হেলায় সুযোগ হারালো রনি তালুকদার
শেষ ম্যাচে আমাদের ব্যাটিংয়ের শুরুটা ভালো না হলেও সুযোগ ছিল ইনিংসটা ভালোভাবে শেষ করার। সেটা করতে পারলে ২৭৪ না হয়ে আমাদের রান ৩০০ হতে পারতো এবং আমাদের বোলারদের হয়তো এতোটা চ্যলেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতো না।
রনি তালুকদার তার সুযোগটা হেলায় হারালো এবং একটা অতৃপ্তি নিয়েই তাকে দেশে ফিরতে হবে। তার এই ছোট্ট ইনিংসটার ভিডিও দেখলে সেও হয়তো নিজের উপর অসন্তুষ্ট হবে। আশাকরি ভবিষ্যতে রনি আবার সুযোগ পাবে এবং তার সদ্বব্যবহার করবে।
আজ (১৪ মে) তামিমকে ইনিংসের প্রথম দিকেই হারিয়ে ফেললে আমরা হয়তো বিপদে পড়ে যেতাম। এই ম্যাচে এ কারণেই ওর স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন তোলা বোধহয় অনুচিত হবে। সত্যি বলতে তামিমের স্ট্রাইক রেট অন্তত আজ বেশ সন্তোষজনকই ছিলো। এই ফরম্যাটে উপর থেকে একজনকে লম্বা ইনিংস খেলতেই হবে। তামিম ছাড়া আমাদের বাকি সব ব্যাটসম্যানের মধ্যেই অতি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠার প্রবলতা খুবই স্পষ্ট।
ভালো ফর্ম একজন তরুণ খেলোয়াড় কে নিজের অজান্তেই অনেক সময় অতি আক্রমনাত্মক করে তুলতে পারে। সে কারনেই আজ যেমন সুযোগ থাকার পরও মিডল অর্ডারে ব্যক্তিগত বড় স্কোর হয়নি, পাশাপাশি উল্লেখ করার মত পার্টনারশিপও আমরা পাইনি। আমাদের শেষ চারজন ব্যাটসম্যানের কথা বিবেচনা করে হলেও প্রয়োজন ছিল স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের আরও নিয়ন্ত্রিত ব্যাটিংয়ের। তাহলে অল্প রানে শেষ চার উইকেট হারানো বা পুরো ওভার না খেলতে পারার ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হতো না। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং ব্যাটসম্যানদের আরও দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, এটিই এর একমাত্র সমাধান।
এই ম্যাচটা আমরা জিতেছি নাকি আয়ারল্যন্ড হেরেছে, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কারণ শেষ দিকে একটা পর্যায় পর্যন্ত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ কিন্তু তাদের হাতেই ছিল। কিন্ত কিছুটা তাদের খেই হারিয়ে ফেলা এবং আমাদের হিসেবি বোলিংয়ের কারণে শেষ হাসিটা আমরাই হেসেছি।
বলতেই হবে, কঠিন একটা সময়ে শান্তকে বোলিংয়ে নিয়ে আসাটা ছিল অত্যন্ত সাহসী একটি সিদ্ধান্ত। এটি কাজে না লাগলে পুরো দায় তামিমকেই নিতে হতো। এই ধরনের চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত কিন্তু একজন উচ্চাকাঙ্খী অধিনায়ককে নিতেই হবে, যেখানে প্রশংসা বা সমালোচনা দুটোরই সম্ভাবনা থাকবে। তবে শান্তর বোলিংয়ের প্রশংসা করতেই হবে।
এই ম্যচে একটা বড় প্রাপ্তি মুস্তাফিজের বোলিং। তার সমসাময়িক ফর্মের বিচারে আজকের পারফরম্যান্স ছিল অবাক করার মতো। এই কন্ডিশন তার জন্য আদর্শ নয় বলেই আমরা জানি। এমন বিরূপ কন্ডিশনে এতোটা ভালো বোলিং করতে ওকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একজন দ্রুতগতির বোলারের মধ্যে যে আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং তার পাশাপাশি গতি এবং স্কিল দিয়ে বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কাবু করার তাগিদ থাকে, তার সবটাই মুস্তাফিজের বোলিংয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি। কেবল মাত্র স্লোয়ার বা কাটারের উপর নির্ভরতা আজ একেবারেই ছিলো না। আশা করি সামনের দিনগুলোতেও মুস্তাফিজকে আমরা এভাবেই দেখতে পাবো।
