সংবাদমাধ্যমে ধৈর্য ধরার কথা বললেও পারিশ্রমিক নিয়ে বিরক্ত ক্রিকেটাররা
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) একাদশতম আসর মাঠে গড়িয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। দিনের হিসেবে ছয় দিন, ইতোমধ্যে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে আটটি। ঢাকার প্রথম পর্ব শেষে বিপিএল এখন সিলেটে, এখানে মাঠের লড়াই শুরু হবে ৬ জানুয়ারি। পাঁচটি দল ইতোমধ্যে সিলেটে চলে এসেছে, ক্রিকেটারদের পদচারণায় মুখরিত সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একাডেমি মাঠ।
প্রতিদিন অনুশীলন চলছে, ক্রিকেটাররা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ম্যাচ খেলার। কিন্তু এতো ক্রিকেটীয় কার্যক্রমের মাঝেও আছে চাপা ক্ষোভ, হতাশা। বেশিরভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজিই যে এখনও ঠিকভাবে পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেয়নি ক্রিকেটারদের। কোনো টাকা না পেয়েই এবারের বিপিএল খেলতে নামেন ক্রিকেটাররা। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, কয়েক দিনের মধ্যেই প্রথম ধাপের পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু সব ফ্র্যাঞ্চাইজি তাদের দেওয়া কথা রাখেনি। পাঁচটি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটারদের প্রথম ধাপের পারিশ্রমিক দিয়েছে, সেটাও সবাইকে নয়। প্রথমভাগের পারিশ্রমিক পেয়েও অনেকে অসন্তুষ্ট, কারণ বেশিরভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজিই ২৫ শতাংশ শোধ করেছে। সেখানে কোনো পারিশ্রমিক না পাওয়া ক্রিকেটারদের মাঝে কতোটা হতাশা কাজ করতে পারে, চাইলেই সেটা অনুমান করা সম্ভব।
অবশ্য অনুমান করতে হচ্ছে না, পারিশ্রমিক নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে কয়েকটি দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার হতাশার কথা জানান। কেউ কেউ ক্ষোভও ঝারেন। এসব ক্রিকেটার কেবল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর দিকেই আঙুল তুলছেন না, কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকেও (বিসিবি)।
এই সুযোগটা বিসিবিই ক্রিকেটারদের করে দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী টুর্নামেন্ট শুরুর আগে প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছ থেকে ব্যাংক গ্যারান্টি বাবদ দেড় কোটি টাকা বুঝে নেওয়ার কথা বিসিবির। কিন্তু এবারের আসর শুরুর আগে কেবল একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির ব্যাংক গ্যারান্টি পেয়েছে বিসিবি। এ ছাড়া আসর শুরুর আগেই ক্রিকেটারদের ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেওয়ার নিয়ম, মানা হয়নি সেটাও।
আসর শুরুর পর পাঁচ দিন কেটে গেলেও কোনো দলই পুরোপুরিভাবে তাদের ক্রিকেটারদের ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক শোধ করেনি। একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি কয়েকজন ক্রিকেটারকে ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক দিয়েছে। চার ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে পারিশ্রমিক দিয়েছে। কোনো কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি ২৫ শতাংশ শোধ করেছে, তবু সব ক্রিকেটারকে নয়। বাকি দুই ফ্র্যাঞ্চাইজি এখনও কোনো ক্রিকেটারকে এক টাকাও দেয়নি। তারা কেবল বারবার পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে বিসিবির পক্ষ থেকেও।
স্বভাবতই এই দুই দলের ক্রিকেটাররা চরম অনিশ্চয়তায় আছেন। কেউ হতাশার কথা জানাচ্ছেন, কেউ ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন। কয়েক দিনের মধ্যে পারিশ্রমিক না পেলে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেবেন বলেও জানান একজন। সঙ্গত কারণেই এসব ক্রিকেটার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। এক টাকাও পারিশ্রমিক না পাওয়া এক ক্রিকেটার বলেন, 'এখনও এক টাকাও পাইনি। আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে দেবে বলে জানিয়েছে।'
