আমি পূর্ব রাজাবাজার থেকে বলছি!
আমি পূর্ব রাজাবাজারের একজন বাসিন্দা। এরকম একটা খবর চাউর ছিল: ৩০ জনের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হলেই নির্দিষ্ট এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন জারির পদক্ষেপ নেবে সরকার।
আর আমি যে এলাকায় থাকি, রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকা, এখানে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার এলাকাতেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯ জন। ফলে ঢাকার প্রথম লকডাউনের মুখে আমরাই পড়ে গেলাম। যদিও আমার সন্দেহ আছে ঢাকার অন্য ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মধ্যে পূর্ব রাজাবাজারই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কিনা!
গতকাল মধ্যরাত থেকেই এলাকায় লকডাউন চালু হয়ে গেল। আমি একে এম সালেকুজ্জামান মামুন রেড জোন হিসেবে লকডাউনের আওতায় আসা রাজধানীর প্রথম এলাকার একজন হয়ে গেলাম। এটা নিজের জন্য এক বিরল অভিজ্ঞতা কিনা জানিনা। আমি পেশায় ব্যবসায়ী পূর্ব রাজাবাজার এলাকার নাজনীন স্কুল সংলগ্ন মহল্লার বাসিন্দা।
আমার সঙ্গে থাকে ছোট ভাই তারেকুজ্জামান। এবং এলাকাভিত্তিক আচমকা নেমে আসা এই লকডাউনের আওতায় পড়ে এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি আমরা দুই ভাই। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজাবাজারের বাসিন্দা আমরা দুজনেই।
গতকাল সকালেই বিশেষ জরুরি কাজে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ভাই ভেবেছিল, রাত্রে লকডাউন শুরু হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরতে পারবে। কিন্তু, তা আর সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়েই আমার ছোট ভাই এখন আশ্রয় নিয়েছে নিউমার্কেট এলাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে। তবে কয়েকদিন ধরেই আমাদের মধ্যে লকডাউন নিয়ে ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠা কাজ করছিল।
সকাল হতেই আটকে পড়া ছোট ভাই তারেকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করি। সে বন্ধুর বাসায় ভালোই আছে, তবে আমাদের নিয়ে চিন্তিত। এখানে অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারছি না।
যেমন, সরকারের পক্ষ থেকে দুটি সংগঠনকে অনলাইনে খাবার ও জরুরি পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে শুনেছিলাম, কিন্তু তাদের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করব, কোন প্রক্রিয়ায়, কেউই জানেন না। প্রতিবেশী ও এলাকার পরিচিত দুএকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেও সদুত্তর পেলাম না।
এটুআই বা ক্যাব নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনলাইনে খাবার সংগ্রহ করা যাবে বলে জেনেছিলাম, তাদের কোনো নাম্বারও উদ্ধার করতে পারলাম না।
এ লকডাউনের আগে এলাকায় মাইকিং অথবা বাড়িবাড়ি লিফলেট বিলি করলেই ভালো হতো। ছোট ভাই বারবার আমাকে নিয়ে ওর দুশ্চিন্তার কথা জানাচ্ছে ফোনে। কিন্তু মুখে মানা করলেও ভেতরে ভেতরে আমার উৎকণ্ঠা হচ্ছে।
রেড জোন চিহ্নিত হওয়ার পর গত কয়েকদিন ধরেই এলাকায় পুলিশ ও সেনা বাহিনীর সদস্যদের লকডাউন কার্যকরে এলাকায় তৎপরতা চালাতে দেখেছি। এখন প্রশাসন ও সেনাবাহিনী কাউকেই এলাকা ত্যাগ করতে দিচ্ছে না। এমনকি বাইরে থেকে কাউকে ভেতরে আসতেও দিচ্ছে না। ডাক্তার, নার্স এবং সংবাদকর্মী বাদে আইবিএ হোস্টেল সংলগ্ন একমাত্র গেটটি দিয়ে কাউকেই যাতায়াত করতে দেওয়া হচ্ছে না।
তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে সেনাবাহিনী মোতায়েন করায় এলাকাবাসী মনে হয়েছে আশ্বস্ত বোধ করছে। ভাইরাস সংক্রমণে প্রতিরোধে সবাইকেই যে আরেকটু অসুবিধার মধ্য দিয়েই যেতে হবে তা জেনেও এই পদক্ষেপকে জরুরি বলেই মনে করছি।
আমার মুঠোফোনে এলাকার এক বন্ধু জানাল তার দূশ্চিন্তা হচ্ছে , লকডাউনের মাঝে যেন বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ অব্যাহত থাকে তা নিয়ে। আমি অবশ্য মনে করি এসব ব্যাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কাউকে এপর্যন্ত এসব নিয়ে বিপদে পড়তে দেখিনি। তারপরও মনে করি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এখানে সম্পৃক্ততা হওয়াটা প্রয়োজন। ওষুধ, খাদ্য ও বাড়ি বাড়ি কাঁচাবাজার পৌঁছে দেওয়ার কাজটা নিশ্চিত করা জরুরি।
আমি জরুরি কয়েকদিনের অগ্রিম বাজার করে রেখেছিলাম। লকডাউন দীর্ঘ হলে কি হবে জানিনা।
এলাকায় এখন কেউই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। আজ সকাল পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে। পরে কি হবে তা বলতে পারছি না।
আমার মতো পরিবারের মঙ্গল নিয়ে এলাকার সবার মাঝেই কমবেশি উৎকণ্ঠা কাজ করছে অনুমান করতে পারি। তবে এই কঠিন বাস্তবতা তো এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই। প্রথম দিন কোনো রকমে পার করছি, কাল, পরশুর পর কেমন দিন আসবে কে জানে! এই মুহূর্তে দেশবাসী যেন করোনার মহামারি থেকে দ্রুত মুক্তি পায় সেই দোয়াই শুধু করছি সৃষ্টিকর্তার কাছে।