ক্যাসিনো ব্যবসা ও কমিশন-সংস্কৃতির অন্ধকার এক জগৎ
যুবলীগ নেতাদের অফিস, বাড়িঘর ও আস্তানায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সাম্প্রতিক অভিযান উন্নয়নের রোল মডেলের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশকে তুলে ধরেছে। গত কদিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু জায়গায় অপারেশন চালিয়েছে র্যাব। বেশকিছু ক্যাসিনো বন্ধ করে দিয়েছে। আটক করেছে ক্যাসিনোর অত্যাআধুনিক সব সরঞ্জামাদি, অ্যালকোহল, মাদকদ্রব্য ও প্রচুর পরিমাণে নগদ টাকা।
ওদিকে, অনেক প্রভাবশালীকে গ্রেফতার করা গেলেও বেশ কিছুসংখ্যক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অনেক ক্যাসিনো মালিক ব্যবসা বন্ধ করে লুকিয়ে পড়েছেন। নানা ধরনের ক্লাব ও সংগঠন চালানোর নামে তারা এসব অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে, দেশে একশ’রও বেশি ক্যাসিনো চালু রয়েছে। এর মধ্যে ষাটটির মতো রয়েছে কেবল ঢাকাতেই। একটি পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, স্টক মার্কেটের চেয়ে ক্যাসিনো ব্যবসায়ে বিনিয়োগের অংকটা অনেক বড়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান খান কামাল স্পষ্টতই জানিয়েছেন, দেশে ক্যাসিনো ব্যবসা বৈধ নয়। তাই কাউকে এটা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাহলে ক্যাসিনো চালানোর সরঞ্জাম দেশে কীভাবে আমদানি হল? এসর সরঞ্জাম তো অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় না। শুধু তাই নয়, আরও নানা ধরনের সামগ্রীও আমদানি করা হয়েছে এসবের সঙ্গে।
একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক দলের র্যালিতে কর্মীবাহিনীর আকার যত বড় হতো, দলটির শক্তি প্রকাশ পেত তত বেশি। এখন যুব সংগঠনগুলো কত সংখ্যক ক্যাসিনোর মালিক হতে পারে সেটির ওপর দলের শক্তি নির্ভর করে।
ক্যাসিনো ব্যবসা পৃথিবীর যেসব দেশে বৈধ সেখানেও একটি শহরে এত ক্যাসিনোর খবর শোনা যায়নি।
বাংলাদেশে জুয়া কেবল একটি খেলা হলে হয়তো তত সমস্যা ছিল না। এখানে এটি শক্তি, প্রভাব ও অবৈধ অর্থের সমার্থক হয়ে উঠেছে। জুয়ায় আসক্তি থেকে অনেক মধ্যবিত্ত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তি দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
র্যাবের সদস্যরা বিভিন্ন ক্লাব ও যুবলীগ নেতাদের অফিস থেকে যেভাবে অবৈধ অর্থ উদ্ধার করছেন, তাতে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে যে, দেশে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের পরিমাণ বিপুল।আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে অভিযান চালাচ্ছে সেখানেই পাচ্ছে গোপনে সঞ্চিত অর্থ।
আত্মস্বীকৃত যুবলীগ নেতা-কাম-ঠিকাদার জি কে শামীম তার অফিসে অভিযান শুরুর আগে ১০ কোটি টাকা ঘুষ সেধেছিলেন র্যাবকে। আরেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকেও বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থানের কারণে তা সম্ভব হয়নি। যুবলীগ থেকেও খালেদকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ওদিকে, শামীম যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের কেউ নন বলে মিডিয়ায় বিবৃতি এসেছে। বাস্তবতা হল, শামীম নিজেকে যুবলীগের কোঅর্ডিনেশন সেক্রেটারি হিসেবে পরিচয় দিতেন। বলতেন, তিনি আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জ জেলা ইউনিটের নেতা।
শামীম যদি দলের সদস্য না-ই হয়ে থাকেন, তবে কেন এত দিন আওয়ামীল লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে তার দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়নি?