'কিন্তু সেভাবে ভরসা পাচ্ছি না। কারণ, বিপিএল শুরুর আগে থেকেই এ কথা বলা হচ্ছে। একই কথা বারবার বললেও আমরা পারিশ্রমিক পাচ্ছি না, দলের কেউ কোনো টাকা পায়নি। গত কয়েক বছরে এমন হয়নি। বিসিবির উচিত ছিল ব্যাংক গ্যারান্টি ও টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক বুঝে নেওয়া। দেখি, দুই-এক দিনের মধ্যে টাকা না পেলে মিডিয়াতে ব্যাপারটি জানিয়ে দেব।'
কোনো পারিশ্রমিক না পাওয়া আরেক দলের এক ক্রিকেটার জানালেন, তাদেরকে আগামী ১০ জানুয়ারি প্রথম ভাগে পারিশ্রমিক দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি। এই ক্রিকেটারও হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, 'এখন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে আছি, কিন্তু এটা তো নিয়ম নয়। নিয়ম অনুযায়ী পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেওয়ার কথা আমাদের। ১০ জানুয়ারি দেবে বলে জানিয়েছে, দেখা যাক। এই তারিখের মধ্যেও পারিশ্রমিক না দিলে দলের প্রতি আস্থা থাকবে না আর।'
আরেক ক্রিকেটার জানালেন, মালিকপক্ষের ওপর আস্থা রাখার কথা জানিয়ে মিডিয়াতে যে ক্রিকেটাররা ধৈর্য ধরার কথা বলছেন, সেই ধৈর্য আর বেশি ধরা সম্ভব হবে না। মাঠের ক্রিকেট নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'এবার ভালো খেলা হচ্ছে, রান হচ্ছে প্রায় সব ম্যাচে। কিন্তু যাদের দিয়ে এই আয়োজন, বিনোদন; তারাই যদি টাকা না পায়, এই টুর্নামেন্টের কী মানে! আমরা অনেকেই ধৈর্য ধরছি, মিডিয়াতেও সেটা বলছি। তবে এভাবে চলতে থাকলে সেটা আর সম্ভব হবে না।'
একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির চরম সমালোচনা করে ক্ষুব্ধ এক ক্রিকেটার বলেন, 'একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে দেখলাম, ক্রিকেটারদের টাকা দেওয়া ছাড়া সব কাজই করছে। তারা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানিয়েছে, বিদেশি হোস্ট রেখেছে; কিন্তু তাদের দলের ক্রিকেটারদের হেলমেট, প্যাডও নেই। অন্য হেলমেট, প্যাডের ওপর কাপড় বেঁধে খেলতে হয় তাদের। আমরা বুঝি বিপিএলে অনেক শো অফ করার জায়গা আছে, সেটা করুক। কিন্তু ক্রিকেটারদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে তারপর সেটা করা উচিত।'
রংপুর রাইডার্স ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক শোধ করেছে। তবে সবাইকেই এই পরিমাণে দেওয়া হয়েছে কিনা, বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি টিবিএসের সঙ্গে কথা বলা রংপুর রাইডার্স সংশ্লিষ্ট একজন। সিলেট স্ট্রাইকার্স দেশি ক্রিকেটারদের ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক দিয়েছে, বিদেশিদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারটি প্রক্রিয়াধীন আছে। ঢাকা ক্যাপিটালস বেশিরভাগ ক্রিকেটারদের ২৫ শতাংশ পারিশ্রমিক দিয়েছে, দুই-তিন জনের পারিশ্রমিক বাকি আছে।
চিটাগং কিংস সবাইকে একই পরিমাণে পারিশ্রমিক দেয়নি, অনেকে আবার এক টাকাও পাননি। বিপিএলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশাল পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছে, প্রথমভাগের পারিশ্রমিক দিয়েছে দলটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবাইকে সমান পরিমাণে পারিশ্রমিক দেয়নি তারা। খুলনা টাইগার্স ও দুর্বার রাজশাহীর ক্রিকেটাররা এখনও কোনো পরিমাণে পারিশ্রমিক পাননি। ড্রাফট থেকে বিভিন্ন দলে জায়গা পাওয়া অনেক ক্রিকেটার এখনও কোনো টাকা পাননি। এমন কি সরাসরি চুক্তিতে দলে ভেড়ানো ক্রিকেটারদের দেওয়া কথাও অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি রাখেনি।