে বেশ সাফল্য পেয়েছি। প্রত্যেক খেলোয়াড়ই তার দেশের হয়ে খেলতে চায়। কিন্তু ব্যাপারগুলো সব সময় আপনার মতো হয় না। আপনার এটা গ্রহণ করা উচিত এবং এর সঙ্গেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেলার উপযুক্ত হতে যাচ্ছি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার সামনে এখনও ১০ বছরের ক্যারিয়ার। এর পেছনে আমি আমার সব শ্রম দিচ্ছি।
টিবিএস: বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে সঠিক টি-টোয়েন্টি কাঠামো না থাকায় হঠাৎ করে এই ফরম্যাটে খেলাটা কি বড় চ্যালেঞ্জ হয় তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য?
উন্মুক্ত: ক্রিকেটে ধীরে ধীরে এগোতে হয়, এটা একটা লম্বা প্রক্রিয়া। বয়সভিত্তিকে তিনদিন, চারদিন ও একদিনের ম্যাচ বেশি মানানসই। কিন্তু এখন সবাই আইপিএল দেখে বড় হয়। তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মানিয়ে নেওয়া কঠিন বলে মনেহয় না আমার। বরং আমি মনে করি টি-টোয়েন্টির এই সময়ে টেস্টে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হবে।
টিবিএস: অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছেন, নেতৃত্বে ছিলেন আপনি। ভিন্নভাবে পা ফেলার সুযোগ ছিল কিনা, যেটাতে আপনি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারতেন?
উন্মুক্ত: আমি অনূর্ধ্ব-১৯ ও ভারত 'এ' দলে সাফল্য পেয়েছি। আপনি এটাকে ভাগ্য বলতে পারেন, আরও অনেক কিছু বলতে পারেন এভাবে যে, প্রতিভাকে দারুণ কিছুতে রূপান্তরিত করা হয়নি। তবু আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং নিজের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মানুষ যেভাবে ভাবেন, সব সময় তেমন হবে না। হারিয়ে যাওয়া সময় পুষিয়ে নিতে আমার সামনে এখনও অনেক বছর আছে। অনেক খেলোয়াড় আছে যারা ৩০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে সাফল্য পেয়েছে।
টিবিএস: তখনই বিরাট কোহলির সঙ্গে আপনার তুলনা করা হতো। হলা হতো আপনি হবে ভবিষ্যৎ। কিন্তু কোথায় পথ হারালেন যে ভারত দলে অভিষেকই হলো না?
উন্মুক্ত: কখনও কখনও পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু হয় না। আপনাকে সময়ের কথাও ভাবতে হয়। একটা সময় ছিল যখন বীরু (বীরেন্দ্র শেবাগ) ভাই এবং গৌতম (গম্ভীর) ভাই ওপেন করতেন, শিখর (ধাওয়ান) তার পরে ওপেন করেছেন। কখনও কখনও আপনার আপনার পছন্দের জায়গা খালি পেতে হবে। অনেক সময় হয়, আপনি ভালো করেও সুযোগ পাবেন না। আমি ভারত 'এ' দলকে নেতৃত্ব দিয়েছি,আমার অধীনে ১৫ জন খেলোয়াড় ছিল। তাদের বেশিরভাগ ভারতের হয়ে খেলেছে। সুযোগটা কখনও কখনও ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি কখনই জানেন না যে আমি যদি দুই-একটি হাফ সেঞ্চুরিকে সেঞ্চুরিতে রূপান্তরিত করি, তাহলেও কী হবে। আইপিএলে আমি আইপিএলে কখনই সেভাবে রান করতে পারিনি। আমি অনেকদিন ভারত 'এ; দলে ছিলাম, আমার সঙ্গে খেলা প্রায় সব খেলোয়াড় জাতীয় দলে খেলেছে।
টিবিএস: যুব বিশ্বকাপ জিতে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছয়টি ব্র্যান্ডের সাথে চুুক্তি হয় আপনার, বিরাট কোহলি এবং মহেন্দ্র সিং ধোনির একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় আপনাকে। ওই বয়সের তারকাখ্যাতিই কি আপনাকে পেছেনে টেনে ধরেছে?
উন্মুক্ত: তারকাখ্যাতি আপনার শত্রু বাড়াবে। এই বিষয়ে আসলে বেশি কথা বলার সুযোগ নেই। যখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই, আমি অনুভব করি যে ব্যাপারগুলো আমার ক্যারিয়ারকে ভুলভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে পেশাদার হিসেবে সেটাই করেছি, যেটা করা উচিত ছিল। এটা আমার ক্যারিয়ারের আরেকটি অংশ ছিল, সামনে আসায় এটা আমাকে করতে হয়েছে। ব্যাপারগুলো আমার জন্য ব্যাকফায়ার করেছিল কিন্তু আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
টিবিএস: ক্যারিয়ারের শুরুতে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্তবোধ কাজ করে? কিংবা কোনটাকে নিজের সবচেয়ে বড় ভুল বলে মনেহয়?
উন্মুক্ত: ভুল অনেক বড় শব্দ, এগুলো শিক্ষা। আপনাকে প্রতিদিন শিখতে হবে এবং আরও ভালো করতে হবে। একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে আমি মনে করি ভারত 'এ' দলের হয়ে করা আমার সেই পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর সেঞ্চুরিতে পরিণত করা উচিত ছিল। তবে খেলোয়াড় হিসাবে আপনি ভালোবাসা দিয়ে খেলবেন, মাইলফলকের জন্য খেলবেন না।
টিবিএস: কখন এবং কেন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন?
উন্মুক্ত: ভারতে গত দুই-তিন বছর আমার জন্য আদর্শ ছিল না। আমি ২০১৮ সাল থেকে রাজ্য অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আমার ঝামেলা। এক পর্যায়ে আমি ভারত 'এ' তলের হয়ে খেলছিলাম এবং তারা আমাকে দিল্লি দল থেকে বাদ দেয়। এতে বোঝা গিয়েছিল যে, ব্যাপারগুলো ভালো যাচ্ছে না। আমার কষ্ট হয়েছে, আঘাত পেয়েছি। আমার মনে হয়েছিল ক্রিকেটের চেয়ে অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় আনা হচ্ছিল। তখনই আমি ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই।
টিবিএস: যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটের কেমন অবস্থা?
উন্মুক্ত: বেশ ভালো অবস্থা। এ বছর তারা মেজর লিগ ক্রিকেট শুরু করছে। আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেটের বড় বাজার খুলছে।
টিবিএস: যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটকে কতোটা সাহায্য করতে পারবেন বলে মনে করেন?
উন্মুক্ত: আগামী বছর থেকে আমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করব। ২০২৪ একটি বিশ্বকাপের বছর এবং আয়োজক দেশ হিসেবে মূল ধারায় আসার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের। ভালো দল পাওয়ায় সেটা করার জন্য আমরা এখন সামর্থ্যবান।
টিবিএস: ২০১৩ সালে আপনি একটি বই লিখেছেন। আপনার বই সম্পর্কে কিছু বলুন..
উন্মুক্ত: আমার বইয়ের নাম 'দ্য স্কাই ইজ দ্য লিমিট'। এটা বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতিকথা। বিশ্বকাপের সময় আমি আমার পুরো যাত্রা সম্পর্কে ডায়েরি রাখতাম। আমি কীভাবে ভারতে বড় হয়েছি, সেখানে পড়াশোনা করা এবং ক্রিকেটে যেসব লড়াই করতে হয়েছে, সেসব নিয়ে। বইটি অ্যামাজনে পাওয়া যাচ্ছে।