ফকিরাপুলের ইয়াং মেন্স ক্লাবের নামে চালানো ক্যাসিনোর আয়ের বড় একটা অংশ খালেদ পাঠাতেন বেশ কিছু দলীয় নেতার কাছে। প্রশাসনের কর্তাদের কাছেও যেত। খালেদ আরও ষোলটি ক্যাসিনোর মালিক বলেও খবর এসেছে।
দুঃখের বিষয়, আমাদের নীতিনির্ধারকরা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে বাস্তবে রূপ দিতে এসব লোককেই ব্যবহার করতে চান।
ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির বেশ সখ্যতা। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন দলের নেতা ও যুবদলের সদস্যরা ক্যাসিনোগুলো চালাতেন। এখন আওয়ামী লীগ আর যুবলীগও একই কাজ করছে।
জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আড়াই হাজার কোটি টাকার সরকারি কাজ পেয়েছে।জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানিয়েছিলেন, মন্ত্রী ও প্রশাসনের কিছু কর্তাকে বড় অংকের অর্থ দিয়ে তিনি এতগুলো ঠিকাদরি কাজ নিতে পেরেছেন।
জানা গেছে, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দুজন সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শামীমের কাছ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
শামীমের অফিসে অভিযানের সময় র্যাব পেয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের রশিদ।
বিএনপির শাসনামলে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ডান হাত হিসেবে শামীমের বেশ পরিচিতি ছিল।কিন্ত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আওয়ামী নেতাদের সঙ্গেই তিনি সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আর এভাবে বাগিয়ে নেন অসংখ্য বড় বড় কাজের ঠিকাদারি।
কোথায় নেই তিনি! রূপপুরের পারমাণবিক প্রকল্প থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি তার কাজের বিস্তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবন নির্মাণের জন্য ৭৫ কোটি টাকার বিড জিতে নিয়েছিলেন শামীম।
স্থানীয় ছাত্রলীগের একটি অংশ মাত্র দুটো কোম্পানিকেই টেন্ডার দাখিলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল যাতে পছন্দমতো ঠিকাদারকে কাজটা পাইয়ে দেওয়া সহজ হয়।
ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সে সময়কার সভাপতির প্রভাবে অন্য কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সেখানে টেন্ডার দাখিল করতেই দেওয়া হয়নি।
এ নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে তখনকার ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ডিয়াজ ইরফান চৌধুরী খুন হন। সেটা ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বরের ঘটনা। নিজ বাসায় খুন হন ডিয়াজ।
গুলশান থানার পুলিশ আদালতে শামীম সম্পর্কে এভাবে বলেছে, তিনি অবৈধ উপায়ে অর্থ আত্মসাৎ, টেন্ডারবাজি এবং মাদক ও জুয়ার কারবারি হিসেবে কুখ্যাত। শামীমের সহযোগীদের সবাই সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, এমনটাও বলা হয়েছে রিপোর্টে।
শামীমের সেই সহযোগীদের ধরার ব্যবস্থা নেবেন কিনা সরকার সেটিও একটি প্রশ্ন। তাদেরকেও বিচারের মুখোমুখি করা হলে সরকারের সুবিধাই হত। নইলে অন্য আর সব উদ্যোগের মতোই এসব অভিযান ও ধরপাকড়ের কোনো মূল্য থাকবে না।
জি কে শামীম আর খালেদ মাহমুদের মতো লোকেরা রাজনীতির নামে অনেক দিন ধরেই নানা অপরাধ চালিয়ে আসছিলেন।সরকার তাহলে কেন আগেই এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই-বা কেন চোখ বুজে ছিল?
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা বলছেন, এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী। এত দিন কেন এটি করা হয়নি?তাছাড়া সব বিষয়ে যদি প্রধানমন্ত্রীকেই নির্দেশনা দিতে হয় তবে মন্ত্রীরা কী করছেন?
বাংলাদেশের প্রায় সব দলেই তরুণ শাখা রয়েছে।আওয়ামী লীগের যেমন যুবলীগ, বিএনপির যুবদল— তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির যুব ইউনিয়ন।এসব যুব শাখাগুলো মূলত বিশেষ দিবস পালন ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য দলীয় কার্যক্রমে অংশ নেয় না।
ইদানিং কিছু যুবলীগ নেতা ব্যবসায়ে ঢুকতে শুরু করেছিলেন। তারুণ্যের শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার নতুন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন তারা।
অবৈধ ব্যবসা চালানো আর টেন্ডারবাজির জন্য সরকারি কর্তাদের ঘুষ দেবার সংস্কৃতি চালু হয়েছে বটে।