মৃত্যুঞ্জয় সুইং পাবে বলে ধারণা করেছিলাম, কিন্তু তা হয়নি। তার প্রতিভা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু এই পর্য়ায়ে সফল হতে চাইলে ওকে যে আরও পরিশ্রম করতে হবে, মৃত্যুঞ্জয় নিশ্চয়ই তা অনুভব করেছে। ওর গতি নিশ্চয়ই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মেহেদী হাসান মিরাজ শুরু থেকেই রান না দেওয়ার ব্যাপারে তৎপর ছিল। বল বেশি না ঘুরিয়ে উইকেট টু উইকেট লাইন মেইন্টেইন করা এবং মাঝে মাঝে বাইরের দিকে বের করে আনা এবং ফ্ল্যাট কৌশলে বল করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। তার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের কারণে তার উপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পায়নি কোনো ব্যাটসম্যান। বিরূপ কন্ডিশনে মিরা কে হয়তো এই কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
এবাদত দিন দিন পরিণত হচ্ছে। চাইলেই নিয়ন্ত্রিত বোলিং করতে পারে এখন। গতি এবং নিয়ন্ত্রণ; এই দুটি তার প্রধান অস্ত্র। অতি আক্রমণাত্মক মানসিকতার জন্য মাঝেমধ্যে একটু খরুচে হলেও আবার এই একই কারণে সে উইকেটটেকিং বোলার। অধিনায়কও নিশ্চয়ই এই মানসিকতার পরিবর্তন চাইবে না।
আউট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানের জন্য হাসানের যে সহানুভূতি এবং পরবর্তী উচ্ছ্বাসহীন উদযাপন, শুধু এ কারণেই আইসিসির উচিত তাকে একটা বিশেষ 'ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড' দেয়া। এই ধরনের আচরণ সবার জন্য অনুকরণীয় হতে পারে এবং তা শুধু ক্রিকেটেই নয়, সব ক্ষেত্রেই। অত্যন্ত সংবেদনশীল, স্বল্প অভিজ্ঞ এবং তরুণ এই বোলার এর মধ্যেই অধিনায়কের ডান হাতে পরিণত হয়েছে। স্কিলের পাশাপাশি চাপের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখার এই বিরল সক্ষমতা তাকে নিশ্চয়ই অনেক দূর নিয়ে যাবে।
বলতে গেলে শেষ ম্যাচটা আমরা হারতে হারতে জিতেছি এবং এই জেতায় দলের প্রায় সবাই কম বেশি অবদান রেখেছে। ডিপ মিড উইকেটে রনি, শর্ট থার্ডম্যানে মৃত্যুঞ্জয়-লিটন, এমনকি দলে না থাকা রাব্বিও দারুণ ক্যাচ নিয়েছে। তার পাশাপাশি ব্যাটিং-বোলিং তো আছেই। একটা দলকে সত্যিকার দলে পরিণত করতে চাইলে চাপের মুখে সবার এই ধরনের ছোট-বড় অথচ গুরুত্বপূর্ণ পারফরম্যান্সগুলো ইন্টার পার্সোনাল রিলেশনশিপ ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পাশাপাশি খেলোয়াড়দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মানসিক সক্ষমতা সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, যা কোচের কাজ সহজ করে দেয়।
সর্বোপরি, দল গঠনের ক্ষেত্রে দুর্বল টেইল নিয়ে লেইট মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরা কতোটা সাহস নিয়ে খেলতে পারবে, তা ভেবে দেখা দরকার। এ জন্য শেষ চারে নিদেনপক্ষে একজন ব্যাটিং করতে পারে, এমন বোলার প্রয়োজন। আশাকরি নির্বাচক এবং টিম ম্যানেজমেন্ট পরবর্তী সিরিজের আগেই এই সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হবেন। এ ছাড়া বাকি টেইলদের ব্যাটিংয়ের মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরী।
লেখক: প্রধান ক্রিকেট উপদেষ্টা, বিকেএসপি